ডেস্ক নিউজ:

সংলাপএকাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপে বসছে নবগঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। তবে, প্রত্যাশা চাপা রেখেই এই সংলাপে যোগ দেবে জোটটি। সংলাপের আগেই খালেদা জিয়ার সাজা বৃদ্ধির রায়ের পর শাসক দলের সঙ্গে আলোচনার ফল নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন তৈরি হওয়ার কথা জানিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক দল বিএনপি। ফলে, সংলাপের কৌশল ও বিষয় নির্ধারণ করার অব্যাহত থাকলেও আলোচনায় কোনও ফল না এলে পরবর্তী রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ হবে বৃহস্পতিবারের পর।

ঐক্যফ্রন্ট ও জাতীয়তাবাদী ঘরানার বুদ্ধিজীবীরা মনে করছেন, একদিকে সংলাপ আয়োজন, অন্যদিকে খালেদা জিয়ার সাজাবৃদ্ধির বিষয়টি অপরিকল্পিত নয়। এরফলে দু’টি চাপ তৈরি হবে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের ওপর। একটি, ঐক্যফ্রন্টের সাতদফার প্রথম দফায় খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি থাকলেও বিএনপি চাইবে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে। বৃহস্পতিবার সংলাপেও তা বড় করে তোলার জন্য ঐক্যফ্রন্টের ওপর চাপ দেবে দলটি। দ্বিতীয়ত, সংলাপের পাশাপাশি এক মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা দেওয়ার কারণে বিএনপিতে একটি অংশ বিষয়টিকে ইস্যু করার সুযোগ পেয়েছে। এই অংশটি বরাবরই বলে এসেছে, খালেদা জিয়াকে ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না। এতে একাদশ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপিতে প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব দেখা যেতে পারে।

মঙ্গলবার (৩০ অক্টোবর) বিকাল থেকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রায় আড়াই ঘণ্টার বৈঠকেও সংলাপের বিষয়বস্তু, খালেদা জিয়ার মামলায় রায় নিয়ে আলোচনা করেন নেতারা। বৈঠকের প্রথম পর্যায়ে স্টিয়ারিং কমিটি বৈঠক করলেও পরে শীর্ষ কয়েকজন নেতা আলোচনা করেন। এই বৈঠকেও খালেদা জিয়ার মামলার প্রসঙ্গটি তোলা হয়।

বৈঠকসূত্র জানায়, মঙ্গলবার রায়ের পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ‘রায়ের পর সংলাপের ফল নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে’ এমন বক্তব্য দিলেও বৈঠকে এর কোনও প্রতিফলন ঘটেনি। আগে থেকে ফ্রন্টের অন্য দলগুলোর নেতারা এ নিয়ে টেনশনে থাকলেও বৈঠকে বিএনপির প্রতিনিধিরা পুরো শান্ত ছিলেন।

বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক নেতা জানান, বিএনপির চেয়ারপারসনের সাজা বৃদ্ধি পেলেও এর পেছনে অন্য উদ্দেশ্য আছে, সেটি তারা পরিষ্কার হয়েছে।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা মনে করেন, সংলাপের আগে খালেদা জিয়ার সাজাবৃদ্ধির রায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ফ্রন্টের নেতা, জেএসডি সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা তো বেগম জিয়ার রায়কে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে করি।’

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘খালেদা জিয়ার মামলা ও রায়ের বিষয়টি রাজনৈতিক, আমরা এটাকে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করবো। এ বিষয়টিকে আলোচনা করে আমরা সমঝোতার দিকে যাবো।’

বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলার রায় দেওয়া হচ্ছে তাকে নির্বাচনের বাইরে রাখার জন্য। মূল লক্ষ্যটা সংলাপ, কিন্তু সংলাপের ডাক দিয়ে খালেদা জিয়ার সাজাবৃদ্ধির বিষয়টি কেমন? এটা সহজ সমাধান হবে না। খালেদা জিয়াকে ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে কিনা, এটা তো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ কারণে দলের মধ্যে ভিন্নমত তৈরি হবে। একটি অংশ বলবে যাবে, আরেকটি অংশ বলবে যাবে না।’

এমাজউদ্দীন আহমদ আরও বলেন, ‘সংলাপের ডাক দিয়ে খালেদা জিয়াকে সাজা দেওয়ার মানে হচ্ছে, সরকার ওয়ান পার্টি সিসটেম সৃষ্টি করতে চায়। খালেদা জিয়া অত্যন্ত জনপ্রিয় নেত্রী, তাকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করায় অনেক সমস্যা আছে।’

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শেষ মুহূর্তে সরকার সংলাপে বসছে। তাদের বোধদয় হয়েছে সংলাপে বসতে। তারা যদি সংলাপ থেকে ইতিবাচক কিছু বের করতে চায়, তাহলে দেশবাসী ও রাজনীতির জন্য ভালো হবে। এই সংলাপ যদি লোক দেখানো না হয়, তাহলে সব মহলের জন্য শুভ হবে। সংলাপের মূল এজেন্ডা খালেদা জিয়া, সেটি হচ্ছে, তাকে তারা মুক্তি দেবে কিনা, সেটা সংলাপের অংশ হতে পারে। তার মামলাটি রাজনৈতিক। রাজনৈতিক সহনশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং আওয়ামী লীগের ভুল সংশোধনের জন্য সংলাপ সুযোগ হিসেবে আসছে।’

শামসুজ্জামান দুদু আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের চলমান সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে সংলাপে আলোচনা হবে, এটাই বিশ্বাস করি। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ঐক্যবদ্ধ আছে। তার সিদ্ধান্ত নিয়েই দল চলছে। তার সিদ্ধান্তেই নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপি সিদ্ধান্ত নেবে। দল বিভক্ত হওয়ার কোনও সুযোগ নেই।’

বৃহস্পতিবার (১ নভেম্বর) গণভবনে আয়োজিত আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপে খালেদা জিয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গেই উত্থাপন করা হবে বলে মনে করছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। ড. কামাল হোসেনকে দেওয়া হয়েছে মূল দায়িত্ব। তিনি বিষয়টি উপস্থাপন করবেন। টেবিলে কীভাবে আলোচনাটি উঠবে, সে বিষয়ে তিনি মুখ্য ভূমিকায় থাকবেন। তার সঙ্গে সহযোগিতার জন্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, আ স ম আবদুর রব, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার কথা বলবেন। এর বাইরে অন্য কাউকে আগ বাড়িয়ে কথা না বলার অনুরোধ করা হয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্য বলছেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিরোধী রাজনৈতিক জোটের সমঝোতা হবে, এমন সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। এরপর কিছু ঘটলে ঐতিহাসিক।

সংলাপে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত দফা ও ১১টি লক্ষ্য নিয়ে আলোচনা হবে। এক্ষেত্রে সাত দফা দাবির বিষয়টি মুখ্য থাকবে। সাত দফার প্রথম দফায় চারটি বিষয় রয়েছে। এগুলো হচ্ছে, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ বাতিল, সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন এবং খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তি। ফলে, আলোচনার প্রথম স্বাভাবিক শর্ত হিসেবে এক নম্বর দফাতেই সংলাপ জমে উঠবে, এমনটি মনে করছেন ফ্রন্টের নেতারা।

স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্য মনে করেন, সংলাপে ডাকার কারণ বিরোধী রাজনৈতিক জোট থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ফলে, রাজনৈতিক কার্টেসির অংশ হিসেবেই প্রধানমন্ত্রী সংলাপ ডেকেছেন।

বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, খালেদা জিয়ার জামিন না হলেও অন্তত তাকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার বিষয়টি উত্থাপন করা হতে পারে। সংলাপের আগে এ বিষয়ে সমস্ত আইনি দিকগুলো যাচাই-বাছাই করতে ইতোমধ্যে বিএনপির ল’ উইংয়ের কয়েকজন কাজে নেমে পড়েছেন।

স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার স্বভাবজাতভাবেই খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি আদালতের ওপর ও বিএনপির আইনজীবীদের দিকে ঠেলে দেবেন। এক্ষেত্রে কামাল হোসেন বিচার বিভাগের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি তুলে ধরবেন। বিশেষ করে দলীয়করণ, সাবেক প্রধান বিচারপতির প্রস্থানের বিষয়গুলোকে যুক্তি আকারে তুলে ধরা হবে।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা জানান, বুধবার ও বৃহস্পতিবার সংলাপের আগে ফ্রন্টের আরও বৈঠক হবে। বিএনপিও স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নিয়ে আলোচনা করে সংলাপের কৌশল ও আলোচনার বিষয়বস্তু এবং সাত দফা দাবির ওপর যৌক্তিক কারণ খুঁজে বের করবেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্টের সাত দফাকে কেন্দ্র করেই সংলাপ আয়োজন হচ্ছে। বিএনপিও চায় আলোচনায় এর প্রতিফলন ঘটবে।’