নুরুল আজিম নিহাদ:
মহেশখালী এবং কুতুবদিয়া উপকূলের বঙ্গোপসাগরে জেলেদের ত্রাস আনজু বাহিনী। এই বাহিনীর হাতে নিয়মিত ডাকাতি ও হতাহতের শিকার হতো জেলেরা। আনজু বাহিনীর অত্যাচারে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরা বন্ধ করে পেশা পরিবর্তন করেছে এমন জেলের সংখ্যা অগণিত।

আনজু বাহিনীর মত মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপকূলের ৬টি বাহিনীর ৪৩ জন সশস্ত্র জলদস্যু র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। এসময় তারা ৯৪ টি অস্ত্র ও ৭ হাজার ৬৩৭ রাউন্ড গোলাবারুদ জমা দেয়।

উপকূলে দাপিয়ে বেড়ানো ভয়ঙ্কর এই ছয় বাহিনী হলো- আনজু বাহিনী, রমিজ বাহিনী, কালাবদা বাহিনী, জালাল বাহিনী, আইয়ুব বাহিনী ও আলাউদ্দিন বাহিনী। এই ছয় বাহিনীর আদ্যোপান্ত তুলে ধরা হলো-

আনজু বাহিনী:
আনজু বাহিনীর প্রধান আনজু মিয়া (৩৩)। দীর্ঘ এক যুগ আগে দস্যুতায় জড়িয়ে পড়ে আনজু মিয়া। ১২/১৫ জন সন্ত্রাসী নিয়ে গড়ে তুলে নিজস্ব একটি জলদস্যু বাহিনী। নিজের নামে গড়ে তোলা এই আনজু বাহিনী উপকূলের জন্য ভয়ঙ্কর ত্রাস। আনজু বাহিনীর গোপন আস্তানা ছিল সোনাদিয়া দ্বীপের প্যারাবনে। সেখানে অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহ করতেন তিনি। সেখান থেকে সমস্ত অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতেন। বঙ্গোপসাগরে জেলে এবং স্থলে লবণচাষীরা তার কাছে জিম্মি ছিল।

দীর্ঘ এক যুগের এই জলদস্যু জীবনে আনজু মিয়ার বিরুদ্ধে ডাকাতিসহ বিভিন্ন আইনে ১২ টি মামলা হয়েছে। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের করা জলদস্যু তালিকায় তার নাম উঠে আসে। এরপর ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পৃথক দুই তালিকাতেও তার নাম শীর্ষ জলদস্যু হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

কিন্তু দীর্ঘদিনের দস্যু জীবন ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার চেষ্টা করে শীর্ষ জলদস্যু আনজু। তার দলের সদস্যদের নিয়ে সম্প্রতি কুতুবজোম ইউনিয়নের ঘটিভাঙা এলাকার প্যারাবনে একটি মাধ্যমে র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণের দাবি জানান আনজু।

পরে শনিবার (২০ অক্টোবর) দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র জমা দিয়ে ৯ জন সদস্যসহ আত্মসমর্পণ করেন। আনজু ছাড়া আত্মসমর্পণ করা তার দলের অন্য সদস্যরা হলেন- সুমন মিয়া (৩৮), মকছুদ মিয়া (৩২), মোনাফ মিয়া (২৮), মোবারক (২৭), মনজুর মিয়া (৩০), নুরুল মোস্তফা নাগু (৩০), ছৈয়দ হোসেন (৩০), নবাব মিয়া (২৯) ও ইমতিয়াজ উদ্দিন নকিব (৩১)। তারা সকলেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের তালিকাভুক্ত জলদস্যু। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আনজু বাহিনী ২৪ টি অস্ত্র এবং ৩৪৫ গোলাবারুদ জমা দেয়।

রমিজ বাহিনী:
কুতুবদিয়া উপকূলের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রমিজ বাহিনী। বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়া চ্যানেলে প্রতিদিন মাছ ধরার ট্রলার ডাকাতি করতো এই বাহিনী। এই বাহিনীর কারণে দ্বীপে চরম আতঙ্ক বিরাজ করতো।

রমিজ বাহিনীর প্রধান হলেন রমিজ উদ্দিন (৫৩)। তার বাড়ি কুতুবদিয়ার উত্তর ধুরুং ইউনিয়নের মিরাকাটা এলাকায়। তার বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা রয়েছে। রমিজ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত জলদস্যু।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে বাহিনী প্রধান রমিজ উদ্দিন তার বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড ছালেহ আহম্মেদ প্রকাশ ছইল্লা ডাকাত (৪৬) নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন। এসময় তারা ৮টি অস্ত্র ও ১২০ রাউন্ড গোলাবারুদ জমা দেয়।

কালাবদা বাহিনী:
মহেশখালীতে ভয়ঙ্কর ত্রাস কালাবদা বাহিনী। চিংড়ি ঘের দখল, লবণ মাঠ দখল, বাজারে আধিপত্য বিস্তার ছিল এই বাহিনীর মূল কাজ। দীর্ঘদিন ধরে এই বাহিনীর হাতে জিম্মি পুরো কালারমছড়াবাসী। কালাবদা বাহিনীর কারণে কালারমারছড়া এলাকায় অন্যকোন বাহিনী ভিড়তে পারতো না। খুন, ডাকাতিসহ বিভিন্ন আইনে একাধিক মামলা আছে কালাবদা বাহিনীর প্রধানের বিরুদ্ধে।

