ডেস্ক নিউজ:
আইয়ুব বাচ্চু, ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কিংবদন্তি এই সঙ্গীতশিল্পী। দেশের ব্যান্ড সঙ্গীতকে পথ দেখানো দুনিয়া কাঁপানো চট্টগ্রামের এই ছেলেটি আর নেই। বৃহস্পতিবার (১৮ অক্টোবর) সকালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বিদায় নিয়েছেন তিনি।

দেশসেরা ব্যান্ড দলগুলোর বেশিরভাগই জন্ম ও বেড়ে ওঠা বন্দর নগরী চট্টগ্রামে। সেই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা পর বাংলাদেশে ব্যান্ড সঙ্গীত যেসব মানুষের হাত ধরে জনপ্রিয় হয়েছে তাদের অন্যতম আইয়ুব বাচ্চু। চট্টগ্রামের সরকারি মুসলিম বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পথ চলা শুরু করা এই কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী চিরদিনের মত থেমে গেলেন রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে যাওয়ার পথে।

স্বাধীনতার ঠিক পরের বছর ১৯৭২ সালে চট্টগ্রামের কিছু গানপাগল তরুণ সাজিদ উল আলম, লুলু, নেওয়াজ, রনি বড়ুয়া ও তাজুল মিলে বিদেশি গানের দলের অনুকরণে ‘সোলস’ নামে গানের দল গঠন করেন। সে সময় ‘সোলস’ শুধু চট্টগ্রাম দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। এর মধ্যে ১৯৭৮ সালে ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডের মাধ্যমে সঙ্গীতজগতে প্রবেশ করেন আইয়ুব বাচ্চু। পরে ১৯৭৮ শেষ দিকে ‘সোলস’-এ যোগ দেন বাংলা ব্যান্ডের ‘ক্ষ্যাপা’ তরুণ হিসেবে পরিচিতি পেতে যাওয়া আইয়ুব বাচ্চু।

শুরু হয় বাংলার সর্বকালের সেরা একটি ব্যান্ড দলের যাত্রা, যেখান থেকে বাংলা আধুনিক ও ব্যান্ড সঙ্গীতের আকাশে সমহিমায় ঠাঁই করে নিয়েছে একটি একটি নক্ষত্র। সেই তরুণদের একজন আইয়ুব বাচ্চু। তিনি একাধারে ছিলেন ব্যান্ডের গিটারিস্ট, ভোকাল, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীতশিল্পী।

১৯৮০ সালে বের হয় ‘সোলস’-এর প্রথম অ্যালবাম ‘সুপার সোলস’। বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম কোনো ব্যান্ড অ্যালবাম এটি। ওই অ্যালবামে আইয়ুব বাচ্চুর অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। এরপর থেকেই তিনি সুরকার হিসেবে কাজ শুরু করেন।

১৯৮২ সালের দিকে নকীব খান, পীলু খান ও কুমার বিশ্বজিৎ ব্যান্ড ছেড়ে দিলেও ‘সোলস’-এর ভোকাল হিসেবে থেকে যান আইয়ুব বাচ্চু। এরপর ১৯৮০ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত একটানা সোলস ব্যান্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি।

jagonews

১৯৮৬ সালে আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম অ্যালবাম প্রকাশিত হলেও সফলতা পান ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত তার দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ‘ময়না’ দিয়ে। সোলসের হয়ে ব্যান্ড সঙ্গীতে নাম তৈরি করা আইয়ুব বাচ্চু ১৯৮৯ সালে নিজের স্টাইলে গাইবেন -এ সংকল্পে সোলস ত্যাগ করেন।

১৯৯০ সালে আইয়ুব বাচ্চু প্রতিষ্ঠা করেন নিজের ব্যান্ড দল ‘ইয়োলো রিভার ব্যান্ড’। কিন্তু বিদেশের এক প্রোগ্রামে গিয়ে দেখেন ভুল করে তার দলের নাম লেখা হয়েছে ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’। নামটি তার ভালো লেগে যায় এবং নিজ দলেন নাম বদলে রাখেন ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’। পরে জানা যায়, ওই নামে অস্ট্রেলিয়ান একটি ব্যান্ড আছে। ফলে আবারও নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘লাভ রান্স ব্লাইন্ড’ যা ‘এলআরবি’ নামেই পরিচিত।

