মোঃ নাজিম উদ্দিন, দক্ষিণ চট্টগ্রাম:

আগামী ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত অধ্যুষিত চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে বড় রাজনৈতিক দলের দুই প্রার্থী কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হচ্ছেন। তাদের দু’জনের লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। এই লড়াইয়ে এবার ভোটের সমীকরণ কি হতে পারে তা, দেখতে জনগণকে অপেক্ষা করতে হবে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই আসনে একাধিক হেভিওয়েট প্রার্থীদের পিছনে পেলে আওয়ামী লীগ থেকে চূড়ান্ত মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য প্রফেসর ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দীন নদভী এবং ২০ দলীয় জোট থেকে চূড়ান্ত মনোনয়ন পেয়েছেন জামায়াত ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির নায়েবে আমির আ ন ম শামসুল ইসলাম। শামসুল ইসলাম ভাংচুর ও নাশকতা মামলায় আসামি হয়ে গত কয়েক মাস ধরে চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দি আছেন। তিনি কারাগারে থাকলেও তার পক্ষে এলাকায় ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন বিএনপি জামায়াত ঐক্যবদ্ধ হয়ে। এই আসনটি জামায়াতের ঘাঁটি হিসাবে পরিচিতি হওয়ায় এখানে রয়েছে তাদের বেশি কর্মী-সমর্থক। তবে গত দশ বছর একটানা মহাজোট সরকার ক্ষমতায় থাকার ফলে সারাদেশের মতো এখানেও অনেক উন্নয়ন হয়েছে।

বিশেষ করে বর্তমান সাংসদ প্রফেসর ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দীন নদভী এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়। এতে নদভীর জনসমর্থন বাড়তে থাকে। তিনি সরকারি উন্নয়নের বাইরে নিজের পরিচালিত আল্লামা ফজুলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমেও এলাকায় অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। পাশাপাশি তার সহধর্মিনী কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের সদস্য রিজিয়া রেজা চৌধুরী নিয়মিত সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে দলে কর্মী-সমর্থক বাড়িয়েছেন। স্বামীকে আবারও নির্বাচিত করতে প্রচারণাতেই ব্যস্ত রয়েছেন রিজিয়া। তিনি অর্ধশত নারী কর্মী বাহিনী নিয়েই প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পথসভা, গণসংযোগ করে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে স্বামীর জন্য ভোট ভিক্ষা চাচ্ছেন। ভোটারদের দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রæতি।

আ.লীগের বিরোধ অবসান: গত কয়েক বছর ধরে চলে আসা বিরোধ অবসান হল সাতকানিয়া লোহাগাড়া দু’উপজেলার আওয়ামী লীগের সাথে সাংসদ প্রফেসর ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভীর। নৌকার প্রার্থী নদভীকে জেতাতে একাট্টা হয়েছেন দলের নেতা-কর্মীরা। নদভীর নির্বাচনী মাঠে নেমেছেন এখানকার আওয়ামী লীগের সকল নেতা-কর্মীরা। সাংসদ নদভীর সাথে স্থানীয় আওয়ামী লীগের দৌরাত্ম শুরু হয় ২০১৬ সাল থেকেই। এরপর নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়ে। তখন থেকেই দলের কর্মসূচীও আলাদা ভাবে পালিত হয়ে আসছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের মনোনয়ন পেতে ফরম কিনে ছিলেন ১৮ জন প্রার্থী। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাদশ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হিসাবে নদভীকে মনোনয়ন দেয়ার পর বদলে যায় এখানকার পরিস্থিতি। সকল ভেদাবেদ ভুলে গিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ এক কাতারে এসে মিলিত হয়েছে নদভীর সাথে।

বিগত ২০১৩-১৪ সালে সাতকানিয়া লোহাগাড়ায় মহাসড়কসহ একাধিক স্থানে ব্যাপক নাশকতা চালিয়েছিল জামায়াত-শিবিরের কর্মী-সমর্থকরা। ওই সময় পুলিশের দায়ের করা মামলায় বেশ কিছু জামায়াত বিএনপির লোক গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যান। পরবর্তীতে তারা জামিনে বেরিয়ে চট্টগ্রাম শহর ও অন্য জেলা শহরে অবস্থান করে আসছে। অনেকেই গ্রেপ্তার এড়াতে গা ঢাগা দেন। কেউ কেউ মামলার আসামি হয়ে বিদেশেও চলে যান। এতে গত কয়েক বছর ধরে জামায়াত-শিবিরের দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি। বর্তমানে ধানের শীষের প্রার্থী জামায়াত নেতা আ ন ম শামসুল ইসলামকে বিজয় করতে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছেন দলের নেতাকর্মীরা।

