এমএ সাত্তারঃ

কক্সবাজার সদর উপজেলার পিএমখালী ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের ছনখোলা এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা মমতাজ বেগম প্রকাশ মনতাজী (চদ্মনাম) স্বামী মারা গেছে প্রায় ৭ বছর গত হয়েছে। গরীব পরিবার হলেও এলাকায় কোন বদনাম নেই আর বিধবা হিসাবে মানবেতর জীবন যাপন করে আসছে। এতিম ও নাবালক ছেলে মেয়েসহ ছয় সদস্যের অভাবের সংসার। নিরাপত্তা, গ্রামের পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন কানকথা ও ছোলেমেয়েদের লেখাপড়ার কথা চিন্তা করে গত কয়েক বছর আগে ঘরে একটি বিদ্যুতের মিটার নিয়ে তিনটি লাইট ও একটি ফ্যান ব্যবহার করে আসছেন। শুরু থেকে প্রতি মাসে ৭০ থেকে ১০০, আবার মাঝে মধ্য ১৩০/১৫০ এভাবে, মোট কথা ২০০ টাকার মধ্যে বিদ্যুৎ বিল আসত। কিন্তু গত বছরএক ধরে অস্বাভাবিক বিল আসতে থাকে। বেশি বিল আসার কারণে মাঝেমধ্যে ২/১ মাস বিদ্যুৎ ব্যবহার একদম সীমিত করলেও পরের মাসে গত বিলের চাইতে আরো পাঁচগুন বেশি। এর মধ্যে গত মাসে (নভেম্পর) ১১৩০ টাকার বিল হাতে পেয়ে হতভম্ব হয়ে পড়েন। ছুটে যান বিদ্যুৎ অফিসে। অফিসের বিল প্রস্তুতকারী এক মহিলা অপারেটরের কাছে গিয়ে অতিরিক্ত বিল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি ধমক দিয়ে বলেন, মেইন সুইস বন্ধ রাখিয়েন, বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে বিল আসবেই, এখন থেকে এভাবে বিল আসবে, ভালো লাগলে ব্যবহার করেন, না হলে বিদ্যুৎ ব্যবহার ছেড়ে দেন।
এভাবে কক্সবাজার পবিস অফিসের প্রায় ৫৬ হাজার (জুলাই ২০১৭ সালের তথ্য মতে) বিভিন্ন খাতওয়ারী গ্রাহক গত নভেম্বর মাসের অতিরিক্ত বিল পেয়ে চমকে উঠছেন। অতিরিক্ত বিল থেকে বাসাবাড়ি, দোকানপাট, মসজিদ, মাদরাসা, স্কুল, কলেজ, মন্দির কিছুই বাদ পড়ছেনা। অফিসে গিয়ে অসহযোগিতার কারণে বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছে তারা।
গ্রাহকদের অভিযোগ, কোথাও গিয়ে তারা এই অস্বাভাবিক বিলের কোনো যৌক্তিকতা জানতে পারছেন না। অফিসের লোকজন ও বাইরের কিছু দালাল প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে আশা শত শত গ্রাহককে বলে দিচ্ছেন, এখন থেকে এভাবে বিল আসবে, সময়মতো বিল পরিশোধ না করলে লাইন কেটে দেয়া হবে। তাই এর কোনো সদুত্তর বা প্রতিকার না পেয়ে নিরুপায় হয়ে অনেক গ্রাহক ধার্যকৃত বিল পরিশোধ করে যাচ্ছেন।
সরেজমিনে কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে গিয়ে দেখা যায়, অতিরিক্ত বিল নিয়ে শত শত ভুক্তভোগী দিনভর বিভিন্ন টেবিলে ছোটাছুটি করেও কোনো সমাধান পাচ্ছেন না। এ সময় অফিসে আসা খুরুশকুল ডেইল পাড়ার আবদু শুক্কুর ১৪০/৫০ টাকা স্হলে ৮৫০ টাকা, একই ইউনিয়নের ব্যবসায়ী মো: আবদুল হাকিম ৩ হাজার ৪/৫ শত টাকার স্থলে ১২ হাজার ২০ টাকা, দিনমজুর রাখাল চন্দ্রদে ১৮০/ ২০০ টাকার স্থলে ১ হাজার ৪০ টাকা, পিএমখালীর ব্যবসায়ী শহীদুল আলমের বাড়ী ও দোকানের ১৫ শত টাকার স্থলে ৩ হাজার ৮০ টাকা। বাংলাবাজার স্টেশনের দোকানদার নাজিম সওদাগরের দোকানে ১২/১৩ টাকার স্থলে ২ হাজার ৬৩০ টাকা। ভারুয়াখালীর রোজিনা আকতারের বাড়ীর বিল ২শত ৮০ টাকা থেকে ৩ শত টাকার স্থলে ১ হাজার ৬৩০ টাকা অতিরিক্ত বিল আসার কথা বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং প্রত্যেকের বিলের কাগজ দেখান।
কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির বিল প্রস্তুতকারি (নাম প্রকাশ না করার শর্তে) একাধিক মহিলা অপারেটর জানান,গত একসপ্তাহ যাবৎ প্রতিদিন শত শত গ্রাহক অতিরিক্ত বিলের বিষয় জানতে আসছেন, এত লোকদেরকে আমরা বুঝাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছি। তাই দুই-একজনের সাথে কটু কথা বলা হয়ে যেতে পারে। একজন লোকের ২০০ টাকার স্থলে ৫/৬ শত টাকা হলেও চলতো কিন্তু ১৪/১৫ শত টাকা হলে নিজের বিবেকেও বাধা পায়। তাই কী করবো, বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেও পারছি না।
কেন এমন হচ্ছে বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিলের কারণ মিটার রিডিংয়ে কারচুপি। মিটার রিডাররা প্রতি মাসে সব গ্রাহকের মিটারের রিডিং সরেজমিনে না নিয়ে অনুমাননির্ভর বিল করেন। ফলে কোনো কোনো মাসে প্রকৃত ব্যবহারের তুলনায় বিল কিছু কম হতে পারে। এতে কয়েক মাসের ব্যবহার থেকে কিছু কিছু জমা হয়ে বাড়তি বিল আসতে পারে।
যদি এভাবে ইউনিট জমিয়ে রেখে এক মাসে এসে হিসাব সমন্বয় করা হয়, তাহলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবহারকারীর গ্রাহকশ্রেণী পরিবর্তন হয়ে আবাসিক গ্রাহক বাণিজ্যিক গ্রাহকে রূপান্তরিত হয়ে যান। এতে গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হন।
গ্রাহক আনু মিয়া, আকরাম হোসেন চৌধুরীসহ অনেকে জানান, ভুয়া ও অতিরিক্ত বিল করে আমাদের হয়রানি করা হচ্ছে। অফিসে গেলে বলে, পরে ঠিক করে দেয়া হবে। অমুক সাহেব ফিল্ডে, আপনি অপেক্ষা করুন, কম্পিউটার ম্যান নাই ইত্যাদি নানা অজুহাত দেখিয়ে গ্রাকদের হয়রানি করা হচ্ছে। আবার কিছু দালাল আছে তারা মিটারে সমস্যা আছে বলে কিছু কিছু গ্রাহকদের মাধ্যমে মিটার পরিবর্তনের আবেদন করিয়ে অতিরিক্ত টাকা আদায় করেন। অফিসে গিয়ে সেবার পরিবর্তে স্বীকার হতে হয় প্রতারনার।
উল্লেখ্য যে কক্সবাজার পবিস অফিসের জন্মলগ্ন (১৯৯১) থেকে অদ্যবদি কিছু কর্মকর্তা কর্মচারী একই কর্মস্থলে কাজ করার সুবাধে তারা বিভিন্ন এলাকায় সোর্স (দালাল) তৈরী করে ঘুষ বানিজ্য করে যাচ্ছে। পাশাপাশি ওই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মনগড়া বিল দেওয়াসহ নতুন সংযোগ ফি বাবদ অবৈধভাবে টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। গ্রাহকদের অভিযোগ, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে গ্রাহক সংযোগের নামে আদায় করা হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। এছাড়া চলতি মাসেও গ্রাহকদের কাছ থেকে দুই থেকে তিন গুণ বিল আদায় করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বিদ্যুতের যে সংযোগ বিনামূল্যে পাওয়ার কথা, তার জন্যও গুনতে হচ্ছে মোটা অংকের অর্থ।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কক্সবাজার পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ আব্দুন নুর বলেন, সরকার এখন সব কিছু বিনা মূল্যে দিচ্ছে।
সেবা সম্পর্কে না জানার কারণে কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের হাতে হয়রানীর শিকার হচ্ছে।
তবে কিছু কর্মকর্তা ঘুষ নেয়ার অভিযোগ মিথ্যা নয় বলে জানান ডিজিএম।
তিনি বলন, অভিযোগ সম্পর্কে বিস্তারিত লিখে নিউজ করেন, নতুবা দরখাস্ত আকারে দিলেও অভিযুক্তদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিবেন বলে জানান উক্ত ডিজিএম।