আইওএমের প্রতিবেদন

কালের কণ্ঠ:

বাংলাদেশিদের মতো কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গারাও অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। গত মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা পুরুষদের কাজের জন্য বিদেশে পাঠানোর বেশ কয়েকটি ঘটনার কথা তারা জানতে পেয়েছে। বিদেশে যাওয়ার পর মুক্তিপণের জন্য রোহিঙ্গাদের দুই থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত গুনতে হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, রোহিঙ্গাদের অন্যত্র, বিশেষ করে অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার খবর অত্যন্ত উদ্বেগজনক। অতীতে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে এবং বাংলাদেশিদের শ্রমবাজারে সমস্যা সৃষ্টি করেছে। রোহিঙ্গারা যাতে বাংলাদেশি পাসপোর্ট না পায় সে জন্য সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে।

আশ্রয়শিবিরের বাইরে বা বিদেশে কাজের জন্য নিয়োগকারীচক্রের নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পর্কেও তথ্য রয়েছে জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থার প্রতিবেদনে। সাধারণত স্থানীয় দালালচক্র নারী দালালদের মাধ্যমে আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। আইওএম বলেছে, বাংলাদেশি জাল পাসপোর্ট তৈরির মাধ্যমে এ দেশে ও বিদেশে রোহিঙ্গাদের কাজ করার ব্যবস্থার জন্য কক্সবাজারে অপরাধীচক্রের উপস্থিতি বেড়েছে বলেও তথ্য রয়েছে।

স্থানীয় বেসরকারি সংস্থাগুলো (এনজিও) আইওএমকে বলেছে, নিয়োগকারীচক্রে শুধু বাংলাদেশিরাই নয়, আশ্রয়শিবিরের বাইরে অবস্থানরত রোহিঙ্গারাও আছে। তারাই আশ্রয়শিবির থেকে কর্মী পাঠাতে অনুরোধ করছে। অনেক ক্ষেত্রে আশ্রয়শিবিরের নেতারাই এসব নিয়োগে মধ্যস্থতা করে থাকে।

আইওএমের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত আইওএম ও তার অংশীদাররা মানবপাচার ও শোষণের অন্তত ৯৯টি ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে। সেগুলোর মধ্যে ৩৫টি রোহিঙ্গা কন্যাশিশু, ৩১ জন রোহিঙ্গা নারী, আটটি রোহিঙ্গা ছেলে ও ২৫ জন রোহিঙ্গা পুরুষ। নারী ও কন্যাশিশুদের শোষণের শিকার হওয়ার পাশাপাশি শ্রম দিতে বাধ্য হওয়া, ঋণগ্রস্ত হওয়া, শিশুশ্রম, জীবিকার জন্য যৌনতায় বাধ্য হওয়ার উদাহরণ রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কম বয়সী নারীদের গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ করা হলেও পরে তাদের যৌনকাজে বাধ্য করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিদেশে পাচারের জন্য ভুয়া পরিচয়পত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। জোরপূর্বক বিয়ের উদ্দেশ্যে কিশোরীদের অপহরণের ঘটনাও ঘটছে।

আইওএম বলছে, এক বছরেরও বেশি সময় আগে নতুন করে সংকট শুরুর পর কক্সবাজারে রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখের কাছাকাছি পৌঁছেছে। তবে সরকারি সূত্রগুলো বলছে, এ সংখ্যা ১১ লাখেরও বেশি। আইওএমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গারা শ্রমবাজারে বিক্রি হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে তারা মানবপাচারকারীচক্রের খপ্পড়ে পড়ছে।

জাতিসংঘের ওই সংস্থাটি বলছে, রোহিঙ্গা পরিবারগুলো টাকার জন্য প্রায়ই তাদের কন্যাশিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে পাঠাচ্ছে। রোহিঙ্গারা বলছে, আশ্রয়শিবিরে তাদের কাজের সুযোগ নেই বললেই চলে। এ কারণে তারা আশ্রয়শিবিরের বাইরে গিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছে।

তবে বাংলাদেশি কর্মকর্তারা বলেছেন, মানবিক দিক বিবেচনা করেই বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। আশ্রয়শিবির ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার সময় অনেক রোহিঙ্গা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে। এরপর তাদের আবার আশ্রয়শিবিরে ফেরত পাঠানো হয়েছে। আশ্রিত রোহিঙ্গারা যদি শিবির ছেড়ে বাইরে চলে এসে কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে তবে স্থানীয় শ্রমবাজারসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে এর পরিণতি ভয়াবহ হবে।

আইওএমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাজের সুযোগ ও উন্নত জীবনের মিথ্যা আশ্বাসে অনেক রোহিঙ্গা সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলো অনুধাবন করতে পারছে না। আবার অনেকে বর্তমান পরিস্থিতি এতই মরিয়া যে ভয়াবহ বিপদ সম্পর্কে তারা চিন্তাও করে না।

কক্সবাজারে আইওএমের সুরক্ষা বিভাগের প্রধান দিনা পারমার বলেন, অনেক ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা পরিবারগুলো তাদের সবার স্বার্থে একজনকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। তিনি বলেন, শিক্ষার অভাব ও জীবনের নির্মম অভিজ্ঞতার কারণে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মানবপাচারের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিতে আছে।

আইওএম ও তার অংশীদাররা রোহিঙ্গা শিবিরে পথনাটকসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের এ বিষয়ে সচেতন করার চেষ্টা করছে।

আইওএমের প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা পুরুষদের দাস জীবনের চিত্রও প্রকাশ পেয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্থানীয় জেলেরা কাজ করার শর্তে তাদের জমিতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। অসুস্থতার জন্য কাজ করতে না পারলে তাদের ওপর নির্যাতন করা হয় বলেও অভিযোগ উঠেছে। আবার অনেকে ২০ বছর ধরে নৌকায় রোহিঙ্গাদের আনা-নেওয়ার কাজ করছে। এত বছরেও তাদের মুক্তি মেলেনি।