লংকাউয়ি স্কাই ব্রীজে স্বপরিবারে লেখক

মালয়েশিয়ার লংকাউয়ি ভ্রমণ-৩


অধ্যাপক আকতার চৌধুরী


বিদেশে বসে আয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর খবর শুনে আমার লেখার ছন্দপতন ঘটে । মনে মনে যা ভেবে রেখেছিলাম তা আর লেখার উৎসাহও পাচ্ছিলাম না । পেছনে ফেলে এসেছি লংকাউয়ির স্কাই ক্যাব ও স্কাই ব্রীজ ভ্রমণের রোমাঞ্চকর অনুভূতি আর বাংলাদেশের বিশেষ করে কক্সবাজারের প্রবাসীদের বেদনার কাব্য । কিন্তু সময় বলছে আমাকে আরেক পর্বে পাড়ি দিতে হবে।তবু লিখে যেতে হবে তাদের কথা ।
১৫ অক্টোবর রাতে কুয়াহ এলাকার পেরিন্টিস মোটেলে ক্লান্তি আর অবসাদের ঘুম দিয়ে আমার ভোর হয় মালয় টাইম সকাল ১০টায় । তখন বাংলাদেশের ৮টা । পাশে স্ট্রিট ফুডের দোকান। দুরে কোথাও না গিয়ে বসে পড়লাম সকালের নাস্তার জন্য । রাইচ এর সাথে ওরা মিলিয়ে ডিম পোচ, চাটনি আর আমাদের দেশের ছোট মাছের মত শুটকি ফ্রাই এর একটা প্লেইট সামনে এনে দিল। কোন রকমে খেয়ে উঠে যাচ্ছিলাম। তখন একটু দুরে বসা একটা লোক কাছে এসে বলল-
ওমারে অঁনে আততার ভাই ন!(ওমাগো , আপনি আকতার ভাই না!)
অঁনে এড়ে ক্যা (আপনি এখানে কেন?)
আমিও তাকে দেখে বললাম – হা ভাই , এখানে বেড়াতে এসেছি।
বলল – আমি মনজুর , ঈদগাহ বাড়ী ।পাশের কার ওয়াসের সেন্টারটা আমার।
তার চেহারা আমার পরিচিত লাগছে।কোন একটা ঘটনা প্রসঙ্গে আমার সাথে পরিচয়।সেটাও জানালেন তিনি।
আমাকে দেখে তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না কি করবেন।
বদ্দা , ইয়ান হন,ওইয়ান হন । ইয়ান আনি দি – ইত্যাদি ইত্যাদি।
দু’জনে সমানতালে চাঁটগাইয়া বলে যাচ্ছি।

কুয়াহ এলাকায় ষ্ট্রিট ফুডের দোকানে প্রবাসীদের সাথে লেখক

প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি ,দুই চাঁটগাইয়া মিলিত হলে যদি শুদ্ধভাষায় কথা বলেন , তখন এটা খুবই গর্হিত কাজ।মনে মনে ভাববে , বেটা ফুটানি মারছে। সে সময় যদি বেলা বিস্কুট আর চা পেতাম তাহলে নির্ঘাত আমরা চায়ে চুবিয়ে খেতাম। এতে লজ্জার কিছু ছিল না। এটা চাটগাইয়াদের একটা অভ্যাস।কেন জানিনা এভাবে খাওয়াতে আমাদের একটা প্রশান্তিও আসে।যদিও আমরা বাইরের লোকজনের সামনে খাওয়া থেকে বিরত থাকি।
আমি তার আপ্যায়নে কিছুটা বিব্রত। এমনিতে খেতে ইচ্ছে করছিলনা , তার উপর জোরাজুরি।আবার না খেলেও বেচারা মনে কষ্ট পাবে।
দেখলাম ভদ্রলোক পান খাচ্ছে। অগত্যা বললাম ,এখানে পান পাওয়া যায় নাকি?
বললেন-ভাই নিজের পানের অভ্যাস তো । তাই সেন্টারের পেছনে পানের চাষ করেছি।এখানে পান খাওয়া নিষিদ্ধ । কোথাও পানের পিক ফেলতে দেখলে শাস্তি দেয় ।তাই চুরি করে পানের চাষ করেছি নিজের জন্য ।

-আপনি খাবেন, বলে দেয় দৌড় । কিছুক্ষণ পরে পান নিয়ে ফিরেও আসে।
খুব বেশী অভ্যাস না থাকলেও দেশী স্বাদ বলে একটা কথা আছে। তাই রুচি ফেরাতে পান খাওয়া শুরু করলাম।
মনে হচ্ছিল পান খেয়ে পেট ভরাই!

একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয় । লংকাউয়ির মালয়রা অত্যন্ত বিনয়ী ও সৎ।আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলে মনে হয়েছে ।
যতগুলো বাড়ী দেখেছি হালকা টুনকো দরজা জানালা ।সামান্য আঘাতেই ভেঙ্গে যাবে। আমাদের দেশে যেটা কখনো কল্পনা করা যায় না।
মালয় পরিবারগুলো পিতৃতান্ত্রিক হলেও মহিলারা সমানতালে কাজে কর্মে লেগে থাকেন।বাড়ীতে রান্না বান্না নিয়ে তারা তেমন পড়ে থাকেন না । যে যারমত কর্মস্তলে খেয়ে ফেলেন।কাজে বেরিয়ে যেতেও তারা পুরুষের উপর নির্ভরশীল নন। মহিলারা মোটর সাইকেল থেকে শুরু করে কার সহ সব ধরনের যানবাহন নিজে ড্রাইভ করে বেরিয়ে পড়েন। তবে কোন মালয় মহিলাকে হিজাব ছাড়া দেখিনি। কিন্তু পরনে টপস আর জিন্স পেন্টের পোষাকই তাদের পছন্দের।
আর বরফ ছাড়া কোন পানীয় তাদের সহজে পান করতে দেখা যায় না। হয়তো এটা ঋতুর কারণে হতেও পারে । এখানে ঋতু বলতে একটাই । প্রচন্ড রোদ আর বাগানে পানি দেয়ার মত প্রতিদিন কয়েকবার বৃষ্টি।
ঈদগাও এর মনজুর ভাই ইতোমধ্যে অনেককে খবর দিয়ে ফেলেছে আমার আগমন সংবাদ।যতই আমি চেপে যেতে চাই – তিনি ততই একে ওকে ভিডিও কল দিয়ে আমাকে ধরিয়ে দেন।আমিও ওনার মনের প্রশান্তির জন্য অগত্যা সবার সাথে দেশে বিদেশে ভিডিও কলে কথা বলে যাচ্ছি।

প্রবাসীদের সাথে লেখক

রাতে আমাদের হোটেলে আরো নিয়ে আসে কয়েকজনকে। তারাও কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকার ।তাদের মধ্যে কেউ কেউ সাগর পথে এখানে এসেছেন।কেউ কলিং এ এসেছেন।তারা সহজে কাজ কর্ম পান না ।পুলিশের ভয় সারাক্ষণ তাড়া করে। তবু কেউ কেউ প্রতিমাসে ৪০ থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত ইনকাম করেন। এ টাকা বৈধদের মাধ্যমে দেশে পাঠান।আর সে টাকা দেশের বাজেটে বিশাল ভূমিকা রাখে।

পেরিন্টিস মোটেলের মালিক করিম ভাই একটা দাবীও জানালেন । প্রয়োজনে আমি জায়গা দেব । লংকাউয়িতে দেশের একটা কনস্যুলেট অফিস দরকার। পেনাং এ আছে। যারা লংকাউয়িতে আছে তারা কেউ মালয়েশিয়ার অন্য জায়গায় যেতে পারে না । লংকাউয়িতে অফিস হলে অনেকে বৈধভাবে কাজ করতে পারত।

যারা মালয়েশিয়ায় আছেন তাদের একটাই দু:খ।দেশের নাগরিক হয়েও পাসপোর্ট পাচ্ছেন না । চট্টগ্রাম তথা কক্সবাজারে জন্ম হওয়াই যেন আজন্ম পাপ। পাসপোর্ট চাইতে গেলে কপালে জোটে – ‘তুমি রোহিঙ্গা’ । এ কারণেই হয়তো অনেক বাংলাদেশী বাধ্য হয়ে নিজেকে রোহিঙ্গা বানায় । যাদের ঠিকানা বাংলাদেশেও নাই মিয়ানমারেও নাই । তারা আরেক শরনার্থী, যাদের ঘরে শরনাথী পোষে নিজেরে অকূল পাথারে ভাসছে। তারা শুধূই অবৈধ , কিন্তু তাদের শ্রমের ঘাম ঝরানো টাকাটা দেশের জন্য বৈধ!