লংকাউয়ি স্কাইক্যাব  এর সুউচ্চ পাহাড়ের সিড়িতে লেখক ও পরিবার

(মালয়েশিয়ার লংকাউয়ি ভ্রমণ – ১)


অধ্যাপক আকতার চৌধুরী


সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের কাঠামোতে পরিচালিত মালয়েশিয়া (মালয়: Malaysia) তেরটি রাজ্য এবং তিনটি ঐক্যবদ্ধ প্রদেশ নিয়ে গঠিত দক্ষিনপূর্ব এশিয়ার একটি দেশ। যার মোট আয়তন ৩,২৯,৮৪৫ বর্গকিমি। দেশটির রাজধানী শহর কুয়ালালামপুর এবং পুত্রজায়া হল ফেডারেল সরকারের রাজধানী। দক্ষিণ চীন সাগর দ্বারা দেশটি দুই ভাগে বিভক্ত, পেনিনসুলার মালয়েশিয়া এবং পূর্ব মালয়েশিয়া। মালয়েশিয়ার স্থল সীমান্তে রয়েছে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, এবং ব্রুনাই; এর সমুদ্র সীমান্ত রয়েছে সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইন এর সাথে। মালয়েশিয়ার মোট জনসংখ্যা ২৮ মিলিয়নের অধিক। [ সুত্র : উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ]

মালয়েশিয়ায় পারিবারিক ট্যুরে এসেছি গত ১৫ অক্টোবর । পিউর আনন্দ ভ্রমণ হিসেবে এবারে অাসা । অনেকদিন থেকে আগ্রহ ছিল এই মালয়েশিয়া নিয়ে ।
১৯৭৯ সালের দিকে যখন কক্সবাজার হাই স্কুলে পড়তাম তখন থেকে একজন মালয়েশিয়ান মহিলা কে নিয়ে এদেশটি সম্পর্কে জানার আগ্রহটা বাড়ে । তিনি বিবাহ সুত্রে কক্সবাজারের বউ হয়ে মালয়েশিয়া ছেড়ে কক্সবাজারে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। আমাকে বেশ আদরও করতেন। আরও একটা বিষয়ে মালয়েশিয়া দেখার বা জানার আগ্রহটা বাড়ে। যে মালয়েশিয়ার জন্য মৃত্যুকে উপেক্ষা করে সাগর পথে পাড়ি দিয়ে মানুষ রিস্ক নেয় !

এবারের ট্যুর প্লানকে সাজিয়েছি কুয়ালামপুর বিমান বন্দর হয়ে ট্রানজিট নিয়ে সরাসরি বিমানে লংকাউয়ি দ্বীপে।যেটি এককালের মৎস্য পল্লী বর্তমানে পৃথিবী বিখ্যাত পর্যটন শহর। ছোট একটি শহরে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরও রয়েছে। দ্বীপটি আয়তনের দিক থেকে আমাদের মহেশখালী দ্বীপের চেয়ে একটু বড় । সুউচ্চ পাহাড় , সবুজের সমারোহ আর স্বচ্ছ নীল পানি বেস্টিত দ্বীপ তাকে ঘিরে আছে আরো ৯৮টি ছোট ছোট দ্বীপ। লাংকাউয়ি দ্বীপে মোটামুটি ১ লক্ষ লোকের বসবাস। এ দ্বীপটি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ডা: মাহাথির মোহাম্মদের নির্বাচনী এলাকা। এখান থেকে তিনি এমপি নির্বাচিত হয়েছেন।

আমাদের দেশের সাথে মালয়েশিয়ার সময় ২ ঘন্টা পার্থক্য । আমরা বিডি টাইম ১৫ অক্টোবর রাত ১.১০ মিনিটে মালিন্ডো এয়ারে চেপে বসি । মালয় টাইম সকাল ৭.১০ টায় আমাদের বিমানটি মালযেশিয়ার রাজধানী কুযালালামপুরের মাটি ছুঁয়ে। তারপর থেকে খুঁটিয়ে খুটিয়ে এটা ওটা দেখতে থাকি । বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশন পার হতে তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি। তবে ইমিগ্রেশনের লোকজনের সতর্ক দৃষ্টি এবং কড়াকড়ি কোনটারই কমতি ছিল না । ইংরেজী অক্ষরে প্রতিটি লেখা দেখে একটু খুশীই হয়েছিলাম। কোথাও কোন মালয় অক্ষর দেখতে না পেয়ে ভাবলাম তারা পর্যটনকে উৎসাহিত করার জন্য ইংরেজীকে প্রাধান্য দিয়েছে । কিন্তু খুশী বেশীক্ষণ টিকলনা। এ ইংরেজী বোধগম্য হচ্ছিল না। পরে ভাল করে খেয়াল করে দেখলাম ইংরেজী অক্ষরে মালয় ভাষায় প্রতিটি সাইনবোর্ড । তার নিচে গরীবী হালতে ইংরেজী শব্দটাও আছে। শুনেছি যদি কেউ মালয় ভাষাকে ইংরেজীর নিচে লিখে তাহলে তার জরিমানা বা শাস্তি অবধারিত।
একজনের কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম – মালয় ভাষায় নিজস্ব কোন অ্যালফাভেট নেই ! তারা ইংরেজী অক্ষরকে ধারণ করে মালয় ভাষায় লেখাপড়া করে। ইংরেজী তাদের ২য় ভাষা । যদিও তারা ইংরেজী ভাষায় কথা বলতে তেমন একটা উৎসাহ বোধ করেনা। তাদের কাছে মালয় ভাষা সম্মানটাই বড়।

