কালেরকন্ঠ: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৩০০ আসনের জন্য আওয়ামী লীগের প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে যেসব আসন জোটের শরিক দলগুলোকে দেওয়া হবে সেসব আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। মনোনীত অনেক প্রার্থীকে মৌখিকভাবে জানানো শুরু হয়েছে দলের শীর্ষপর্যায় থেকে। দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা অথবা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যাঁরা বাদ পড়ছেন, তাঁদেরও জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকায় থাকা ৫৪ জনের নাম কালের কণ্ঠ’র হাতে এসেছে। তাঁদের মধ্যে নতুন মুখ তিনজন।

এদিকে প্রার্থী মনোনয়নের বিষয়ে সব কিছু গুছিয়ে আনতে আলোচনা চলছে নির্বাচনী মিত্র দল জাতীয় পার্টি ও ‘আদর্শিক’ জোট ১৪ দলের শরিক দলগুলোর সঙ্গে। আজ সোমবার আসন বণ্টন চূড়ান্ত হতে পারে বলে আওয়ামী লীগের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।

জানা যায়, মিত্র ও জোটের শরিক দলগুলোকে সর্বোচ্চ ৭০টি আসন দেওয়া হতে পারে। মিত্রদের সঙ্গে আসন সমঝোতা চূড়ান্ত হওয়ার পর যেকোনো সময় ঘোষণা করা হবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালিকা।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল রবিবার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের প্রার্থী তালিকা একসঙ্গে প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রায় ঠিক করে ফেলা হয়েছে, এখন জোটের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘তারা (জাপা ও ১৪ দলের শরিক) যাদের মনোনয়ন দিতে চায় আমরা সেই তালিকা চেয়েছি। আগামীকালের (সোমবার) মধ্যে সেটা পেয়ে যাব। তারপর আনুষ্ঠানিকভাবে বসতে পারি।’

ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘জোটগতভাবে যে সমীকরণ দাঁড়াবে সেখান থেকে পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করা হবে। এটা করতে আরো চার-পাঁচ দিন সময় লাগবে।’ জোটের শরিক দলগুলোকে কত আসন দেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘৬৫-৭০টির মতো হবে। তবে এর মধ্যেও আলাপ-আলোচনা ও জরিপ অনুযায়ী জয়ী হওয়ার মতো প্রার্থী বেশি হলে তাদের আরো বেশি আসন দেওয়া হবে। আর কম থাকলে তাও বিবেচনা করা হবে।’

তবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলী ও সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য প্রার্থী চূড়ান্ত হয়ে গেছে। আজ সোমবার ঘোষণা করা হবে বলে তিনি জানান।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলী ও সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের আরেক সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দলীয় সিলেকশন সম্পন্ন হয়েছে। এগুলো চূড়ান্ত মনোনয়নের লক্ষ্যে পুনরায় দেখা হচ্ছে।’ রমেশ চন্দ্র সেন জানান, আওয়ামী লীগের ৩০০ আসনেই প্রার্থী চূড়ান্ত করা হচ্ছে। আজ ‘মহাজোট’ ও ১৪ দলের শরিকদের আসনগুলো চূড়ান্ত হবে। যেসব আসন শরিকরা পাবে, সেসব আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের প্রত্যাহার করা হবে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্রে জানা যায়, দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানকে ঢাকা-১ (দোহার-নবাবগঞ্জ) আসনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি এরই মধ্যে তাঁকে জানিয়েও দেওয়া হয়েছে দলের শীর্ষপর্যায় থেকে। ওই আসনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান। তবে ভোটযুদ্ধে জয়লাভ করেছিলেন জাতীয় পার্টির অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম।

সূত্র মতে, কুমিল্লা-৭ (চান্দিনা) আসনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে বর্তমান সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা অধ্যাপক আলী আশরাফকে। এ আসনের জন্য মনোনয়ন লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত। আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায় থেকে বিষয়টি দুজনকেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্রে জানা যায়, মাদারীপুর-৩ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে দলের দপ্তর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপকে। বর্তমানে এ আসনের সংসদ সদস্য হলেন দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। মনোনয়নের বিষয়টি দুজনকেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

নতুন মুখের তালিকায় যাঁরা আছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কিশোরগঞ্জ-২ আসনে সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ, মাদারীপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ ও মাগুরা-১ আসনে সাইফুজ্জামান শিখর।

