ডেস্ক নিউজ:
অস্থির সময়। বিশৃঙ্খলা সর্বত্র। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এক অনিশ্চিত গন্তব্যে বাংলাদেশ। লাখো শহীদের বিনিময়ে পাওয়া বাংলাদেশ যেন এক রাষ্ট্রহীন রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি।

স্বাধীনতার স্থপতির হত্যকাণ্ডের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ও রাজনীতির কাঠামো প্রায় ভেঙে পড়া অবস্থা। অস্থিরতা সেনা ব্যারাকেও। কখন যেন কী ঘটে! এমন অস্থিরতার মধ্যেই জাতির চার প্রাণপুরুষকে আটক করে কারাগারে পোরে ঘাতক মোশতাক আহমেদ।

উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় চার নেতার সঙ্গে কারাগারের অন্ধকারে রাজনৈতিক সমঝোতা করে নিজের ক্ষমতা স্থায়িত্ব করা। জাতীয় চার নেতাকে আটকের পর মোশতাক প্রচার করেছিল, ‘খুনিদের হাত থেকে বাঁচাতেই চার নেতাকে আটক করা হয়েছে।’

মোশতাকের সরকারে প্রতিনিধিত্ব করতে প্রতিনিয়ত প্রস্তাব রাখা হতো জাতীয় চার নেতার কাছে। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও বঙ্গবন্ধুর রক্তের সঙ্গে বেইমানি করেননি গণমানুষের ভালোবাসা নিয়ে বেড়ে ওঠা তারা। বুকের রক্ত দিয়েই বিশ্বাসঘাতকদের সেদিনের প্রস্তাবের জবাব দিয়েছিলেন।

আজ ৩ নভেম্বর। জেলহত্যা দিবস। মানব ইতিহাসে এমন কলঙ্কময় রক্তঝরা ঘটনা বিরল। এই দিনে মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে জাতীয় চার নেতা বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানকে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। কারাগারের মতো নিরাপদ জায়গায় এমন বর্বর হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে মেলানো ভার। সেদিন জাতির প্রাণপুরুষদের রক্তে রঞ্জিত হয় কারার অন্ধকার প্রকোষ্ঠ। সেদিন ডুকরে কেঁদে ওঠে কারার নীরবতা।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড ছিল একই ষড়যন্ত্রের অংশ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে ষড়যন্ত্রকারীরা জাতীয় চার নেতাকে তাদের সরকারে যোগদানের প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাদের জীবন দিতে হয়।

জেলহত্যার পরদিন তৎকালীন উপ-কারা মহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন) কাজী আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। তবে দীর্ঘ ২১ বছর এ বিচার প্রক্রিয়াকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে মামলাটি পুনরুজ্জীবিতের প্রক্রিয়া শুরু করে।

১৯৯৮ সালের ১৫ অক্টোবর ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. মতিউর রহমান মামলায় রায় দেন। রায়ে রিসালদার মোসলেম উদ্দিন (পলাতক), দফাদার মারফত আলী শাহ (পলাতক) ও এল ডি (দফাদার) আবুল হাসেম মৃধাকে (পলাতক) মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

এছাড়া বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত চার আসামি সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদসহ ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়।

সাবেক মন্ত্রী কে এম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ও তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে খালাস দেয়া হয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হলে হাইকোর্ট ২০০৮ সালে দেয়া রায়ে মোসলেমের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। তবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি মারফত আলী ও হাসেম মৃধাকে খালাস দেন। এছাড়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ফারুক, শাহরিয়ার রশিদ, বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকেও খালাস দেন হাইকোর্ট।

হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর আপিলের আবেদন (লিভ টু আপিল) করে সরকার। ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি আপিল বিভাগ সরকার পক্ষের আপিল আবেদন মঞ্জুর করে আদেশ দেন। আদেশে নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তবে হাইকোর্টের রায়ে খালাস পাওয়া দফাদার মারফত আলী শাহ ও এল ডি (দফাদার) আবুল হাসেম মৃধাকে অবিলম্বে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া হয়। আত্মসমর্পণ না করলে তাদের গ্রেফতার করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়।

২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল ওই আপিলের ওপর রায় দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। রায়ে জেলখানায় জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলায় বহিষ্কৃত দুই সেনা সদস্য দফাদার আবুল হাসেম মৃধা ও দফাদার মারফত আলী শাহকে নিম্ন আদালতের দেয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। একই সঙ্গে তাদের খালাস দেয়া সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় বাতিল ঘোষণা করা হয়। আবুল হাসেম ও মারফত আলী দু’জনই সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি।

দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সংগঠনগুলো বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জেল হত্যা দিবস উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন। বিবৃতিতে তারা শহীদ জাতীয় চার নেতার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান।

জেল হত্যা দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকাল ৬টায় বঙ্গবন্ধু ভবন ও দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ দেশের সর্বত্র শাখা কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা, কালো ব্যাজ ধারণ ও কালো পতাকা উত্তোলন। সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে জমায়েত এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ।

এছাড়া সকাল ৮টায় বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টের শহীদ ও জাতীয় নেতাদের কবরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, ফাতেহা পাঠ, মিলাদ মাহফিল ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া রাজশাহীতে জাতীয় নেতা শহীদ কামরুজ্জামানের কবরে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, ফাতেহা পাঠ, মিলাদ মাহফিল ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হবে। এদিন বিকাল ৩টায় কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।

দিবসটি উপলক্ষে সকাল সাড়ে ৯টায় পুরাতন জেলখানায় যেখানে চারনেতা নিহত হয়েছিলেন সেই কক্ষে এক মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। মিলাদ মাহফিলে সেদিনের ঘটনায় নিহতের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত থাকবেন।

এছাড়া জেলা হত্যা দিবস উপলক্ষে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের ধানমন্ডির বাসভবনে বাদ মাগরিব-শহীদ এম মনসুর আলীসহ জাতীয় চার নেতার রুহের মাগফেরাত কামনায় মিলাদ-মাহফিল ও দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের সকল জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন শাখা এবং সকল সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা-কর্মী-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ী এবং সর্বস্তরের জনগণকে দিবসটি যথাযথ মর্যাদা ও শোকাবহ পরিবেশে পালনের আহ্বান জানিয়েছেন।