ডেস্ক নিউজ:
বাচ্চু তার জীবনে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটাকে ভালোবেসেছে, সেটা গিটার। সে গিটার দিয়ে জীবনের কথাগুলো বলতে চেয়েছিল। গিটার দিয়ে হাসতে চেয়েছিল, গিটার দিয়ে কাঁদতে চেয়েছিল। কথাগুলো বলছিলেন ব্যান্ড দল সোলস’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আহমেদ নেওয়াজ।

আইয়ুব বাচ্চু সম্পর্কে বলতে গিয়ে অনেকটাই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন দেশের ব্যান্ড শিল্পের গোড়ার দিককার এ মানুষটি। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আজ হয়তো জাতি বাচ্চুকে চিনছে, কিন্তু আমরা চিনেছিলাম সেই তখনই। ১৯৮২ সালে প্রথম কথা হয় বাচ্চুর সঙ্গে। আমাদের (সোলস) একজন গিটারিস্টের দরকার হচ্ছিল। চুংকিং নামে একটি রেস্টুরেন্টে বসে বাচ্চুর সঙ্গে আমার সোলসে গিটার বাজানো নিয়ে চুক্তি হয়। সে এতটাই গিটার-পাগল ছিল, আমরা সবাই বিকেলের দুই-তিন ঘণ্টা প্র্যাকটিস করলেও, বাচ্চু রাত দুই-তিনটা পর্যন্ত প্র্যাকটিস করতো। এসব নিয়ে প্রায় তার ফ্যামেলিতে সমস্যা হতো। কিন্তু বাচ্চু গিটার ছাড়েনি।’

১৯৭৫ সালে চট্টগ্রামের মুসলিম বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় পরীক্ষায় ভালো ফল করায় ছেলে আইয়ুব বাচ্চুর হাতে তার বাবা একটি কালো গিটার কিনে দেন। বাবার দেয়া কালো রঙের সেই অ্যাকোস্টিক গিটারেই প্রথম তার আঙুলের টুংটাং ছোঁয়া পড়ে। ওই সময় একদিকে বিশ্বের অন্যতম সেরা গিটারবাদক জিমি হেনড্রিক্স, রিচি ব্রাকমোর, কার্লোস স্যানটানা, অন্যদিকে দেশের পপশিল্পী আজম খানের গিটারবাদক নয়ন মুন্সীর গিটারে পারদর্শিতা আইয়ুব বাচ্চুকে মুগ্ধ করে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন ওদের মতো তাকেও গিটারে পারদর্শী হতে হবে। তবে সময়টা তখন বৈরি ছিল। সরাসরি কারও শিষ্যত্ব না পেলেও চট্টগ্রামের রউফ চৌধুরী, বন্ধু নওশাদ ও সাজুর সহায়তায় তিনি গিটার বাজাতে শুরু করেন।

প্রথাগতভাবে অর্থাৎ স্বরলিপির মাধ্যমে আইয়ুব বাচ্চু গিটারের তালিম নেন চট্টগ্রামের প্রথম ব্যান্ডদল ‘স্পাইডারে’র প্রতিষ্ঠাতা জ্যাকব ডায়াসের কাছে। বাসা থেকে যখন বাবা বের করে দিতেন, তখন বাচ্চুকে শহরের লালখান বাজার এলাকায় নিজের বাসায় আশ্রয় দিতেন জ্যাকব।

সেই কথা জানাতে গিয়ে জ্যাকব জাগো নিউজকে বলেন, ‘আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন গিটার-পাগল একটা ছেলে। কিন্তু পরিবার বিষয়টি কখনো সহজভাবে মেনে নিত না। তার ফ্যামিলিটা ছিলো ব্যবসায়ী ও ‘কনজারভেটিভ’। খালাম্মা প্রায় আমাকে বাচ্চুকে গিটার বাজানো না শেখাতে অনুরোধ করতেন। বাচ্চুকে নিয়ে বিয়েবাড়ি, সার্কাস, যাত্রাপালা, মঞ্চনাটক সবখানেই গান করেছি। সে কারণে মাঝে মাঝে রাত হয়ে যেত, বাসায় ঢুকতে পারতো না বাচ্চু। তখন আর কী করা..আমার বাসায় নিয়ে আসতাম ওকে। পরের দিন হয়তো বাসায় গেলে গালাগাল খেত, কিন্তু গিটার ছাড়বে সে বিষয়টি তার মুখ দিয়ে কখনো বের করা যায়নি।’

সোলস’র আরেক প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সুব্রত বড়ুয়া রনি জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের করা ‘কলেজের করিডোরে’ গানটা মনে পড়ছে আজ। মনে পড়ছে তপন চৌধুরীর প্রথম একক অ্যালবামের কথা। অসম্ভব কাজ করেছিল আইয়ুব বাচ্চু। আসলে বাচ্চু সোলসে যোগ দেয়ার পর, আমাদের গানের ধরনটাই বদলে গেল।’

