ইমাম খাইর, সিবিএন:
বৃহস্পতিবার সকালে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ ঠিক থাকলেও হঠাৎ অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বুধবার দিবাগত রাত ১০ টা পর্যন্ত সেবিষয়ে স্পষ্ট জানাতে পারেনি সংশ্লিষ্ট দপ্তর।

সম্প্রতি ঢাকায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার তৃতীয় যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে চলতি মাসের ১৫ নভেম্বর প্রথম দফায় ৪৮৫ পরিবারের ২ হাজার দুইশ ৬০ জন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের সিদ্ধান্ত হয়। সেই লক্ষ্যে কাজও করে সরকার।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ক সিদ্ধান্ত বৃহস্পতিবার (১৫ নভেম্বর) সকালে হবে বলে জানিয়েছেন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো. আবুল কালাম। বুধবার রাতে আরআরআরসি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের একথা জানান তিনি।

তিনি বলেন, ‘ইউএনএইচসিআরের পক্ষ থেকে প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। আমরা তাদের মতামতগুলো ঢাকায় পাঠিয়েছি। পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে এখনও আমাদের কিছু বলা হয়নি। তবে আমরা প্রত্যাবাসনের যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। একইভাবে মিয়ানমারেরও এ বিষয়ে প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানতে পেরেছি। তবে কবে প্রত্যাবাসন হবে সে সিদ্ধান্ত বৃহস্পতিবার সকালে জানা যাবে।’

এর আগে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে বুধবার দুপুরে সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেছেন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার। কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ে দুপুর ৩টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত চলে এ বৈঠক। বৈঠকে গোয়েন্দা সংস্থা, সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক শেষে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার বলেন, ‘বৃহস্পতিবার দুপুরে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম প্রত্যাবাসন ঘাট দিয়ে তালিকাভুক্ত ৩০টি পরিবারের ১৫০ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এজন্য সকল ধরনের কার্যক্রম শেষ হয়েছে। এখন শুধুমাত্র ইউএনএইচসিআরের সম্মতি পেলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে। এ প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী।’

এদিকে, মিয়ানমার সফরের পর গত শনি ও রোববার জাতিসংঘের বিশেষ দূত ক্রিস্টিন এস বার্গনার এবং যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রিকা-এশিয়ার শরণার্থী ও প্রত্যাবাসন বিষয়ক উপসহকারী মন্ত্রী রিচার্ড অলব্রাইট কক্সবাজারে এসে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। তাদের মতে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য এখনো মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়নি। একই অভিমত রোহিঙ্গাবিষয়ক জেলা টাস্ক ফোর্সের সদস্যেরও।

রোহিঙ্গাবিষয়ক জেলা টাস্কফোর্স সদস্য দিদারুল আলম রাশেদ বলেন, ‘গতবছরও রোহিঙ্গাদের নেওয়ার কথা হলেও তারা আদৌ নেয়নি। এই যে আবার তাদের নেওয়ার কথা চলছে, আমার কাছে সেটাও সন্দেহজনক।’

এ অবস্থায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার কথা শুনে আতঙ্কে আছেন রোহিঙ্গারা। তাদের দাবি, নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা ও নিজ জমিতে ফেরার কোনো নিশ্চয়তা না দেওয়ায় দেশে ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনো সৃষ্টি হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রত্যাবাসন বিঘ্ন ঘটাতে অপতৎপরতা শুরু করেছে রোহিঙ্গারা। নানা দাবি তুলে রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। গত কয়েকদিন খোঁজ নিয়ে এমন কয়েকটি পরিবারের সন্ধান পাওয়া গেছে। আবার যারা (তালিকায় অন্তর্ভুক্ত) ক্যাম্পে এখনো আছে, তারা দাবি করছে তাদের শর্তগুলো পূরণ না হলে তারা মিয়ানমারে ফিরবে না। সোমবার টেকনাফের উনচিপ্রাং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে (ক্যাম্প-১) কথা হয় রোহিঙ্গা মো. আমিনের (৪৫) সাথে। তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা তিনিসহ আটজন।

