ইমাম খাইর, সিবিএন:
আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সারাদেশের মতো কক্সবাজার-৩ (সদর-রামু) আসনে বইছে ভোটের হাওয়া। শুরু হয়েছে প্রার্থীতা নিয়ে হিসেব-নিকেশ। এরই মধ্যে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়েছে।
এই আসনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের ছড়াছড়ি অবস্থা। মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন ২৭ জন। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। সবাই দলীয় প্রতীক ‘নৌকা’ পেতে আশাবাদি। তদবির চালাচ্ছে দলের হাইকমান্ড পর্যায়ে।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে সদর-রামুতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সাইমুম সরওয়ার কমল। তার সময়কালে কক্সবাজারকেন্দ্রিক সরকারের অনেক উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে গেছে। যা সরকারের পক্ষে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন কক্সবাজারবাসী।
৩ ভাইবোনের পারিবারিক দ্বন্দ্ব নিয়ে বেশ আলোচনা সমালোচনা থাকলেও সাইমুম সরওয়ার কমল সদর-রামু আসনে ফের নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। বর্তমান এমপি হিসেবে তাকে সহজে উড়িয়ে দেয়া যাবেনা।
গেলবার দলের মনোনয়ন পেলেও সামান্য ভুলে ভাগ্যে ‘এমপি’ পদটি জুটেনি কানিজ ফাতেমার। তিনি জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জাতীয় মহিলা সংস্থা কক্সবাজার জেলা শাখার চেয়ারম্যান। এবার মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করলেও চূড়ান্ত টিকিট পাওয়ার আশা ছাড়েননি প্রবীন এই নারী নেত্রী।
এমপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দলের মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম, কক্সবাজার পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আবছার, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদ, রামু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহেল সরওয়ার কাজল, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হক মুকুল, সাংগঠনিক সম্পাদক মাশেদুল হক রাশেদ, নাজনীন সরওয়ার কাবেরী, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা রাসেদুল ইসলাম, ছাত্র লীগের সাবেক সহ-সভাপতি প্রশান্ত ভূষণ বড়ুয়া, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইশতিয়াক আহমদ জয়, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মিজান সাঈদ, কউক সদস্য ইঞ্জিনিয়ার বদিউল আলম, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক কায়সারুল হক জুয়েল, জেলা পরিষদের সদস্য তাহমিনা হক লুনা, সদর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আবু তালেব, সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল করিম মাদু, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি এড.একরামুল হুদা, যুবলীগের নেতা ইফতেখার উদ্দীন পুতু, এড.নাসরিন সুলতানা লিনা, রামুর ফঁতেখারকুল ইউপি চেয়ারম্যান শামসুল আলম, খুনিয়াপালং ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল মাবুদ, রামুর সাবেক ভাইসচেয়ারম্যান মুসরাত জাহান মুন্নী, হিন্দু বৌদ্ধ খৃস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা সুপ্ত ভুষন বড়ুয়া, জয়া জাহান চৌধুরী, নীলিমা আক্তার চৌধুরী।
২৭ জন মনোনয়নপত্র নিলেও আলোচনায় রয়েছেন সাইমুম সরওয়ার কমল এমপি, সোহেল সরওয়ার কাজল, নাজনীন সরওয়ার কাবেরী, নুরুল আবছার, মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম, মাশেদুল হক রাশেদ।
হাল ছাড়েননি ইশতিয়াক আহমদ জয়। ছাত্র লীগের বিরাট শক্তির উপর ভর করে নিয়ে লবিং চালাচ্ছেন।
নৌকার মনোনয়ন না পেলেও কানিজ ফাতেমাকে সংরক্ষিত আসনে এমপি করার কথা শোনা যাচ্ছে।
