খালেদ হোসেন টাপু, রামু: 

রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রধান শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে বাঁকখালী নদীতে জাহাজ ভাসা উৎসব সম্পন্ন হয়েছে।  এ উৎসবকে ঘিরে বাঁকখালী নদীর দু’পাড়ে হাজারো নর-নারীর উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। নদীতে ভাসছে দৃষ্টিনন্দন কল্প জাহাজ। বাঁশ, বেত, কাঠ এবং রঙিন কাগজ দিয়ে অপূর্ব কারুকাজে তৈরী নদীতে ভাসমান এসব জাহাজে চলছে যেন বাঁধভাঙ্গা আনন্দ। বিশেষ করে শিশু-কিশোর ও যুবকদল নানা বাদ্য বাজিয়ে জাহাজে নাচছে, গাইছে। আবার কোন কোন জাহাজে চলছে বুদ্ধ কীর্তন- ‘বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘের নাম সবাই বলো রে, বুদ্ধের মতো এমন দয়াল আর নাইরে’।

বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে দুই দিন ব্যাপী উৎসবের শেষ দিনে সম্প্রীতির জাহাজ ভাসানোর আয়োজন করা হয়। বৃহস্পতিবার (২৫ অক্টোবর) এ আয়োজন উপলক্ষে বাঁকখালীর চরে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

জাহাজ ভাসা উৎসবের শুভ উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার উপ-সংঘরাজ ও একুশে পদকপ্রাপ্ত পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের।

রামু উত্তর মিঠাছড়ি বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ ভদন্ত করুনাশ্রী মহাথের’র সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় উপস্থিত ও বক্তব্য রাখেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মাহিদুর রহমান, জেলা পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসেন, কক্সবাজারের সহকারী পুলিশ সুপার (সদর-সার্কেল) আদিবুল ইসলাম, রামু উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ লুৎফুর রহমান, জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার মাখন চন্দ্র সুত্রধর, সহকারী কমিশনার বিধান কান্তি হাওলাদার, বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাষ্টের ভাইস চেয়ারম্যান সুপ্ত ভূষণ বড়–য়া, উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি চাই থোয়াইহ্লা চৌধুরী, রামু থানার ওসি মুহাম্মদ আবুল মনসুর, রামু থানার ওসি তদন্ত এসএম মিজানুর রহমান।

এতে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রবীর বড়–য়া, রামু উপজেলা বৌদ্ধ ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও পুরার্কীতি সংরক্ষণ পরিষদের প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু, বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাষ্টি এড. দিপকংর বড়–য়া পিন্টু, রামু উপজেলা বুড্ডিস্ট ফেডারেশনের সভাপতি কিশোর বড়–য়া, রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রাজু বড়–য়া, ইপসার ডেপুটি ডিরেক্টর খালেদা বেগম, কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অমরবিন্দু বড়–য়া অমল, আওয়ামীলীগ নেতা ও বৌদ্ধ নেতা মৃনাল বড়ুয়া, রামু উপজেলা বৌদ্ধ সমিতির সভাপতি স্বপন বড়–য়া, জেলা যুবলীগ নেতা পলক বড়–য়া আপ্পু, রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদের আহ্বায়ক রজত বড়–য়া রিকু, জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি রিটন বড়–য়া, রামু উপজেলা বৌদ্ধ ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও পুরার্কীতি সংরক্ষণ পরিষদের সাধারণ কেতন বড়–য়া, সাংবাদিক যথাক্রমে সুনীল বড়–য়া, খালেদ হোসেন টাপু ও অর্পন বড়–য়া প্রমুখ। সঞ্চালনায় ছিলেন রামু উপজেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বিপুল বড়–য়া আব্বু।

রামু উপজেলার বাঁকখালী নদীতে বৌদ্ধদের জাহাজ ভাসা উৎসবে এমনি অন্যরকম উচ্ছ্বাস থাকে প্রতিবছর। এবারের ধর্মীয় সেই উচ্ছ্বাসে যোগ দিয়েছিল সকল সম্প্রদায়ের মানুষ। প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে আয়োজিত ব্যতিক্রমধর্মী এই উৎসবে নানা বাদ্য বাজিয়ে নাচে-গানে আনন্দে মেতে ওঠে সবাই।

বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার সভাপতি, রামু সীমা বিহারের অধ্যক্ষ পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের জানান, আজ থেকে দুইশ’ বছর আগে মিয়ানমারে মুরহন ঘা নামক স্থানে একটি নদীতে মংরাজ ¤্রাজংব্রান প্রথম এ উৎসবেরর আয়োজন করেন। প্রবারণা পূর্ণিমার একসাথে মিলিত হবার জন্য এ আয়োজন চলতো। সেখান থেকে বাংলাদেশের রামুতে এ উৎসবের প্রচলন। প্রায় শতবছর ধরে রামুতে মহাসমারোহে এ উৎসব হয়ে আসছে।

রামু উপজেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বিপুল বড়–য়া আব্বু জানান, দেশে শুধু রামুতেই এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। জাহাজ ভাসানোকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ এক মাস রামুর ৭টি বৌদ্ধ পল্লীতে উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে এ উৎসব উদযাপিত হয়। রেঙ্গনী কারুকার্যে চূড়া, ময়ূর, হাঁস, সিংহসহ নানা জীবজন্তুর প্রতিকৃতির রূপ ফুটিয়ে তোলা হয় জাহাজে।

বাঁশ, বেত, কাঠ, রঙিন কাগজ দিয়ে অপূর্ব কারুকাজে তৈরী জাহাজে ঈগল, ময়ূর, ঘোড়াসহ বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ছয়-সাতটি নৌকাকে এক করে সেই নৌকার ভেলায় বসানো হয় এক একটি জাহাজ।

বৌদ্ধ নেতারা জানান, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সূত্র পাঠ শেষে দুপুর দুইটার দিকে জাহাজ ভাসানো উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নদীতে চলে এই আনন্দ আয়োজন। তারা আরো জানান, এ বছর রামু উপজেলার মেরংলোয়া কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহার, পূর্ব রাজারকুল, পূব মেরংলোয়া, দ্বীপ শ্রীকুল, হাজারীকুল, হাইটুপী, রাখাইন পাড়া বড় ক্যাং এলাকা থেকে মোট সাতটি কল্পজাহাজ নদীতে ভাসানো হয়।

ফানুস উত্তোলন ও সম্প্রীতির কল্পজাহাজ উৎসব উপলক্ষে ২দিনবৗাপী অনুষ্টান সূচীর মধ্যে ছিল বুধবার প্রথমদিন বুদ্ধপূজা, ধর্মীয় ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন, অষ্টশীল গ্রহণ, ধর্মদেশনা, দেশ ও বিশ^শান্তি কামনায় হাজার প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও সমবেত প্রার্থনা ও বৃহস্পতিবার ২য় দিন পবিত্র ত্রিপিটক পাঠ, জাহাজ ভাসা উৎসবের উদ্বোধন, আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণ।