বিশেষ প্রতিবেদেকঃ
র‍্যাব ও পুলিশের সঙ্গে ভাল সম্পর্কের ভয় দেখিয়ে এক যুবকের কাছে কক্সবাজার সদরের ঝিলংজার জানারঘোনা এলাকায় চাঁদা দাবি, জায়গা দখল ও কথিত গ্রাম্য শালিসী সহ সাধারণ মানুষ নানাভাবে জিন্মি রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে এলাকাবাসীর।

এলাকাবাসীর দাবি, মাত্র এক দশক আগেও নুন আনতে পান্তা পুরানো পরিবারের সন্তান সরওয়ার আলম এখন যাপন করছে ভোগবিলাসী জীবন। ইয়াবা ব্যবসার আড়ালে কথিত বৈধ ব্যবসার কথা প্রচার করে রাতারাতি বনে গেছে কোটি টাকার মালিক। এলাকায় মাদক ব্যবসা, জায়গা দখল, চাঁদা দাবি ও গ্রাম্য শালিসের নামে লোকজনকে জিন্মি করে রেখেছে। তার নেতৃত্বে এলাকায় রয়েছে ২০/২৫ জন যুবকের একটি সন্ত্রাসী দল। তার অপকর্মের কেউ প্রতিবাদ করলে মারধর সহ নানা হয়রানির শিকার হতে হয়।

স্থানীয় বাসা বাড়ীর ভাড়াটিয়াদের অনেকে তার আতংকে এলাকা ছেড়েছে দাবি করে এলাকাবাসী জানায়, হুমকি ধমকির কারণে সাধারণ সন্ত্রাসী যুবক সরওয়ারের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস পায় না।

র‍্যাব ও পুলিশের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক থাকার ভয় দেখিয়ে লোকজনকে হয়রানির হুমকি দিয়ে অভিযুক্ত যুবক সরওয়ার আলম এলাকাবাসীকে জিন্মি করেছে বলে অভিযোগ তাদের।

অভিযুক্ত সরওয়ার আলম ওরফে ইয়াবা সরওয়ার (৩২) কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের জানারঘোনা নাজিরা পাড়ার মৃত গোলাম নবীর ছেলে।

এলাকাবাসীর দাবি, আইন-শৃংখলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টরা তাকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিদানের।

এলাকাবাসি জানিয়েছে, গত দশক আগেও ভবঘুরে জীবনযাপন করতো সরওয়ার আলম। বেকার যুবক হিসেবে এলাকায় চুরি ছিনতাই করাই ছিল তার পেশা। স্থানীয় এক ব্যক্তির বাগানের সুপারি চুরির ঘটনায় মামলার কারণে সে গত ২০০৭ সালে এলাকা ছেড়ে ছিল। এরপর ঢাকা ও চট্টগ্রামে সে বিভিন্ন গার্মেন্টেসে চাকুরি করতো। গার্মেন্টেসে চাকুরির সুবাধে এক পর্যায়ে সরওয়ার আলম জড়িয়ে পড়ে ইয়াবা ব্যবসায়।
এক পর্যায়ে গত ২০১৩ সালে সরওয়ার আলম এলাকায় ফিরে এসে ২০/২৫ জনের একটি সন্ত্রাসী দল গড়ে তোলে। সে আবারো জড়িয়ে পড়ে চাঁদাবাজী, জায়গা দখল ও ইয়াবা ব্যবসা সহ নানা অপরাধকর্মে। রাতারাতি বনে যায় কোটি টাকার মালিক।

জানারঘোনা এলাকার বাসিন্দা আব্দুল করিম বলেন, গত এক সপ্তাহ আগে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত অভিযোগে পুলিশ সরওয়ার আলমের বাড়ীতে অভিযান চালায়। এসময় অভিযানের বিষয়টি টের পেয়ে পালিয়ে যাওয়ায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। তবে বাড়ীতে তল্লাশী চালালেও ইয়াবা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, গত ৬ মাস আগে পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত কিছু জায়গা এক ব্যক্তির কাছে তিনি বিক্রি করেন। এ নিয়ে জায়গা পরিমাপ করতে গেলে সরওয়ার আলম দলবল সহ এসে বাঁধা দেন। বিক্রিত জমিতে তার খতিয়ানভূক্ত জায়গা থাকার কথা বলে টাকা দাবি করেন।

এতে অনীহা জানালে এক পর্যায়ে সরওয়ার ও তার লোকজন তাদের উপর হামলা চালায় বলে অভিযোগ করেন আব্দুল করিম।

জানারঘোনার আরেক বাসিন্দা ইমাম হোসেন স্বপন বলেন, সন্ত্রাসী সরওয়ারের হুমকি ধমকিতে এলাকাবাসী আতংকে রয়েছে। কেউ তার অপকর্মের প্রতিবাদ করলে নেমে আসে মারধর সহ নানা নির্যাতন। এলাকার বেকার ও উচ্ছৃংখল যুবকদের তার দলে বিড়িয়ে এলাকায় কায়েম করছে রাম রাজত্ব।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, এলাকায় ইয়াবা ব্যবসার পাশাপাশি এলাকায় চাঁদাবাজী, জমি দখল এবং চুরি ছিনতাই সহ নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত তার চাঁদা দাবি ও হুমকিতে স্থানীয় বাসা বাড়ীর অনেক ভাড়াটিয়া এলাকা ছেড়ে চলে গেছে।

ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত থাকার কারণে এলাকাবাসীর কাছে সরওয়ার আলম এখন ‘ইয়াবা সরওয়ার’ নামে পরিচিত বলে দাবি করেন ইমাম হোসেন স্বপন বলেন, তার কারণে এলাকার উঠতি বয়সের যুবকেরা জড়িয়ে পড়ছে মাদক সেবন ও ব্যবসা সহ নানা অপকর্মে। এলাকার সম্ভাবনাময় মেধাবী মো. রানা নামের এক যুবক তার খপ্পড়ে পড়ে আজ দেশ পলাতক।

জানারঘোনা নাজিরাপাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ বাবুলের মেয়ে মমতাজ বেগম বলেন, সরওয়ার আলমের বসতভিটা লাগোয়া তাদের বাড়ী ভিটেও। গত বছরখানেক আগে সে নতুন বাড়ী নির্মাণের সময় জোরপূর্বক তাদেরও কিছু জায়গা সীমানা দেয়ালের ভিতরে দখল করে নেয়।

এ নিয়ে প্রতিবাদ জানালে পরিবারের লোকজনকে মারধর করে সরওয়ার প্রাণনাশের হুমকি দেয় বলে জানান ভূক্তভোগী এ নারী।

মমতাজ বলেন, সরওয়ারের ভয়ে তাদের সবসময় আতংকে থাকতে হয়। তাদের জায়গা জোরপূর্বক দখল করে নিলেও আতংকে উদ্ধারেরও ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না।

আব্দুল গফুর নামের স্থানীয় আরেক বাসিন্দা বলেন, তার একটি ভাড়া বাসায় কিছু ভাড়াটিয়া ছিল। সরওয়ারের সন্ত্রাসী দলের লোকজন ভাড়াটিয়াদের কাছে চাঁদা দাবি করতো। কেউ অনীহা জানালে মারধর করা হতো। এমনকি তার লোকজন এসব ভাড়াটিয়া বাসায় চুরি সংঘটন করতো।

সন্ত্রাসী সরওয়ারের আতংকে কয়েকজন ভাড়াটিয়া বাসা ছেড়ে দিয়ে অন্য এলাকায় চলে গেছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

স্থানীয় জানারঘোনা এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ ছোট্টু অভিযোগ করে বলেন, সন্ত্রাসী সরওয়ার ও তার দলবলের কাছে এলাকাবাসী গত ৫/৬ বছর ধরে জিন্মি করে রেখেছে। র‍্যাব ও পুলিশের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক থাকার ভয় দেখিয়ে এলাকার সাধারণ মানুষকে নানাভাবে প্রতিনিয়ত হয়রানি করে চলছে। কেউ তার সঙ্গে দ্বিমত পোষন করলে ভয় দেখায় র‍্যাব ও পুলিশে ধরিয়ে দেয়ার।

কক্সবাজার শহরের সুগন্ধা বিচ পয়েন্টে চাইনিজ ফুড এন্ড রেস্টুরেন্টের নামে কথিত বৈধ ব্যবসার আড়ালে ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে সরওয়ার এখন রাতারাতি কোটি টাকার মালিক বলে দাবি করেন তিনি।

ছোট্টু বলেন, একসময়ের ভবঘুরে বেকার যুবক সরওয়ার এখন যাপন করে ভোগবিলাসী জীবন। গত ২০১৩ সালে এলাকায় ফিরে আসার আগে তার বাড়ীটি ছিল কাঁচা কুঁড়েঘর। মাত্র অল্প কয়েক বছরে বাড়ীটি এখন বিশাল পাকা সীমানা দেওয়াল ঘেরা সেমিপাকা। বাড়ীতে রয়েছে মূল্যবান আসবাবপত্রও।

সরওয়ার ও তার সন্ত্রাসী দলের কাছে এলাকাবাসীকে জিন্মিদশা থেকে মুক্ত করতে আইন-শৃংখলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টদের প্রতি দাবি জানিয়েছে ভূক্তভোগী এলাকাবাসী।

ঝিলংজার স্থানীয় ইউপি সদস্য মোহাম্মদ শাহ বাহাদুর বলেন, সন্ত্রাসী সরওয়ার ও তার দলবলের কাছে এলাকার সাধারণ মানুষ এক প্রকার জিন্মি। বিষয়টি আইন-শৃংখলা বাহিনীর কাছে মৌখিকভাবে অবহিত করা হয়েছে।

তবে এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছে লিখিত অভিযোগ দেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।

এ ব্যাপারে সরওয়ার আলমের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে কোন ধরণের সাড়া না পাওয়ায় কথা বলা সম্ভব হয়নি।

র‍্যাব-৭ কক্সবাজার ক্যাম্পে কোম্পানী কমান্ডার মেজর মো. মেহেদী হাসান বলেন, ঝিলংজার জানারঘোনা এলাকায় সরওয়ার আলম নামে কোন সোর্স নেই। র‍্যাবের পরিচয় দিয়ে কেউ লোকজনকে হয়রানি করার বিষয়টিও অবগত নন। তবে এলাকার লোকজন সুনির্দিষ্ট কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তারপরও অভিযোগের ব্যাপারে র‍্যাব খোঁজ খবর নিয়ে সত্যতা পেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে বলে জানান র‍্যাবের এ কর্মকর্তা।

একই বিষয়ে কক্সবাজার সদর থানার ওসি খন্দকার ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ঝিলংজার জানারঘোনায় সরওয়ার আলম নামে পুলিশের সোর্স পরিচয়ে কোন লোক নেই। পুলিশের লোক পরিচয়ে লোকজনকে হয়রানির অভিযোগটি গুরুতর।

এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নিয়ে সত্যতা পেলে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে বলে জানান ওসি ফরিদ।