ডেস্ক নিউজ:
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রশংসা মিললেও এখন তাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে দৃশ্যত উভয়সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। গত বছরের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি সই করলেও এর আওতায় গত প্রায় এক বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। দুই দেশ আগামী ১৫ নভেম্বর থেকে প্রত্যাবাসন শুরুর ঘোষণা দিলেও স্বেচ্ছায়, নিরাপদ, সম্মানজনক ও টেকসই প্রত্যাবাসনের পরিবেশ এখনো রাখাইন রাজ্যে তৈরি হয়নি বলে দাবি করছে জাতিসংঘ, বিভিন্ন সংস্থা ও পশ্চিমা দেশগুলো। এমন পরিস্থিতিতে প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা নির্ঝঞ্ঝাটভাবে এগিয়ে নেওয়া যাবে কি না তা নিয়েও কূটনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে।

জানা গেছে, চীন ও ভারত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়েছে। চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে আজ বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ের বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও সংকট সমাধানে চীনা সমর্থন ও সহযোগিতা চাইবে বাংলাদেশ।

এদিকে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি মূল্যায়নে পূর্বনির্ধারিত সফরে গতকাল বুধবার রাতে ঢাকায় এসেছেন মিয়ানমারবিষয়ক জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত ক্রিস্টিন শ্রেনার বার্গনার। আগামীকাল শুক্রবার তাঁর কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনের কথা রয়েছে।

গত ৩০ অক্টোবর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্রসচিবরা এ মাসেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর ঘোষণা দেওয়ার পর প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিবেশ থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে জাতিসংঘ। এরপর গত রবিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে ইস্যু না বানাতে জাতিসংঘ ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত রোহিঙ্গারাই নেবে। এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ও মিয়ানমার যেমন নেবে না, তেমনি জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থাও (ইউএনএইচসিআর) নেবে না। অন্যদিকে ইউএনএইচসিআরের আঞ্চলিক প্রতিনিধি জেমস লিঞ্চ বলেন, ‘ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকেই হতে হবে।’

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরও ফিরে যাওয়ার ব্যাপারটি রোহিঙ্গাদের ইচ্ছানুযায়ী হওয়ার ওপর জোর দিয়েছে। নেদারল্যান্ডসের বৈদেশিক বাণিজ্য ও উন্নয়ন সহযোগিতাবিষয়ক মন্ত্রী সিগরিড কাগ তাঁর সদ্য সমাপ্ত বাংলাদেশ সফরেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য স্বেচ্ছায়, নিরাপদ, সম্মানজনক ও টেকসই—এই চারটি শর্তের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ার যুক্তি তুলে ধরে প্রত্যাবাসন পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছে নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডাব্লিউ) ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর পার্লামেন্ট সদস্যরা।

এরপর মিয়ানমারে মানবাধিকার পরিস্থিতিবিষয়ক জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার (বিশেষ দূত) মঙ্গলবার রাতে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা স্থগিত রাখার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, মিয়ানমার সরকার দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেয়নি। কয়েকটি বাড়ি নির্মাণ করে এ সমস্যার সমাধান হবে না। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো বরং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আশ্রয়প্রার্থীদের ফিরিয়ে না দেওয়া সংক্রান্ত নীতির লঙ্ঘন হতে পারে।

বাংলাদেশি কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলেছেন, প্রথম দফায় প্রত্যাবাসনের জন্য তৈরি করা দুই হাজার ২৬০ জনের তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের সম্মতির ভিত্তিতেই তাদের প্রত্যাবাসন করা হবে। তবে জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি দাবি করেন, প্রত্যাবাসনের তালিকায় থাকা ব্যক্তিরা অত্যন্ত দুশ্চিন্তার মধ্যে আছে বলে তাঁর কাছে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য রয়েছে।

বাংলাদেশি কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির পর প্রত্যাবাসন নাকি প্রত্যাবাসনের পাশাপাশি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি—এ নিয়ে জাতিসংঘ ও পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের কিছুটা মতপার্থক্য রয়েছে। চাপে পড়ে বা যে কোনো কারণেই হোক, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়া শুরু করতে চাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যেও অনেকে আছে যারা ফিরে যেতে চায়। এমন পরিস্থিতিতে প্রত্যাবাসন শুরু হতে পারে। এতে সার্বিক পরিস্থিতি ও চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যাবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, প্রত্যাবাসন শুরু না হলে পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠতে পারে। তখন রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে আরো অনাগ্রহী হয়ে উঠতে পারে। তিনি বলেন, জাতিসংঘ ও পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেও কোনো সমাধান দিতে পারছে না। মিয়ানমার রোহিঙ্গা ইস্যুতে যতটা নমনীয় হয়েছে তা চীন, ভারত ও জাপানের চাপে হয়েছে। এ ছাড়া আসিয়ান অঞ্চলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি হয়েছে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার পর আসিয়ান সভাপতি সিঙ্গাপুরও এ সংকটের দ্রুত সমাধান চাচ্ছে।

এখনই প্রত্যাবাসন উদ্যোগ নিয়ে জাতিসংঘের বিরোধিতা প্রশ্নে ওই কর্মকর্তা বলেন, এভাবে চললে এ সংকটের সমাধান হবে না। রোহিঙ্গারা কি এ দেশে সারা জীবন থাকবে? জাতিসংঘের এমন ভূমিকার কারণেই ফিলিস্তিন সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে রোহিঙ্গাদের প্রথম ব্যাচকে ফিরিয়ে নিতে রাখাইনেও প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। এ সপ্তাহের শুরুর দিকে রাখাইনের মংডু জেলায় সমন্বয় সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, প্রথম দফায় দিনে ১৫০ জন করে রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেওয়া হবে।