রহিম আব্দুর রহিম

২০০৪ খ্রিস্টাব্দের ২১ আগস্ট; সভ্যতার ইতিহাসে চরম অসভ্যতার রেকর্ড সৃষ্টি। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে আওয়ামীলীগ এর এক সন্ত্রাস বিরোধী সমাবেশে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকারের উলঙ্গ গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। ওই দিনের ঘটনায় ২৪ জন নিহত ও ৩০০ জন আহত হয়। ভয়াবহ ওই দিনের ঘটনায় শেখ হাসিনা গত ২০০৭ সালের ২২ নভেম্বর (মিথ্যা মামলায় কারান্তরীন শেখ হাসিনা) সাবজেলে বসে তৎকালীন সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি ফজলুল করিমের কাছে দেওয়া জবানবন্দীটি, গত ১১ অক্টোবর দৈনিক সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে হুবহু উপস্থাপন করছি। ‘আমার বয়স ৬১ বৎসর, আমি বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সভানেত্রী। অদ্য ২২-১১-২০০৭ খ্রিস্টাব্দ তারিখ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অধীনে শেরে-বাংলা নগরস্থ বিশেষ সাবজেলে আপনাকে (সিআইডি সহকারী পুলিশ সুপার ফজলুল করিমকে) জেনে এই জবানবন্দী প্রদান করছি যে, ২১ আগস্ট ২০০৪ খ্রিস্টাব্দের ব্রিটিশ হাইকমিশনের উপর গ্রেনেড হামলা এবং গোপালগঞ্জে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ এর উদ্যোগে মুক্তাঙ্গণে একটি প্রতিবাদ র‌্যালি করার জন্য কয়েক দিন পূর্বে অনুমতি চেয়ে কর্তৃপক্ষের বরাবর আবেদন করা হয়। কিন্তু ২০ আগস্ট ২০০৪ তারিখ সকাল পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ মুক্তাঙ্গণে র‌্যালি করার অনুমতি না দেওয়ায়, আমরা ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের সামনে র‌্যালি করার প্রস্তুতি নেই। পত্র-পত্রিকাতে সেভাবেই সংবাদ প্রকাশিত হয়। ২১ আগস্ট ২০০৪ ইং তারিখ বিকাল ৪ টায় আমি সুধাসদন থেকে বঙ্গবন্ধু এভিনিউর র‌্যালির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। আমার গাড়িবহর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে পৌঁছার পর আমি মঞ্চ হিসাবে ব্যবহৃত ট্রাকে উঠি। ট্রাকের অবস্থান ছিল আওয়ামীলীগ কার্যালয় থেকে আনুমানিক ১৫-২০ গজ পূর্ব দিকে। ট্রাকটি পূর্বমূখী অবস্থায় ছিল। ট্রাকের পেছনের দিকে রক্ষিত কাঠের ্েটবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পূর্ব দক্ষিন দিকে মুখ করে আমি কর্মী সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখি।’ আওয়ামীলীগ সভানেত্রী পুলিশের কাছে দেওয়া তাঁর জবানবন্দীতে বলেন, ‘বিকাল ৫টা ২২ বা ২৩ মিনিটের সময় আমার বক্তৃতা শেষ হয় এবং আমি ট্রাক থেকে নিচে নামার জন্য অগ্রসর হচ্ছিলাম। এই সময় ফটো সাংবাদিক গোর্কি (এস এম গোর্কি) আমাকে বলে সে ছবি নিতে পারে নাই। যখন আমি তাঁকে ছবি নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য একটু থামি ঠিক তখনি সম্ভবত দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে একটি বিস্ফোরনের শব্দ হয়। সমূহ বিপদ বুঝতে পেরে আমরা যারা ট্রাকের উপর ছিলাম, সবাই মাথা নিচু করে শুয়ে, বসে পড়ি। এর মধ্যে পরপর কয়েকটি বিস্ফোরণ ঘটে। ট্রাকে অবস্থানরত নেতৃবৃন্দ মানববর্ম তৈরি করে আমাকে রক্ষা করার জন্য প্রানান্ত চেষ্টা করে।’ শেখ হাসিনা পরবর্তী পরিস্থিতির বিবরণ দিয়ে জবানবন্দীতে বলেন, ‘কিছুক্ষণ পর বিস্ফোরণ একটু থামলে কর্মীরা আমাকে ট্রাক থেকে নামিয়ে আমার বুলেটপ্রুপ জিপ গাড়িতে তোলার চেষ্টা করে। আমি জিপের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় আবারও বিস্ফোরণ শুরু হয়। আমাকে টেনে ট্রাকে রক্ষীদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পুনরায় মানববর্ম তৈরী করে নেতাকর্মীরা আমাকে রক্ষা করার জন্য তৎপর হয়। এরপরে এক পর্যায়ে, আমাকে বুলেটপ্রুফ জিপে তোলা হয়। সন্ধ্যা আনুমানিক ৬টা সময়ে আমি সুধাসদনে পৌঁছাই। ওই দিন ঘটনাস্থল ত্যাগ করার সময় আমার জিপ যখন বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে আউটার স্টেডিয়ামের পশ্চিম দিকের রাস্তা দিয়ে জিরো পয়েন্টের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তখন পুলিশ টিয়ারশেল ব্যবহার করে ও শর্টগান থেকে গুলি করে আমাদের যাত্রাকে ব্যাহত করেছিল। আমি যখন গাড়িতে উঠি তখন কয়েকটি গুলির শব্দ শুনি, তবে কারা গুলি করে বা কোনদিক থেকে গুলি হচ্ছিল তা বুঝে উঠতে পারিনি। ঘটনার সময় এসবির প্রটেকশন টিমের সদস্যরা তাদের অস্ত্র থেকে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও ডিএমপির প্রটেকশন দল কোন ভূমিকা রাখে নাই। উপরন্তু, ডিএমপি পুলিশ সদস্যরা আহতদের সাহায্য না করে সাহায্যকারীদের লাঠিপেটা করেছে। এই ঘটনায় আমার বুলেটপ্রুপ গাড়িটি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।’ শেখ হাসিনা বলেন ‘সভা মঞ্চের ট্রাকে আমি ছাড়াও আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল, জিল্লুর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, আমির হোসেন আমু, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, কাজী জাফরুল্লাহ, শেখ সেলিম, মহিউদ্দিন খান আলমগীর, মোহাম্মদ হানিফ মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। পরে জানতে পারি সেগুলো ছিল গ্রেনেড বিস্ফোরণ। উক্ত গ্রেনেড বিস্ফোরণের ফলে মহিলা আওয়ামীলীগ সভানেত্রী আইভি রহমানসহ আমাদের দলের ২২ জন নেতাকর্মী নিহত হন এবং শতশত নেতা, কর্মী, সমর্থক আহত হয়। অনেকে দেশে-বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার পরও পঙ্গুত্ব বরণ করেন। এই ঘটনায় আমার শ্রবণশক্তি খোয়া যায়। বিদেশে চিকিৎসার পরও আমার ডান কানের শ্রবণশক্তি স্বাভাবিক হয় নাই। এই ঘটনায় মৃত ২২ জন ছাড়াও আরও ২ জনের অশনাক্ত লাশ ছিল।’ আওয়ামীলীগ সভানেত্রী তাঁর দেওয়া জবানবন্দীতে আরও বলেন, ‘সাধারণত এ ধরণের জনসভা বা র‌্যালি হলে সভামঞ্চের আশেপাশে, দালানের ছাদে এবং বিভিন্ন ফ্লোরে আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা পাহারায় থাকে। কিন্ত ওইদিন আমাদের স্বেচ্ছাসেবকদের ওই সকল দালানের ফ্লোরে বা ছাদে অবস্থান করতে দেওয়া হয় নাই। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে গ্রেনেড হামলার ঘটনার পর আওয়ামীলীগ থানায় মামলা করতে গেলে থানা মামলা না নিয়ে ওইদিন তৎকালীন সরকারের পুলিশ বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় একটি খোঁড়া মামলা দায়ের করেন।

মামলার এক বছর পর ২০০৫ খ্রিস্টাব্দের নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে জালাল উদ্দিন নামক এক নিরীহ, নিরপরাধ এক ব্যক্তিকে ‘জজ মিয়া’ নাটকের নায়ক বানিয়ে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। ২০০৮ সালের ১১ জুন আব্দুস সালাম পিন্টু, মুফতি হান্নান সহ ২২ জনকে আসামী করে অভিযোগ দাখিল করা হয়। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের ১২ আগস্ট অধিকতর তদন্তের জন্য নির্দেশ দেন আদালত। ওই দিনের হামলায় মোট আসামী করা হয় ৫২ জনকে। মামলার স্বাক্ষী ছিলেন ৫১১ জন, এর মধ্যে আদালতে স্বাক্ষী দেন ২২৫ জন। দীর্ঘ ১৪ বছর ১মাস ১৮ দিন পর গত ১০ অক্টোবর এই মামলার রায়ে ১৯ জনের ফাঁসি ১৮ জনের যাবজ্জীবন, বাকীদের বিভিন্ন মেয়াদে আদালত সাজা প্রদান করেন। এই মামলার রায়টি শুধু হত্যাকান্ডের বিচার হয়েছে তা নয়; । একটি বড় ধরণের মেসেজ অপরাধী যেই হোক না কেন তাকে সাজা পেতেই হবে। তবে কথা রয়েছে; এই মামলায় যদি একজন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সাজা হয়ে থাকে ওই মন্ত্রণালয়ের সেদিনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কিছু হলনা কেন? ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় আম জনতার ধারণা এবং বিএনপির প্রতিক্রিয়ায় মনে হয় ঘটনাটি একটি ঠুনকো বিষয়। যারা বলছেন এ রায় বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য বা বিএনপি নিশ্চিহ্ন করার রায়। হাস্যকর প্রতিক্রিয়া ! সেইদিনের ন্যাক্করজনক হামলাটির উদ্দেশ্য কি ছিল? উত্তর, সোজাসাপ্টা, আওয়ামীলীগকে নেতৃত্ব শূন্য এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘তিনি ও তাঁরা খুশিও নন, তবে বেজারও নয়’ তবে কোনটি ? এটা আদৌ যুক্তিসঙ্গত প্রতিক্রিয়া নয়। মজার বিষয় হল, এই রায়ের খবরকে কেন্দ্র করে গ্রামগঞ্জে, পাড়া মহল্লায় আওয়ামীলীগ বিরোধী দুর্জনেরা চুটিয়ে প্রচার চালাচ্ছে বিএনপিকে ভোট থেকে দুরে সরিয়ে রাখতেই নাকি এই রায়। ১৪ বছর আগে কি ঘটেছিল এই খবর আজকের কিশোররা জানেই না। সবচেয়ে বড় কথা ১৯-২০ বছরের তরুনরা ১৪ বছর আগে যাদের বয়স ৫-৬ ছিল তাঁদের তো মনে থাকারই কথা না। যে বয়সের তরুন-যুবকরা অন্যায়কে প্রচন্ডভাবে ঘৃণা করে, সত্য-সুন্দরকে গ্রহণ করে তাদের কাছে বিষয়টি স্বচ্ছ হয়নি। ওই দিন আসলে কি ঘটেছিল? আওয়ামীলীগ ও আওয়ামী শুভাকাঙ্খীরা রায়ের পরের দিন বা এ যাবৎ তরুন সমাজের মাঝে বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য কোন সমাবেশ, উঠুন বৈঠক, টেবিলটক করেছে কি না ? না কি আওয়ামী বিরোধীরা যা বলছে তাই ঠিক। কথায় বলে, ‘খাইলে জাত যায়না, কইলে জাত যায়’ মামলার রায় পরবর্তী বিষয়টি এমনই মনে হচ্ছে । মামলার রায় নিয়ে কোন মন্তব্য করার যোগ্যতা যেমন নেই, তেমনি সমালোচনাও করছি না। তবে একটি গল্প বারবার মনে পড়ছে, ‘দুনিয়াতে সকল অপকর্মের জন্য দায়ী একমাত্র শয়তান, এমন অভিযোগ বারবার উত্থাপিত হওয়ায় একদিন শয়তান সরাসরি খোদার সাথে স্বাক্ষাৎ করে বলল, হে- খোদা তোমার প্রিয় বান্দারা আমার বিরুদ্ধে কেন মিথ্যা অভিযোগ আনছে, খোদা বললেন, হে- শয়তান, তুমি প্রমাণ কর যে, তোমার কোন দোষ নেই। এমনটি শুনে শয়তান ফন্দি ফিকির শুরু করল, কি করা যায়? কুবুদ্ধি মিলে গেল, একদিন এই শয়তান একটি বাড়ির দরজায় সামান্য মিঠাই লাগিয়ে আসল। ওই দিন ওই বাড়ির মালিকের লাঠির আঘাতে তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু ঘটল। শয়তান এবার আনন্দে নাঁচতে নাঁচতে খোদার কাছে গিয়ে বলল, এই খুনের জন্য কে দায়ী? খোদা শয়তানকে বলল, ঘটনাটি শোনাও। শয়তান বলা শুরু করল, বাড়ির মালিকের পাতিল থেকে দুধ পড়ে যাওয়ায় সে তাঁর স্ত্রীর মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করেছে। তাতেই তাঁর স্ত্রী মারা গেছে। খোদা: দুধ কিভাবে পড়ল? শয়তান: বিড়াল লাফ দিয়েছিল, খোদা: বিড়াল কেন লাফ দিয়েছিল? শয়তান: ইঁদুর ধরতে, খোদা: ইঁদুর কেন গেল? শয়তান: টিকটিকি ধরতে, খোদা: টিকটিকি কেন গেল? শয়তান: পিঁপড়া ধরতে, খোদা: পিঁপড়া কেন গেল? শয়তান: মিঠাই খাইতে। এইবার খোদা শয়তানকে জিজ্ঞাস করল, দরজায় মিঠাই কে লাগিয়েছিল? শয়তান বলতে বাধ্য হল আমি লাগিয়েছি। এবার খোদা বললেন এই খুনের মিঠাই লাগানোর শয়তানির জন্য আমার প্রিয় বান্দারা তোমাকে দোষারোপ করে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে অখুশি না খুশি রাজনৈতিক বিষয় তবে এই মামলার মিঠাই লাগানো শয়তান যে, আড়ালেই থেকে গেল এই ক্ষোভ এখন আম-জনতার।

লেখক, সাংবাদিক, কলামিস্ট, নাট্যকার ও শিক্ষক, মোবাইল: ০১৭১৪-২৫৪০৬৬