কক্সবাজার-৩ (সদর-রামু) আসনটি জেলার প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় সব রাজনৈতিক দলের কাছেই সমান গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও নিদর্শন এখানে রয়েছে। রামুতে সেনানিবাস, বৌদ্ধমন্দিরসহ অনেক পুরাকীর্তি বিদ্যমান। দেশের পর্যটন শিল্পের সিংহভাগ রাজস্ব আসে এই আসন থেকে। এই আসনে যোগ্য প্রার্থী নির্বাচিত হলে পর্যটন শিল্প বিকাশ ও এলাকার সামগ্রিক উন্নয়নে বাস্তবসম্মত ভূমিকা পালন করতে পারবেন।
জেলা নির্বাচন অফিসের তথ্য মতে, এ আসনে মোট ভোটার তিন লাখ ৬২ হাজার ৬৩৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার এক লাখ ৮৬ হাজার ৯৯ জন ও মহিলা ভোটার এক লাখ ৭৬ হাজার ৫৩৭ জন। কক্সবাজার সদর উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১০টি ইউনিয়নে ভোটার রয়েছে দুই লাখ ২২ হাজার ৮৩৫ জন। রামু উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে ভোটার সংখ্যা এক লাখ ৩৯ হাজার ৮১০।
সদর-রামু আসনে জনগণের ভোটে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বিজয় অত্যন্ত কঠিন ভাবছে দলীয় হাই কমান্ড। এখানে বিএনপি থেকে লুৎফুর রহমান কাজল বিপুলভোটে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। শুধু শহর নয়, গ্রামে গঞ্জেও এখনো বেশ জনপ্রিয় তিনি। এই জনপ্রিয়তা ভেদ করে দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করতে ক্লিন ইমেজ ও গণমানুষের পছন্দের কাউকে মনোনয়ন দেয়ার কথা ভাবছে আওয়ামী লীগ।
১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে ২০০৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত টানা চারবার এ আসনে বিজয়ী হয়েছেন বিএনপির প্রার্থী। যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত হয়ে জামায়াতের শীর্ষ পদের নেতাদের মৃত্যুদণ্ড হওয়ার পরও বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইসচেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে তাদের সমর্থিত চেয়ারম্যান-মেম্বার রয়েছেন।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, সদর-রামু আসনে ঐক্যফ্রন্ট তথা ২০ দলীয় জোট ঘরানার প্রার্থীদের কোনভাবে অবহেলার সুযোগ নেই। সেটি মাথায় রেখে উপযুক্ত প্রার্থী সিলেকশনে একটু সময় নিচ্ছে আওয়ামী লীগ।
৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বাছাইয়ে খুবই গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে করছে তৃণমূল। না হলে আসনটি তাদের হারাতে হবে।
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় মহিলা সংস্থা কক্সবাজার জেলা শাখার চেয়ারম্যান নারীনেত্রী কানিজ ফাতেমা মোস্তাক দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার গুড বুকে রয়েছেন। তার মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল।
কানিজ ফাতেমা মোস্তাক জানান, শেখ হাসিনা হচ্ছেন তার আদর্শ। জননেত্রীর জন্যই তিনি রাজনীতির মাঠে রয়েছেন। দলের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করছেন। প্রধানমন্ত্রীর দেয়া জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব স্বচ্ছতার সঙ্গে পালন করছেন। তৃণমূল পর্যায়ে মহিলা আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করেছেন। এ ছাড়া তার স্বামী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ চৌধুরীও দীর্ঘদিন ধরে জনগণের জন্য কাজ করছেন। এসব বিবেচনায় দলীয় মনোনয়ন তার পক্ষে যাবে।
বর্তমান এমপি সাইমুম সরওয়ার কমল জানান, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার কক্সবাজারে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করছে। এর মধ্যে চারটি বড় বিদ্যুৎ প্রকল্প, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, রেললাইন প্রকল্প, মেরিন ড্রাইভ সড়ক, পর্যটনে ছয়টি মেগা প্রকল্প, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ অন্তত ২৫টি মেগা প্রকল্প রয়েছে। সড়ক, ব্রিজ, কালভার্টসহ অনেক উন্নয়ন প্রকল্পও বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তাই আগামী নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের জয় অনেকটা সহজ হবে। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে তার মনোনয়ন প্রয়োজন মনে করেন এমপি কমল।