এ যাত্রায় মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর বিমান বন্দর থেকে আবার ফ্লাই করলাম সরাসরি আধূনিক মালয়েশিয়ার রুপকার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ এর নিজের নির্বাচনী এলাকা লংকাউয়ি দ্বীপে। তিনি কিছুদিন আগে এখান থেকে নির্বাচন করে এমপি নির্বাচিত হন।

লংকাউয়ি দ্বীপ মূলত পাহাড় ও সাগর বেস্টিত পর্যটন এলাকা । প্রকৃতির অপার দান এ দ্বীপ । নিজ হাতেই সাজিয়েছেন বিধাতার সাথে সাথে ড. মাহাথির । শুনেছি ড. মাহাথির যে দেশে যান সে দেশের সবচেয়ে সুন্দর জায়গাগুলো পরিদর্শন করে নিজের দেশের বিভিন্ন জায়গাকে সুন্দর একটি মডেলে পরিণত করেন।

লংকাউয়ি দ্বীপ আয়তনে আমাদের কক্সবাজারের মহেশখালী দ্বীপের চেয়ে একটু বড়। সুউচ্চ পাহাড় আর বনরাজিতে সর্বত্র সবুজের সমারোহ। আমাদের বিমান যখন লংকাউয়ির আকাশে তখন দেখতে পেলাম এ দ্বীপটিকে ঘিরে আছে অনেকগুলো ছোট বড় দ্বীপ । কুয়ালালামপুর থেকে এ দ্বীপে পৌছাতে আমাদের ৪৫ মিনিট এর মত লাগে। ইমিগ্রেশন শেষ করে একটি টেক্সি ক্যাবে আমাদের আগে থেকে বুকিং দেয়া  jalan pantai tengah  পর্যটন এলাকার গ্রীণ ভিলেজ লংকাউয়ি রিসর্টে যেতে ৩৫ রিংগিট নেয়। হিসেব করে দেখলাম বাংলা টাকায় ৭০০ টাকার বেশী। যতটুকু পথ দেশের উবার কিংবা পাঠাও এ আসত ২০০ টাকার মত। বউ জামাই দুজনেরই চক্ষু চড়ক গাছ! এখানকার রিংগিটের সাথে যতবার হিসেব করি ততবারই বুকটা ধড়ফড় করে। যা নিয়ে এসেছি তা কুলিয়ে দেশে ফিরতে পারব তো!

কোন রকম ধকল কাটিয়েএলাকার হোটেল কাউন্টারে ঢুকলাম। হোটেলটা দেখতে কটেজ টাইপের আমাদের কক্সবাজারের মারমেড রিসর্ট টাইপের। সম্মুখ ভাগ দেখে বেশ ভালই লাগল। একটা আভিজাত্যের ভাব আছে। সুন্দরী রিসেপশনিষ্ট এক মুখ হেসে আমাদের দেখে বলল , হ্যালো , সালামত দাতাং হোটেল । তার মানে ইরেজীতে Welcome in Hotel । সামনে গিয়ে আমার বুকিং স্লিপটা দেখালাম। তিনিও বেশ আগ্রহ সহকারে আমাদের পাসপোর্ট আর বুকিং স্লিপটা দেখে দু’টো চাবি ধরিয়ে দিলেন । ততক্ষণে আরেক কালো টাইপের ভদ্রলোক এসে আমাদের বিষয়ে দেখভাল শুরু করে দিলেন । তার চেহারাটা দেখে তেমন একটা পছন্দ হল না । দেখতে অনেকটাই বাংলা ছবির ৯০ দশকের ভিলেনের মত। পেছনে চুল লম্বা আর গোফ ওয়ালা । মনে হল হোটেলের হোমরা চোমরা কেউ । তিনিও আমাদের জন্য খাবার দাবার ব্রেক ফাস্ট এর আয়োজন কোন খানে হবে সেই জায়গাটা দেখিয়ে দিলেন । একটা বয় ছেলেকে ডেকে রুমগুলোতে নিয়ে যেতে বললেন।

