বাংলাট্রিবিউন:

বাংলাদেশে এবারের নির্বাচন নিয়ে ভারত আপাতদৃষ্টিতে বেশ নিষ্ক্রিয়তা দেখাচ্ছে। তবে নির্বাচনে তারা যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারকে আবারও বিজয়ী দেখতে চায়, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। ক্ষমতাসীন বিজেপি ও সরকারের একাধিক নেতা-মন্ত্রী-নীতিনির্ধারক বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন।

বিজেপি তথা আরএসএসের (রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ) প্রভাবশালী এক কেন্দ্রীয় নেতার কথায়, “গোটা দক্ষিণ এশিয়াতে শেখ হাসিনা হলেন আমাদের সবচেয়ে ‘টেস্টেড অ্যান্ড ট্রাস্টেড অ্যালাই’। এই বন্ধুত্ব পরীক্ষিত, আস্থার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। তাকে ছাড়া আমরা ঢাকার ক্ষমতায় অন্য কাউকে ভাবতেই পারি না!”

শেখ হাসিনা অত্যন্ত দক্ষ হাতে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামলাচ্ছেন বলেই এবার বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতকে একেবারেই মাথা ঘামাতে হচ্ছে না, এমনটাও মনে করছেন ওই বিজেপি নেতা।

‘যেভাবে তিনি বিরোধী জোটকেও সংলাপে ডেকে তাদের আস্থায় নিয়েছেন, নিজে অনেক বেশি অ্যাকোমোডেটিভ হয়ে বিএনপিকেও নির্বাচনে আসতে বাধ্য করেছেন— তাতে বলাই বাহুল্য, এবারের নির্বাচন অনেক বেশি অংশগ্রহণমূলক হতে যাচ্ছে। এই কৃতিত্বও পুরোপুরি শেখ হাসিনার বলেই আমরা মনে করি’, বলছিলেন তিনি।
বাংলাদেশে ২০১৪ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য চেহারা দিতে ভারতকে যেরকম সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গিয়েছিল, এবারে তার কোনও প্রয়োজনই হচ্ছে না শেখ হাসিনার দক্ষ ও উদার রাজনীতির কারণে— এমনটাই বিশ্বাস সাউথ ব্লকেরও।
কিন্তু কেন নির্বাচনে শেখ হাসিনার কোনও বিকল্প দেখতে চায় না ভারত?
নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভার একজন সিনিয়র সদস্য বলেন, ‘অনেকগুলো কারণে। প্রথমত গত দশ বছরে শেখ হাসিনার শাসন আমলে দুদেশের সম্পর্ক যে উচ্চতায় পৌঁছেছে, তা একসময় কল্পনাও করা যেতো না। উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলো যে আজ শান্ত, তারা দিল্লির সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসছে এর পেছনে শেখ হাসিনার অবদানও কম নয়।’
তিনি বলেন, ‘কানেক্টিভিটির ক্ষেত্রেও দুদেশের মধ্যে একটা নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটে গেছে। আগরতলা থেকে ঢাকা হয়ে বাস কলকাতায় আসছে, আমাদের পণ্যবাহী জাহাজ ঢুকে পড়ছে আশুগঞ্জ বন্দরে, দুদেশের মধ্যে রোজ বিভিন্ন রুটে ট্রেন চলছে, আমাদের কার্গো শিপ চট্টগ্রামে ভিড়তে যাচ্ছে— এটাই বা কে ভাবতে পেরেছিল?’
বিজেপির এই মন্ত্রী আরও বলেন, ‘তাপবিদ্যুৎ খাতে, রেল-সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে ও আরও নানা শিল্পে বাংলাদেশে ভারতের বিভিন্ন সংস্থার এখন শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগ। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদল হলে এই বিপুল লগ্নি ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। সুতরাং আমরা খামোখা কেনই বা ঢাকার ক্ষমতায় পরিবর্তন দেখতে চাইবো?’
কিন্তু শেখ হাসিনাকে বিজয়ী দেখতে চাইলেও ভারতের বিরুদ্ধে যাতে নির্বাচনে হস্তক্ষেপের কোনও অভিযোগ না ওঠে, সে ব্যাপারেও দিল্লি এবার অতিরিক্ত সতর্কতা দেখাচ্ছে।
ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী যেমন বলছেন, ‘হস্তক্ষেপ বলতে যদি বোঝায় ভোটে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করা, নির্বাচনি কারচুপি বা পেশিশক্তির সাহায্যে কোনও পছন্দের প্রার্থীকে জেতানোর চেষ্টা করা, তাহলে ভারত কোনোদিনই কোনও প্রতিবেশী দেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেনি, করবেও না।’
তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমাদের কোনও প্রতিবেশী দেশে আমরা পছন্দের কোনও দলকে যদি জয়ী দেখতে চাই, তার মধ্যে কিন্তু কোনও অন্যায় নেই। বিশ্বের সব দেশই চায় তাদের প্রতিবেশী দেশে বন্ধুত্বপূর্ণ সরকার আসুক, যাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো থাকবে, ব্যবসা-বাণিজ্যের উপযুক্ত পরিবেশ বজায় থাকবে।’ এই চাওয়াটা শতকরা একশ’ শতাংশ সঙ্গত বলেও মন্তব্য করেন সাবেক এই রাষ্ট্রদূত।
বাংলাদেশে এবারের নির্বাচনের ক্ষেত্রেও ভারতের সেই ‘চাওয়া’টা বহাল থাকবে বলেও তিনি নিশ্চিত।
বাংলাদেশের নির্বাচনে আর একটা যে বিষয়কে ভারত অত্যন্ত ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে সেটা হলো, এবারে ভারতবিরোধী কথাবার্তা প্রায় কোনও দলের মুখেই শোনা যাচ্ছে না।
দিল্লির থিংকট্যাংক বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো শ্রীরাধা দত্তের কথায়, ‘একসময় বাংলাদেশে বিরাট স্পর্শকাতর রাজনৈতিক ইস্যু ছিল ভারতকে ট্রানজিট দেওয়া। কিন্তু সেটা নিয়ে এখন আর কেউ মাথাই ঘামাচ্ছেন না। এমনকী না হওয়া তিস্তা চুক্তিও এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশে বড় কোনও নির্বাচনি ইস্যু হয়ে ওঠেনি।’
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ থেকে ভারত বিরোধিতার এজেন্ডা যে ধীরে ধীরে অন্তর্হিত হয়েছে, এর পেছনেও ভারতের পর্যবেক্ষকরা প্রধান কৃতিত্ব দেন শেখ হাসিনাকেই।
তারা বলছেন, অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে ভারতের সঙ্গে নানা বন্ধুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রমাণ করে দিয়েছেন, এতে আসলে দুদেশেরই লাভ এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত বিরোধিতার এজেন্ডা জিইয়ে রাখা পুরোপুরি অর্থহীন।