কক্সবাজার-৩ আসনে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জয় লাভ করে। এর আগে নির্বাচনগুলোতে বার বার জয় পায় আওয়ামী লীগ। ক্লিন ইমেজ, সততা, দলে সর্বপর্যায়ে গ্রহনযোগ্যতার কারনে একাধিকবার জয় লাভ করেন মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী। বিষয়টি বিবেচনায় রেখে দলের নীতি নির্ধারকদের পরামর্শে প্রচারণায় নেমেছেন কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম। গত পৌরনির্বাচনে মেয়র মুজিবুর রহমানের বিশাল বিজয়ের ঐক্যবদ্ধতার পুজি করতে চায় আওয়ামী লীগ।
মোহাম্মদ নজিবুল ইসলাম কক্সবাজারের ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান। তিনি দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকার সম্পাদক, জাতির জনকের ঘনিষ্ট সহচর, প্রবীন আওয়ামী লীগ নেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ নুরুল ইসলামের মেঝ ছেলে। কক্সবাজারের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দীর্ঘ দুই দশক ধরে নেতৃত্বের পাশাপাশি নজিবুল ইসলাম সাংবাদিকতাও করেন।
এ আসন থেকে মনোনয়ন পেতে দীর্ঘদিন ধরে মাঠে রয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত মরহুম ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরীর সুযোগ্য কন্যা নাজনীন সরওয়ার কাবেরী। তিনি বর্তমান এমপি সাইমুম সরওয়ার কমলের ছোট বোন।
কাবেরী জানান, রাজনীতিতে রাতদিন বলতে কিছু জানেন না-বোঝেন না। যখন যেখানে প্রয়োজন, তখন সেখানে ছুটে যান। অধিকার বঞ্চিত মানুষের হয়ে কথা বলার জন্য তিনি প্রার্থী হয়েছেন। নারী নেতৃত্ব তৈরির কাজে বিশেষভাবে আগ্রহী বলেও জানান কাবেরী।
কমল ও কাবেরীরদের বড় ভাই রামু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সোহেল সরওয়ার কাজলও মনোনয়ন পেতে জোর তদবির করছেন। বিগত নির্বাচনগুলোতেও তিনি মনোনয়ন চেয়েছিলেন।
কাজল মনে করেন, দীর্ঘদিন তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে আছেন। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানও ছিলেন। মানুষের সুখে দুঃখে লেগে আছেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শই তার লালিত স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের সফল রূপায়নে একবার এমপি হওয়ার সুযোগ চান সোহেল সরওয়ার কাজল।
নৌকার চূড়ান্ত মনোনয়ন প্রত্যাশী মাশেদুল হক রাশেদ জানান, তার পিতা মরহুম একেএম মোজাম্মেল হক বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহচর ও কক্সবাজার জেলার জন্য আওয়ামী লীগের বটবৃক্ষ ছিলেন। আমরণ তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অটল ছিলেন। তারা পুরো পরিবারই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয়। নিজের চেয়ে তিনি দলের স্বার্থকে সবসময় প্রাধান্য দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে খুব কাছ থেকে চেনেন। সব বিবেচনায় অওয়ামী লীগের মনোনয়নের আশা করেন রাশেদ।
কক্সবাজার পৌরসভার ‘সফল চেয়ারম্যান’ হিসেবে পরিচিত নুরুল আবছার নৌকার বিজয় পেতে তাকে মনোনয়নের বিকল্প নেই মনে করেন।
ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে দাবী করা হয়, এ আসনে আওয়ামী-লীগের জয় পেতে হলে প্রার্থী পরিবর্তন ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। আর এইক্ষেত্রে জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ইশতিয়াক আহমেদ জয়-ই হতে পারে তুরুপের তাস।