কুয়ালামপুর বিমান বন্দরে নেমে প্রায় ২ ঘন্টা ফ্লাইট ডিলে করে। ব্রেক ফাস্ট হিসেবে মালিন্ডো এয়ারের দেয়া কমপ্লিমেন্টারী খাবার পেটে যাচ্ছিল না । লম্বা জার্নিতে ক্লান্ত ছিলাম। ইচ্ছে হচ্ছিল ঘুমিয়ে পড়ব। রুমের দরজা খোলার আগে দেখতে পেলাম দিনের বেলায় ঝাকে ঝাকে সাদা রঙের মশা সানাই বাজাচ্ছে !
বউয়ের চেহারায় অনুযোগের সুর ।
আগেই বলেছিলাম ট্রাভেল এজেন্সীর উপরে ভরসা না করে নিজে দেখে নিতে।
ততক্ষণে নিজের অপরাধ ঢাকতে বউয়ের উপর সামান্য চড়াও হলাম ।
ধ্যেৎ , এসব কথা না বললেই কী নয় ?

ততক্ষণে বয় রুম খোলে দিয়েছে। বড় সড় বিছানা । সাথে বেবী বেডও আছে । বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে এক রুমেও থাকা যায় ।
কিন্তু একি ভেতরে আরো মশা বেশী । বউয়ের মেজাজ দেখে কে!
মশার স্প্রে আনানো হল । স্প্রে করে বাইরে দাড়ালাম সবাই । সমান আক্রমণ ভেতরে বাহিরে। তাড়াতাড়ি রুমে ঢুকে পড়লাম।
কোন ফাঁকে আমার বড় মেয়ে বিছানার নিচ থেকে ব্যাঙ আবিস্কার করল। আমার তো কাঁদো কাঁদো অবস্থা । বউয়ের কাছে ইজ্জত পাংচার! অন্য দিকে বড় মেয়ে আগুনে ঘি ঢেলে দিল। কোন রকমে ব্যাঙ বেটাকে পায়ে ঠেলে রুমের বাহির করে দিলাম।
বড় মেয়ে বলে উঠল , পাপ্পা এখানে সাপও থাকতে পারে।
সাথে সাথে বউ তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল । এখানে আর থাকব না । চল দেশে চলে যাই । বেড়ানোর দরকার নাই। আমি তখন আন্দামান সাগরে ফেলে দেয়া আদমের মত ভাসছিলাম।
তখন হঠাৎ মনে পড়ে কক্সবাজারের নেজামের কথা । সে কুয়ালাম পুর থাকে। আসার আগে বলেছিল , তার পরিচিত করিম নামে হোটেল ব্যবসায়ী কক্সবাজারের লোক আছে । তিনি সব ব্যবস্থা করতে পারবেন। করিম ভাইয়ের নম্বরটা আগে থেকে নেয়া ছিল আমার কাছে।
তাকে কল দিতেই বললেন , আপনি চিন্তা করবেন না । একটু অপেক্ষা করেন । আমি গাড়ী নিয়ে আসছি।
ততক্ষণে বউ ব্যাগ গুটিয়ে রেডি করে ফেলেছে।
১৫ মিনিটের মাথায় তিনি এলেন। করিম ভাইকে আগে দেখিনি। গাড়ীর গ্লাসটা নামিয়ে বললেন , আপনি ব্যাগ নিয়ে আসেন। আমার হোটেলটা পছন্দ হয় কিনা দেখেন। না হলে অন্য আরো ভাল হোটেলে তুলে দেব।

কী আর পছন্দ অপছন্দ । আগে গ্রীণ ভিলেজ ত্যাগ করি। করিম ভাইকে দেখে মনে অনেকটা সাহস আসল। গ্রীণ ভিলেজ ওযালাকে জানালাম , তাদের হোটেল আমাদের পছন্দ হয়নি। আমরা চলে যাচ্ছি। টাকাটা রিটার্নের কোন সুযোগ আছে কিনা জানাতে বললেন , যেহেতু আমরা ট্যুর অপারেটরের মাধ্যমে ানলােইন বুকিং দিয়েছি – তাই ফেরত দেয়া সম্ভব নয় ।
যাক , টাকা রিটার্ন পাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে করিম ভাইয়ের গাড়ীতে চেপে বসলাম। মনে মনে বললাম – তোমার ‘সালামত দাতাং হোটেল’ আমার কেয়ামত করে দিয়েছে!

পরবর্তীতে আসছে – ‘ভাবী ইজ হারাম!’