শুরুর দিকে গিটার নিয়ে পাগলামির অনেক কথাই বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমকে বলে গেছেন কিংবদন্তি আইয়ুব বাচ্চু। তিনি নিজেকে বলতেন ‘ভাড়া খাটা গিটারের ভাড়া খাটা প্রেমিক’। তার নিজের ভাষায়, ‘গান নয়, গিটার আমাকে ঘরছাড়া করেছিল। গিটারের জন্যই সঙ্গীতযুদ্ধে নেমেছিলাম। সত্তরের দশকে আমি ভাড়ায় গিটার বাজাতে যেতাম। গিটারটাও ভাড়া নিয়ে যেতাম। ওই সময় ডিসকো কোম্পানির একটি গিটার আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে ৩০ টাকা দিনপ্রতি ভাড়ায় গিয়ে ‘শো’ করতাম। ভাড়া হিসেবে ৩০ টাকা দেয়ার পর আরও ৫০ থেকে ৬০ টাকা রয়ে যেত। এটা দিয়েই দিন চালাতাম। এখন কিন্তু আমার নিজের ৪০টা দেশি-বিদেশি গিটার আছে। কিন্তু সেই ভাড়া খাটা গিটারের দিনগুলোর কথা আজও জীবন্ত হয়ে আছে আমার মনে।’

তবে জীবনে শেষ দিকেও তিনি তার বাবার প্রথম কিনে দেয়া গিটারের কথা মনে রেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর নামিদামি ব্র্যান্ডের ৪০টা গিটার আমার সংগ্রহে আছে। তারপরও আফসোস করি, বাবার কিনে দেয়া প্রথম গিটারটার জন্য। সেটা ১৯৭৪ সালের দিকে। তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। সেটা ছিল একটি অ্যাকোস্টিক গিটার। কে কবে সেই গিটার নিয়ে গেছে, তার কোনো হদিস পাইনি।’

গিটার-পাগল এ মানুষটাকে নিয়ে নিজের স্মৃতির কথা জানিয়ে জনপ্রিয় উপস্থাপক আবদুন নূর তুষার তার ফেসকুক টাইমলাইনে লিখেছেন, ‘একসাথে জাপান, ইতালি, দুবাই অনুষ্ঠান করতে গিয়েছি। জাপানে এক গিটারের দোকানে ঢুকতেই দোকানি আমাদের পাত্তা না দিয়ে অন্য কাস্টমারের সাথে কথা বলছিল। বাচ্চু ভাই বিনয়ের সাথে বললেন, মে আই প্লে দিস গিটার?

গিটারে বেজে উঠল জিমি হেনড্রিক্স, নফলার ব্রাদার্স আর সান্টানার সুর। তারপর গিটার আর থামে না। শেষে এরিক ক্ল্যাপটন। দোকানের বাইরে ভিড়। কয়েকশ’ লোক। বাচ্চু ভাই বাজিয়ে দিলেন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। গিটারের দোকানি বাচ্চু ভাইকে জড়িয়ে ধরে আর ছাড়ে না। দোতলায় নিয়ে তার দোকানের সব গিটার তাকে মেলে ধরে বলে একটা নিয়ে যাও। যে দাম খুশি সে দাম দাও। আমি খুশিতে চোখ ভিজিয়ে ফেলেছি।’

শুধু দেশে নয় উপমহাদেশের সর্বত্রই মায়ার জাল বিছিয়েছিলেন গিটার-পাগল মানুষটা। ভারতের জি নিউজ তাদের সংবাদে লিখেছে, ‘আইয়ুব বাচ্চুকে এই উপমহাদেশের ‘সেরা গিটারিস্ট’ বললে অত্যুক্তি করা হবে না বোধহয়। মূলত গিটারের প্রতি অসামান্য প্রেম আর অসম্ভব দখলই তাকে রক সঙ্গীতের জগতে টেনে নিয়ে আসে।’

গিটার নিয়ে যার এত পাগলামী সেই মানুষটা শেষ জীবনে এসে তার প্রাণের চেয়ে প্রিয় গিটারগুলো তরুণদের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন। ফেসবুকে দেয়া একটি স্ট্যাটাসের মাধ্যমে আইয়ুব বাচ্চু তার মনের কথাগুলো তুলে ধরেন। আইয়ুব বাচ্চু লিখেছিলেন, ‘আমার ভীষণ ইচ্ছে ছিল আমার গিটারগুলো নিয়ে গিটার বাজিয়েদের সঙ্গে নিয়ে দেশব্যাপী একটি গিটার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান করার। যেখানে এই গিটারগুলো বাজিয়ে বিজয়ীরা জিতে নেবে আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় একেকটি গিটার। কিন্তু বেশ কিছু দিন চেষ্টা করার পরও যখন কোনো পৃষ্ঠপোষকই পেলাম না যাতে গিটারগুলো তাদের মেধার মূল্যায়ন স্বরুপ তরুণদের হাতে তুলে দিতে পারবো, তারা প্রাণ উজাড় করে গিটার বাজাবে আর আমরা আনন্দের সঙ্গে শুনবো, দেখবো এবং উৎসাহ দেবো; যাতে করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যেন এটা একটা নতুন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। কিন্তু হয়ে ওঠেনি আমার স্বপ্নের বাস্তবায়ন! কারণ হয়তো বা আমার স্বপ্নটা একটু বেশিই বড়ই ছিল গিটার নিয়ে!

তাইতো তিনি গেয়েছিলেন, ‘এই রুপালি গিটার ফেলে/একদিন চলে যাব দূরে, বহুদূরে/সেদিন চোখের অশ্রু তুমি রেখো/গোপন করে….’