বিশেষ প্রতিবেদক:
শীত মৌসুম চলে আসায় সাগর এখন শান্ত। এই সুযোগে সক্রিয় হয়ে উঠেছে সাগরপথে মানবপাচারকারী চক্রগুলো। মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড পৌঁছে দেওয়ার নাম করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। মূলত কক্সবাজারে অশ্রিত রোহিঙ্গাদের টার্গেট করেই জমে উঠেছে এই প্রতারণার খেলা।

মঙ্গলবার (৬ নভেম্বর) কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের উপকূল থেকে ১৪ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছে বিজিবি। মালয়েশিয়া নেওয়ার কথা বলে টাকা নেওয়া হয় তাদের কাছ থেকে। দু’দিন ধরে সাগরে এদিক-ওদিক ঘোরানোর পর ‘থাইল্যান্ডের তীরে পৌঁছেছি’ বলে টেকনাফের সৈকতে তাদের নামিয়ে দেয় মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা। ওই ১৪ জনের মধ্যে পাঁচ জন নারীও ছিল। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা করে নিয়েছে পাচারকারীরা। আরও একলাখ ৯০ হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা ছিল উদ্ধার পাওয়া এই রোহিঙ্গাদের।

বুধবার (৭ নভেম্বর) ফের সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় পাচারের চেষ্টাকালে ৩৩ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুকে আটক করেছে কোস্টগার্ড সদস্যরা। এসময় ছয় দালালকেও আটক করা হয়েছে। ৩৩ রোহিঙ্গার মধ্যে ১০জন নারী, ১৪ পুরুষ ও ৯ জন শিশু। তারা উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা বলে জানা গেছে।

পাচারের রুট পুরনো ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে সাগর পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পথে সহস্রাধিক বাংলাদেশি আটক হন। মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়া এই বাংলাদেশিদের অনেকেই ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় পথেই মারা যান। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সেসময় ওই ঘটনা আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সে সময় টেকনাফের কচুবনিয়া ঘাট স্থানীয়দের কাছে ‘মালয়েশিয়া এয়ারপোর্ট’ নামে ব্যাপক পরিচিতি পায়। এ ঘাট দিয়ে প্রায়ই মানবপাচার হতো তখন। এরপর মানবপাচার বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অভিযানে নামে এবং জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে। এতে করে সাগরপথে মানবপাচার শূন্যের কোটায় নেমে আসে। তবে বিজিবির ভাষ্য— দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর নতুন করে ফের কক্সবাজারের টেকনাফ উপকূল দিয়ে সাগরপথে মানবপাচারের চেষ্টা চালাচ্ছে দালালরা।

রোহিঙ্গারাই টার্গেট!
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক জমিলা খাতুন (৩৬) ও তার স্বামী নূর হোসেন (৫০) ২০১২ সালে তাদের ছয় মেয়ে সন্তানকে নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। প্রথমে তারা বান্দরবানে থাকতেন। ওই সময় সেখানকার পৌরসভার এক কর্মকর্তা তাদের দুই মেয়েকে নিজের বাসার গৃহকর্মী হিসেবে কাজ দেন। পরে ওই কর্মকর্তাই তাদের আরও ভালো চাকরির লোভ দেখিয়ে ঢাকায় নিয়ে যান। সেখানে নেওয়ার পর মেয়ে দুটিকে বলা হয়, তারা যদি এখানে থাকতে রাজি না হয়, তবে তাদের বাবা-মাসহ পুরো পরিবারকে অত্যাচার করা হবে। ওই সময় তাদের বয়স ছিল ১৩ ও ৯ বছর। এদিকে জমিলাকে বলা হয়,এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে তার মেয়েরা বাঁচবে না। এরপর পাঁচ বছর ওই দুই মেয়ের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ ছিল না মা-বাবার। এরইমধ্যে ২০১৪ সালে পরিবারটি বান্দরবান থেকে কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চলে আসে। এবছরের শুরুতে তার বড় মেয়ে ঢাকা থেকে পালিয়ে বান্দরবানে আসে। সেখানে সে জানতে পারে তার পরিবার এখন উখিয়া রয়েছে। পরবর্তীতে তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ঢাকা থেকে অন্য মেয়েকেও উদ্ধার করেন জমিলা। ক্যাম্পের ডেভেলপমেন্ট কমিটির অনুরোধে এ কাজে সহায়তা করে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)। জামিলা খাতুন ও তার স্বামী নূর হোসেন  এ ঘটনা জানান।

অন্যদিকে, টেকনাফের লেদা ক্যাম্প ও কুতুপালং ক্যাম্পের দুই নেতা জানান, গত দুই মাসে এই দুই ক্যাম্পের কমপক্ষে ১০ নারী ও শিশু নিখোঁজ হওয়ার খবর তারা পেয়েছেন। তবে তারা কোথায় পাচার হয়েছে তা জানা নেই তাদের।

এ প্রসঙ্গে টেকনাফ লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান আবদুল মোতালিব (৬৮) বলেন, ‘এ জাতীয় অনেক ঘটনার খবর আমাদের কানে আসেই না। পরিবারের সদস্যরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে নানাভাবে তাদের খোঁজার চেষ্টা করে।’ আর ক্যাম্প থেকে পরিবারহীন কেউ হঠাৎ হারিয়ে গেলে সেটাও তাৎক্ষণিকভাবে বোঝার কোনও উপায় নেই বলে জানিয়েছেন উখিয়া রোহিঙ্গা শিবিরের আরেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ফয়জু আরকানি।