১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল নিজ স্টাইলে গান গাওয়ার সংকল্প নিয়ে আইয়ুব বাচ্চু ‘এলআরবি’ ব্যান্ড গঠন করে। এরপর থেকেই সারা দুনিয়ায় ঝড় তুলতে শুরু করে এলআরবির হার্ড রক, ব্লুজ রক, সাইকাডেলিক রক গানগুলো। ব্যান্ড গঠনের এক বছর যেতে না যেতেই প্রথম অ্যালবামের জন্য ২২টি গান রেডি করে এলআরবি।

এলআরবির প্রথম ব্যান্ড অ্যালবাম ‘এলআরবি’ প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। এটি প্রথম দ্বৈত অ্যালবাম। এই অ্যালবামের ‘শেষ চিঠি কেমন এমন চিঠি’, ‘ঘুম ভাঙ্গা শহরে’, ‘হকার’ গানগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ব্যান্ড অ্যালবাম ‘সুখ’ এবং ‘তবুও’ বের হয়।

jagonews

১৯৯৫ সালে প্রকাশ হয় আইয়ুব বাচ্চুর সর্বকালের সেরা একক অ্যালবাম ‘কষ্ট’। এ অ্যালবামের ‘কষ্ট কাকে বলে’, ‘কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘অবাক হৃদয়’, ও ‘আমিও মানুষ’ গানগুলো তুমুল জনপ্রিতা পায়।

শেষ জীবনে চট্টগ্রামে ছেলেটি চট্টগ্রামের জন্য কিছু একটা করতে চেয়েছিলেন। চট্টগ্রামের তরুণ শিল্পী এবং ব্যান্ড সঙ্গীতে আগ্রহীদের জন্য ‘এবি লাউঞ্জ’ নামে নতুন একটি প্লাটফর্ম তৈরির কাজ শুরু করেন।

গত ২৪ আগস্ট আইয়ুব বাচ্চু বলেছিলেন, ‘আমি চট্টগ্রামের সন্তান। তাই চট্টগ্রামের জন্য আমি কিছু করে যেতে চাই। আমি সারাজীবন গাইতে পারব না। কিন্তু আমি চাই চট্টগ্রাম থেকে আমার মতো আরও কেউ বের হোক। চট্টগ্রামের উদীয়মান শিল্পীদের জন্য আমি একটা প্লাটফর্ম তৈরি করে দিয়ে যেতে চাই। চট্টগ্রামে ‘এবি লাউঞ্জ’ হবে ব্যান্ড সঙ্গীত এবং উদীয়মান ব্যান্ড শিল্পীদের জন্য নতুন একটি সম্ভাবনার দ্বার।’

২০১৭ সালের ২০ মে গিটার শো ‘নাও অ্যান্ড দেন’ এ অংশ নিয়ে আইয়ু্ব বাচ্চু বলেছিলেন, ‘চট্টগ্রামের অলিতেগলিতে রাতের পর রাত আমি গিটার হাতে বেড়িয়েছি। কাঁধে গিটার নিয়ে বিয়ে বাড়িতে হাজির হয়েছি, গিটার বাজিয়েছি। চট্টগ্রাম আমার নাড়ি পোতা শহর। এই শহরে আমার মা ঘুমিয়ে আছেন। এই শহরেই আমি আবারও ফিরে আসবো।’

সত্যিই এই কিংবদন্তি তার শহরে আবারও ফিরে যাবেন, তবে নিথর দেহে। শুক্রবার জুমার নামাজের পর হাইকোর্ট সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে প্রথম নামাজে জানাজা শেষে জনপ্রিয় শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুকে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হবে। তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।