তিনি দাবি করছেন, ওই ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা মাহাদু তাকে ডেকে নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করেছেন। এমনকি প্রত্যাবাসন তালিকায় তার পরিবারের নাম আছে বলে জানায় ওই রোহিঙ্গা নেতা।

মো. আমিন জানান, ‘আমাদেরকে কোন কিছু স্পষ্ট করে বলা হচ্ছে না। কিন্তু আমাদের কিছু নির্ধারিত দাবি আছে; সেগুলো পূরণ না হলে কোন অবস্থাতেই ফেরত যাবো না। কারণ দাবি পূরণ না হলে সেদেশে (মিয়ানমার) গিয়ে আবারও নির্যাতনের মুখে পড়তে হবে তাদের।’ শর্তগুলোর বিষয়ে তিনি জানান, তাদেরকে প্রথমত জাতীয়তা সনদ দিতে হবে। সেই দেশে নিরাপদভাবে বসবাসের নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে হবে। সেখানে গিয়ে ক্যাম্পে থাকবে না, তাদের নিজস্ব বসতভিটায় বসবাসের সুযোগ দিতে হবে। এবং তাদের উপর চালানো নির্যাতন-গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

একই ক্যাম্পের সি-ব্লকের বাসিন্দা মো. কাশেম (৪৫) ও বি-ব্লকের নুরুল হক জানান, কয়েকদিন আগে মাঝি (রোহিঙ্গা নেতা) মাহাদু তাদেরকে প্রত্যাবাসন তালিকায় নাম আছে বলে জানিয়েছে। কিন্তু এখন তারা ফেরত যেতে প্রস্তুত নয়। আগে তাদের দাবিগুলো সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে হবে।

সম্প্রতি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রতিনিধি দল উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আসলে, সেখানেও রোহিঙ্গারা তাদের দাবিগুলো মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিবের কাছে তুলে ধরেন। জানা গেছে, প্রত্যাবাসন তালিকায় সম্ভাব্য নাম আছে শুনে অনেক রোহিঙ্গা নাগরিক ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। তারা ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতাদের কাছে নানা ধরণের দাবি তুলে প্রত্যাবাসন বিঘ্ন ঘটাতে গা ঢাকা দিচ্ছে। জামতলী ক্যাম্পের এক রোহিঙ্গা নেতা জানান, প্রত্যাবাসন তালিকায় নাম উঠার খবর পেয়ে অনেক রোহিঙ্গা গা ঢাকা দিয়েছে এবং দিচ্ছে। কেউ এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে চলে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যাবাসন তালিকায় নাম থাকার খবর পেয়ে জামতলী ও উনচিপ্রাংয়ে তিনটি পরিবার ঘরে (আশ্রয় শিবির) তালা ঝুলিয়ে দিয়ে অন্যত্র চলে গেছে।

এদিকে, গত ৭ নভেম্বর মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আসিয়ান বিষয়ক বিভাগের পরিচালক সোয়ে হান রেডিও ফ্রি এশিয়াতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে এক সাক্ষাৎকার দেন। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, দুই পথে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হবে। প্রথম দফায় তারা (মিয়ানমার) ৩০০ জন রোহিঙ্গা গ্রহণ করতে প্রস্তুত। ২য় দফায় ২০০ জনকে নিয়ে যাবে। প্রসঙ্গত, গত বছর ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে সে দেশ থেকে প্রাণে বাচঁতে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।

গত বছরের ২৪ নভেম্বর রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি করে। চুক্তিতে দুই মাসের মাথায় প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনও রোহিঙ্গা রাখাইনে ফেরত যেতে পারেননি।

তবে, যে কোন মূল্যে হোক, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার দাবী কক্সবাজারের অধিকাংশ মানুষের। তাদের কারণে স্থানীয়দের জনজীবনে মারাত্নক প্রভাব পড়েছে। বেড়ে গেছে সব কিছুর দাম। বাড়েনি শুধু কক্সবাজাবাসীর আয় রোজগার।