তার পক্ষে প্রতিদিন গণসংযোগ করে ভোট প্রার্থনা করছে সাতকানিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন, ভাইচ চেয়ারম্যান ইব্রাহীম, দক্ষিণ জেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি শেখ মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, দক্ষিণ জেলা বিএনপির প্রচার সম্পাদক নাজমুল মোস্তফা আমিন, সাতকানিয়া উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব মুজিবুর রহমানসহ ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা। এ আসনটি নিজেদের দখলে রাখতে প্রতিবার বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক দল জামায়াতের উপর বেশি নির্ভরশীল। জামায়াতের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা মনে করেন শত প্রতিকুলতার মাঝেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকবেন এবং শেষ পর্যন্ত লড়াই করে তাদের প্রার্থীকে বিজয় করবেন। অন্যদিকে আওয়ামী লাগের নেতা-কর্মীরা মনে করেন, বিগত ৫ বছরে ব্যাপক উন্নয়নের ফলে জণগন নৌকা প্রতীককে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করবেন। এছাড়াও এ আসনে আরও প্রতিদ্ব›িদ্বতা করছেন, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নুরুল আলম (হাতপাখা), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ফজলুল হক (আম) ও গণফোরামের আব্দুল মোমেন (উদীয়মান সূর্য)।

উল্লেখ্য, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনের মোট ভোটার ৪,৬৬,১৭২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২,৩২,৭৭৫ জন এবং নারী ভোটার ২,৩৩,৩৯৭ জন।
১৯৭৩ সালের পর ২০১৪ সালে প্রথমবার এ আসনে জয় পায় আওয়ামী লীগ। ১৯৯১ সালের ভোটে চট্টগ্রাম-১৫ আসনে তৎকালীন দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুকে হারিয়ে জয়লাভ করেন জামায়াতের শাহজাহান চৌধুরী। তবে ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে শাহজাহান চৌধুরীকে হারিয়ে জয় ছিনিয়ে নেন বিএনপির কর্নেল (অব.) অলি আহমদ। ২০০১ সালে কর্নেল অলি ও শাহজাহান চৌধুরী দু’জনই চারদলীয় জোটের মনোনয়ন চান। শেষ পর্যন্ত দু’জনই ভোটের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। অলি ও আওয়ামী লীগের জাফর আহমদকে হারিয়ে শেষ হাসি হাসেন শাহজাহান চৌধুরী।

২০০৮ সালের নির্বাচনে অলিকে হারিয়ে জয়লাভ করেন জামায়াতের আ ন ম সামশুল ইসলাম। ওই নির্বাচনে সামশুল ইসলাম পান ১ লাখ ২০ হাজার ৩৩৯ ভোট ও এলডিপির কর্নেল অলি পান ৬৩ হাজার ৪১২ ভোট। আওয়ামী লীগ হয় তৃতীয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুযারির নির্বাচনে জয়লাভ করেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবু রেজা মোহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী।

২০ দলীয় জোটের প্রার্থীর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ও দক্ষিণ জেলা জামায়াতের আমির মুহাম্মদ জাফর সাদেক বলেন, ধানের শীষের প্রার্থীর প্রচারণায় বাধা দিচ্ছে নৌকার প্রার্থীর লোকজন। প্রচারণা চালাতে গেলে জামায়াত প্রার্থীর কর্মীদের মারধর করছে আওয়ামী লীগের লোকজন। এটা নৌকা প্রার্থীর নির্দেশে করছে তারা। যাতে জামায়াতের কর্মীরা প্রচারণা চালাতে না পারে। আমরা এ বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে একাধিক বার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ দিয়েছি, কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না প্রশাসন। পুলিশ জামায়াত কর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে অভিযান চালাচ্ছে। তিনি দাবি করেন, ধানের শীষের পক্ষে বিরামহীন প্রচারণা চালাতে না পারলেও ভোট বিপ্লবের মাধ্যমে তার জবাব দেওয়া হবে। নৌকা প্রতীকের প্রার্থী প্রফেসর ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দীন নদভী বলেন, নৌকা প্রতীকের পক্ষ থেকে কোনো প্রার্থীর প্রচারকাজে বাধা দেওয়া হয়নি। তাঁরা নিজেদের দুর্বলতা ঢাকার জন্য অন্যের উপর দোষ চাপাচ্ছেন।