এ ছাড়া প্রার্থী তালিকায় আছেন পঞ্চগড়-২ আসনে নুরুল ইসলাম সুজন, ঠাকুরগাঁও-১ আসনে রমেশ চন্দ্র সেন, ঠাকুরগাঁও-২ আসনে দবিরুল ইসলাম, দিনাজপুর-১ মনোরঞ্জন শীল গোপাল, দিনাজপুর-২ খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, দিনাজপুর-৩ ইকবালুর রহিম, দিনাজপুর-৪ এ এইচ মাহমুদ আলী, দিনাজপুর-৫ মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার, নীলফামারী-২ আসাদুজ্জামান নূর, লালমনিরহাট-১ মোতাহার হোসেন, রংপুর-৫ এ এইচ এন আশিকুর রহমান, গাইবান্ধা-২ মাহবুব আরা গিনি, জয়পুরহাট-২ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন, নওগাঁ-২ শহীদুজ্জামান সরকার, নওগাঁ-৬ ইস্রাফিল আলম, রাজশাহী-৩ আয়েন উদ্দিন, রাজশাহী-৬ শাহরিয়ার আলম, সিরাজগঞ্জ-১ মোহাম্মদ নাসিম, সিরাজগঞ্জ-২ হাবিবে মিল্লাত, সিরাজগঞ্জ-৬ হাসিবুর রহমান স্বপন, পাবনা-৪ শামসুর রহমান শরীফ ডিলু, বাগেরহাট-১ শেখ হেলাল উদ্দিন, খুলনা-৩ মন্নুজান সুফিয়ান, ভোলা-৪ আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, মৌলভীবাজার-৩ সায়েরা মহসিন, সুনামগঞ্জ-২ জয়া সেনগুপ্তা, কুমিল্লা-৭ অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ, কুমিল্লা-১০ আ হ ম মুস্তফা কামাল, মুন্সীগঞ্জ-২ সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি, গাজীপুর-৪ সিমিন হোসেন রিমি, গাজীপুর-৫ মেহের আফরোজ চুমকি, ঢাকা-২ কামরুল ইসলাম, ঢাকা-৭ হাজি মো. সেলিম, ঢাকা-১০ ফজলে নূর তাপস, ঢাকা-১১ এ কে এম রহমতুল্লাহ, ঢাকা-১৪ আসলামুল হক আসলাম, নরসিংদী-৩ সিরাজুল ইসলাম মোল্লা, নরসিংদী-৫ রাজি উদ্দিন আহমেদ রাজু, নারায়াণগঞ্জ-৪ শামীম ওসমান, মাদারীপুর-১ নূর আলম চৌধুরী লিটন, মেহেরপুর-১ ফরহাদ হোসেন দোদুল, ময়মনসিংহ-১০ ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল, নেত্রকোনা-২ আরিফ খান জয়, সিলেট-১ আবুল মাল আবদুল মুহিত, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলাম, চাঁদুপর-৩ ডা. দীপু মনি, চট্টগ্রাম-৬ এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী, চট্টগ্রাম-৭ ড. হাছান মাহমুদ, কক্সবাজার-৩ সাইমুম সরওয়ার কমল, খাগড়াছড়ি কুজেন্দ্র লাল চাকমা ও বান্দরবান বীর বাহাদুর উশৈ সিং।

আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে জানান, বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে বেশির ভাগই এবারও মনোনয়ন পাচ্ছেন। তবে তরুণ ও নারী প্রার্থী উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে।

আওয়ামী লীগের একাধিক প্রভাবশালী নেতা গতকাল জানান, কমপক্ষে ছয়টি সংস্থার রিপোর্ট শেষবারের মতো পর্যালোচনা করেছেন দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর বাইরে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও জরিপ চালিয়েছেন তিনি। সব পর্যবেক্ষণ করে ৩০০টি আসনে দলীয় মনোনয়ন তালিকা তৈরি করেছেন আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যরা।

৩০০ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশা করে আবেদন করেন চার হাজার ২৩ জন নেতা। গড়ে প্রতিটি আসনে ১২ জন মনোনয়ন প্রত্যাশা করেছেন। গত বুধবার গণভবনে তাঁদের অনানুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। সেখানে আসনপ্রতি এত মনোনয়নপ্রত্যাশী দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।

এদিকে জাতীয় পার্টি গত শনিবার আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়ে আসন বণ্টন ফয়সালা করার অনুরোধ জানায়। এরপর ওই রাতেই দলের সিনিয়র নেতাদের নিয়ে বসেন শেখ হাসিনা। সংশ্লিষ্ট নেতারা গতকাল জাপার চাওয়া আসনগুলো চিহ্নিত করে জরিপ রিপোর্ট মিলিয়ে দেখার কাজ শুরু করেছেন বলে জানা গেছে।