কালাবদা বাহিনীর প্রধান হলেন নুরুল আলম ওরফে কালাবদা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে অস্ত্র জমা দেওয়ার মাধ্যমে ৫ জন সদস্য নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন কালাবদা। এই বাহিনী জমা দেয় ২৩টি অস্ত্র ও ৩৩৩ রাউন্ড গোলাবারুদ। এরমধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্র এসএমজি (বেলজিয়াম) একটিও আছে।

নুরুল আলম ছাড়া কালাবদা বাহিনীর আত্মসমর্পণ করা সদস্যরা হলেন- রশিদ মিয়া, মোহাম্মদ আলী, আলমগীর প্রকাশ টুইন্না, মো. আবু জাফর ও মো. আলাউদ্দিন।

জালাল বাহিনী:
জালাল বাহিনী প্রায় ১০ বছর ধরে মহেশখালীর হোয়ানক ইউনিয়নে চিংড়ি চাষ, পানের বরজ, লবণ মাঠ, ধানি জমি দখলসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছেন। এই বাহিনী তার প্রতিপক্ষ বাহিনীর সাথে দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও সন্ত্রাসী দল ভারি করত। অত্যন্ত ধুরন্ধর এই বাহিনী প্রায় ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। র‌্যাব দীর্ঘ গোয়েন্দা নজরদারির পর গত ২০১৬ সালের ৯ জুন আটটি অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ জালাল বাহিনীর প্রধান জালাল উদ্দিনকে আটক করে। বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।

জালাল বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড মো. ঈসমাইল ১৪ জন সদস্য নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন। এসময় এই বাহিনী ২৯ টি অস্ত্র ও ৬ হাজার ৭৯৮ রাউন্ড গোলাবারুদ জমা দেয়।
জালাল বাহিনীর আত্মসমর্পণ করা সদস্যরা হলেন- মো. ঈসমাইল, মোস্তফা কামাল পারভেজ, ওসমান, আহমদ জামান, নুরুল আমিন, আবু তাহের, আব্দুল মান্নান (১), আব্দুল মান্নান (২), রাশেদ, লোকমান, জয়নাল আবেদিন, মেসা. শহিদুল্লাহ, বাদল, মাহাবুব আলম ও আতা উল্লাহ বাহারী।

আইয়ুব বাহিনী:
আইয়ুব বাহিনী হোয়ানকের আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী বাহিনী। এই বাহিনীর ৯ জন সদস্য ৯টি অস্ত্র ও ৩৭ রাউন্ড গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করেছে। আত্মসমর্পণ করা সদস্যরা হলেন- আব্দুল মান্নান কালু, মো. জসিম, রবিউল আলম, মো. রুবেল, আবু তাহের, মো. আনোয়ার, আনোয়ার পাশা, মো. ইউনুছ, মো. কামাল।

আলাউদ্দিন বাহিনী:
ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী আলাউদ্দিন একটি অস্ত্র ও চার রাউন্ড গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করেছেন।
এসময় উপস্থিত সকলকে দস্যু জীবনের গল্প শোনান দস্যু সম্রাট আনজু মিয়া। আনজু মিয়া বলেন, জলদস্যুতা করতে গিয়ে অনেক মায়ের বুক খালী করেছি, অনেক স্ত্রীর স্বামী কেড়ে নিয়েছি। কিন্তু এই জীবন আসল জীবন নয়। এই অভিশপ্ত জীবন থেকে ফিরতে সহযোগিতা করায় র‌্যাব এবং সরকারকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

এই দস্যু সম্রাট আরও বলেন, বঙ্গোপসাগরে জেলেরা আমাদের কাছে জিম্মি ছিল ঠিকই। কিন্তু আমরাও শান্তিতে ছিলাম না। পুলিশ, র‌্যাবের ভয়ে পরিবারের সাথে বাড়িতে থাকতে পারতাম না। পালিয়ে বেড়ানো এই জীবন খুবই ভয়ঙ্কর। তাই অন্য যারা (জলদস্যু) আছেন, তারাও দ্রুত আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুন। এই সরকার যে সুযোগ দিয়েছে, সেটি আর পাওয়া যাবে না। তাই সময় থাকতে আত্মসমর্পণ করুন।

জলদস্যুদের আত্মসমর্পণের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, যারা আত্মসমর্পন করেছে, তাদেরকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা হচ্ছে। আরও করা হবে।

একইসাথে মামলা (খুন এবং ধর্ষণ মামলা ছাড়া) গুলো থেকেও রেহায় পেতে সহযোগিতা করা হবে। তাই যারা এখনো আত্মসমর্পণ করেনি, তাদেরকে অনুরোধ করছি তোমরা দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আস। না আসলে ভয়ঙ্কর পরিণতি হবে।

র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ বলেন, যারা দস্যুতা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য আত্মসমর্পণ করেছে, তাদেরকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে। যাতে করে তারা কোনভাবে আর ওই ভুল জগতে ফিরে না যায়।