গত বছরের আগস্টে রোহিঙ্গাদের ঢল নামার পর শিশু ও নারীদের পাচার এবং বিভিন্ন স্থানে তাদের ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করতে কক্সবাজারের ১৩টি পয়েন্টে তল্লাশি চৌকি বসানো হয়। এসব চেকপোস্টে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিজিবির সদস্যরা দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প

রোহিঙ্গা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) দেওয়া তথ্য মতে, ক্যাম্প থেকে গত একবছরে প্রায় ৫৮ হাজার রোহিঙ্গা পালাতে চেষ্টা করেছে। এর মধ্যে ৫৪ হাজার ৫৫৯ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে আটক হয়েছে। আরও তিন হাজার ২২১ জন রোহিঙ্গা দেশের অন্যান্য জেলা থেকে আটক হয়েছে । পরবর্তীতে তাদের সবাইকে শরণার্থী শিবিরে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

উখিয়া লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা শিবিরের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রফিক বলেন, ‘নির্যাতনের শিকার হয়ে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। কিন্তু এপারে আসার পরে তারা সবাই বেকার জীবন কাটাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আগামী ১৫ নভেম্বরে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে তারা সেদেশে যেতে প্রস্তুত নয়। অনেক রোহিঙ্গার আত্মীয়স্বজন মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে রয়েছে। প্রবাসী স্বজনের কাছে পৌঁছাতে রোহিঙ্গাদের অনেকেই সাগরপথ বেছে নিয়েছে। আবার অনেকে দালালের খপ্পরে পড়ে এসব কাজে জড়িয়ে পড়ছে।’

ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেড ক্রস (আইসিআরসি), ন্যাশনাল রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির রিস্টোরিং ফ্যামিলি লিংক (আরএফএল) কর্মসূচির পরিচালক ইমাম জাফর শিকদার বলেন, ‘নারী ও শিশু নিখোঁজের কিছু ঘটনা ঘটেছে। তবে এর সংখ্যা বেশি নয়।’

জড়িত রোহিঙ্গাই!
বিজিবির হাতে উদ্ধার মালয়েশিগামী ১৪ রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে এক রোহিঙ্গা মানবপাচারকারীর নাম উঠে এসেছে। তার নাম হলো— মোহাম্মদ আইয়ুব আলী। সে উখিয়া রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা। তার মতো উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরে আরও বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা মানবপাচারকারী সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই পাচারকারীরা হলো— হাফেজ ছলিম, আতাত উদ্দিন, মোহাম্মদ আলম, আবদুর করিম,হাফেজ মোহাম্মদ আইয়ুব, আবদুল করিম, মোহাম্মদ ইলিয়াছ, মোহাম্মদ কবির, আমির হোসেন, মোহাম্মদ ফয়েজ, নূর হোছন, মোহাম্মদ নাগু, নুরুল কবির, আবুল কালাম, লাল বেলাল, দিল মোহাম্মদ, মোহাম্মদ ফারুক, জোবাইর হোসেন, লালু মাঝি, আলী আকবর। মোহাম্মদ ছলিম, লম্বা কবিরা, মোহাম্মদ শাহর বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও এলাকায় তারা তৎপর রয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

বুধবার ৩৩ রোহিঙ্গাকে পাচারের চেষ্টার সময় যে ছয় দালালকে উদ্ধার করা হয়, তারা আবার স্থানীয়। ছয় দালাল হলো-  মহেশখালী গোড়কগাডার মৃত মোজাহের মিয়ার ছেলে আবদুর শুক্কুর মাঝি (৫৫), একই এলাকার তার ভাই আবদুর গফুর (৪৫), মৃত হোসেন আলীর ছেলে রফিকুল আলম (৩৫), মোহাম্মদ শরীফের ছেলে মোহাম্মদ শওকত (৩৮), মোহাম্মদ আবুল হাকিমের ছেলে নাছির উদ্দিন (৩৫) ও মৃত মোহাম্মদ দলিলুর রহমানের ছেলে মোহাম্মদ জুয়েল।
পাচারের সময় উদ্ধার পাওয়া রোহিঙ্গারা

এ প্রসঙ্গে উখিয়া থানার ওসি আবুল খায়ের বলেন, ‘পুলিশ কঠোর অবস্থানে থাকায় মানবপাচার বন্ধ রয়েছে। আবারও যাতে মানবপাচারকারীরা সক্রিয় হতে না পারে সে বিষয়ে পুলিশ সর্তক অবস্থানে রয়েছে। আমি দায়িত্ব পালনের সময়ে এপর্যন্ত ১০ জনের বেশি মানবপাচাকারীকে আটক করা হয়েছে। যেসব দালাল এখনও পলাতক রয়েছে, তাদের খুঁজে বের করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জানতে চাইলে টেকনাফ-২ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর শরীফুল ইসলাম জোমাদ্দার বলেন, ‘দালালের খপ্পরে পড়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাচ্ছিল, এমন ১৪ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছে করা হয়েছে। এদের মধ্যে পাঁচ জন নারী। মানবপাচারকারীরা আবারও সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে সীমান্তে বিজিবির সদস্যরা তৎপর রয়েছে। সাগরপথে মানবপাচার বন্ধ রয়েছে, এটি বন্ধ থাকবে। দালালদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

প্রসঙ্গত গত বছর ২৫ আগস্টের পর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এছাড়া আগে থেকেই বাংলাদেশে চার লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। সব মিলিয়ে উখিয়া-টেকনাফে অশ্রিত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এখন ১১ লাখের বেশি,যারা কর্মহীন ও অভাব অনটনের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। তাদের প্রলোভন দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নিতে মানবপাচারকারী চক্রগুলো আবারও সাগরপথে মালয়েশিয়ায় চেষ্টা চালাচ্ছে।