সিবিএন ডেস্ক:
নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হয়েছে এক দশকেরও বেশি সময়। ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রয়োজন’- এমন উপলব্ধির পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকের আদেশ জারি করে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ইতোমধ্যে নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিধিমালা নিয়ে গেজেট প্রকাশ হয়েছে।

কিন্তু বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিতে পৃথক সচিবালয় এখনও গঠন করা সম্ভব হয়নি। আইনজ্ঞরা বলছেন, বিচার বিভাগ পৃথক হলেও এখনও আইন মন্ত্রণালয় ও সরকারের মুখাপেক্ষী হতে হয়। গতকাল শুক্রবার ছিল বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ দিবস। পৃথক করার পর ১১টি বছর কেটে গেলেও সম্ভব হয়নি বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা। পৃথক সচিবালয় আদৌ সম্ভব কিনা- তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।

আইনজীবীরা মনে করেন, বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পর দেশের ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ওপর বিচার বিভাগের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের পরিবর্তে বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচারকাজ পরিচালনা করছেন। এটা বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

জানা যায়, সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে পৃথক সচিবালয় গঠনের উদ্যোগ নেয়া হলেও সরকারের অনাগ্রহের কারণে এখনও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এদিকে, আইন মন্ত্রণালয় এখনও বিচার বিভাগের সচিবালয়ের দায়িত্ব পালন করছে। আলাদা সচিবালয় না হওয়ায় বিচারকদের পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন এখনও আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।

যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নিয়ে পদোন্নতি ও বদলি করছে আইন মন্ত্রণালয়।

উচ্চ আদালতের বিচারকদের বেতন-ভাতা বেড়েছে। নিম্ন আদালতের বিচারকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন-কাঠামোও হয়েছে। সচিবালয়ের জন্য সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে জায়গা নির্ধারণ করে এর ফলক উন্মোচনও হয়েছে, কিন্তু আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।

সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে আলাদা সচিবালয় কার্যক্রম উদ্বোধনের জন্য দিন নির্ধারণ ও সময় চেয়ে সুপ্রিম কোর্ট থেকে ২০১২ সালের ১৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চিঠি দেয়া হয়। ওই চিঠির জবাব পাননি সুপ্রিম কোর্ট। ফলে বিচার বিভাগের প্রশাসনিক কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা হয়নি।

২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর সরকার বিচারকদের চাকরিবিধির গেজেট প্রকাশ করে। মাসদার হোসেন মামলায় ১৯৯৯ সালের ২ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করতে ঐতিহাসিক এক রায় দেন। রায়ে জুডিশিয়াল সার্ভিসকে স্বতন্ত্র সার্ভিস ঘোষণা করা হয়।

নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করার লক্ষ্যে সরকারকে ১২ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নের আদেশ দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ওই ১২ দফার মধ্যে বেশকিছু দফা সরকার বাস্তবায়ন করে। কিন্তু এখনও বাস্তবায়ন হয়নি আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দফা।

বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ দিবস নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা জাগো নিউজের কাছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। সাবেক আইনমন্ত্রী ও সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘বিচার বিভাগ স্বাধীনতার জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা দরাকার। তবে, বদলি, পদোন্নতি এবং কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করাসহ অন্যান্য সব কাজ সুপ্রিম কোর্টের অধীনে হয়।’ তিনি মনে করেন, বিচার বিভাগ এখন স্বাধীন।

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘নির্বাহী বিভাগ কখনও চায় না বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন হোক। তারা বিচার বিভাগকে তাদের আয়ত্তে রেখে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। এই কারণেই কোনো রাজনৈতিক সরকারের আমলে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ সম্ভব হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘১/১১ সরকারের সময় মাসদার হোসেন মামলার আলোকে বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক হয়। কিন্তু ১১ বছর পার হওয়ার পরও যে উদ্দেশ্য নিয়ে বিচার বিভাগকে পৃথক করা হয়েছিল, তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি।’

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিমের মতে, ‘বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের জন্য যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ তার অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয়েছে। নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশের পর আর মাত্র একটি সিদ্ধান্ত বাকি রয়েছে। সেটি হলো বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয়।

তিনি বলেন, ‘এছাড়া বিচারকদের অন্য সবকিছুই বিচার বিভাগের হাতে রয়েছে। নির্বাহী বিভাগের হাতে কিছুই নেই।’

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার বদরোদ্দোজা বাদল জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের মূল চাওয়াটি ছিল আলাদা সচিবালয়। যেহেতু সেটি হয়নি তাই এখনও সবকিছুর জন্য সরকার ও আইন মন্ত্রণালয়ের মুখাপেক্ষী হতে হয়।’ তিনি দাবি করেন, ‘আইন মন্ত্রণালয় পুরোপুরিভাবে বিচার বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে।’

এ প্রসঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম খান বলেন, ‘বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের জন্য যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ তার মধ্যে শুধু বাকি রয়েছে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় গঠন। এছাড়া আমার মতে, বিচার বিভাগ পুরোপুরি স্বাধীন। কারণ দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলা আমরা স্বাধীনভাবে পরিচালনা করতে পারি।’

নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের যে ঐতিহাসিক ১২ দফা নির্দেশনা ছিল, তা হচ্ছে-

১. সংবিধানের ১৫২ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় সব বিভাগের কাজ সার্ভিস অব রিপাবলিকের ভেতরে পড়বে। তবে বিচার বিভাগের কাজ ও অবকাঠামোর সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের সিভিল সার্ভিসের অনেক ভিন্নতা রয়েছে। বিচার বিভাগকে অন্যান্য সিভিল সার্ভিসের সঙ্গে একত্রিত করা যাবে না।

২. বিচারিক (জুডিশিয়াল) ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করতে হবে এবং নির্বাহী বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচারিক কাজ করতে পারবেন না।

সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের পদ সৃষ্টি, নিয়োগ পদ্ধতি, নিয়োগ বদলিসহ অন্যান্য কাজের বিধিমালা প্রণয়ন করতে পারবেন।

৩. সিভিল সার্ভিস অর্ডার ১৯৮০ অনুযায়ী, সব ম্যাজিস্ট্রেটকে পিএসসির অধীনে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে একসঙ্গে নিয়োগ দেয়া হয়। একসঙ্গে নিয়োগ দেয়া সংবিধান পরিপন্থী।

৪. এই রায় পাওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন বিধিমালা এবং কমিশন গঠন করতে হবে। এই কমিশনে সুপ্রিম কোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে। এই কমিশনে নারী ও পুরুষ বলে কোনো বৈষম্য থাকবে না।

৫. সংবিধানের ১১৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি জুডিশিয়ারি সবার চাকরির বিধিমালা (নিয়োগ, পদায়ন, বদলি, পদোন্নতি ও ছুটিসহ অন্যান্য) প্রণয়ন করবেন।

৬. সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি জুডিশিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন বিধিমালা প্রণয়ন করবেন।

৭. সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের থাকবে।

৮. বিচার বিভাগ জাতীয় সংসদ বা নির্বাহী বিভাগের অধীনে থাকবে না এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটসহ সব বিচারক স্বাধীনভাবে কাজ করবেন।

৯. জুডিশিয়ারির (নিম্ন আদালত) বার্ষিক বাজেট প্রণয়নের ওপর নির্বাহী বিভাগের কোনো হাত থাকবে না। এই বাজেট সুপ্রিম কোর্ট প্রণয়ন ও বরাদ্দ করবে।

১০. জুডিশিয়াল সার্ভিসের সদস্যরা প্রশাসনিক আদালতের আওতাভুক্ত থাকবেন।

১১. এই রায় অনুযায়ী, বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের জন্য সংবিধানে কোনো সংশোধন করার প্রয়োজন নেই। তবে পৃথকীকরণ আরও অর্থবহ করতে যদি সংবিধানের সংশোধনের প্রয়োজন হয়, তবে তা করা যাবে।

১২. জুডিশিয়াল পে-কমিশন: জুডিশিয়াল পে-কমিশন জুডিশিয়ারির সদস্যদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে যতদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ না করবে, ততদিন পর্যন্ত বর্তমান অবকাঠামো অনুযায়ী তার সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন।