ডেস্ক নিউজ:
কয়েক দিন আগে বিএনপির সমর্থক এক বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে দলের অতীত ও বর্তমান নিয়ে কথা বলেছিলাম। আলোচনা প্রসঙ্গে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার প্রসঙ্গটিও আসে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, বিএনপি সরকারের আমলে সংঘটিত এত বড় নৃশংসতার দায় কীভাবে দলটি এড়াবে?

ওই বুদ্ধিজীবী বললেন, ‘আমি খালেদা জিয়াকে যতটুকু জানি, তাতে মনে হয় না তিনি এ ঘটনার সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত ছিলেন।’ তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করি, কিন্তু খালেদা জিয়ার অগোচরেও তো অনেক কিছু ঘটে থাকতে পারে, যেখানে সে সময় ‘দ্বৈত শাসন’ চালু থাকার প্রবল অভিযোগ ছিল। তিনি অভিযোগটি সরাসরি অস্বীকার করলেন না। বরং বিএনপির শাসনামলে এই দ্বৈত শাসন রহিত করতে তাদের সমর্থক ৩৩ জন বুদ্ধিজীবীর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার ঘটনা তুলে ধরেন। ওই বুদ্ধিজীবীরা সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে খালেদা জিয়ার সঙ্গে এ নিয়ে আলাপ করেছেন এবং তিনি নাকি তাঁদের কথাও দিয়েছিলেন যে দ্বৈত শাসন থাকবে না।

তখন হাওয়া ভবন নিয়ে খুব আলোচনা হলেও সরকারের ভেতর যে আরেকটি সরকার ছিল, সেসব বিষয়ে কথাবার্তা কমই হতো। যদিও সংশ্লিষ্ট সবাই জানতেন, ক্ষমতার ভরকেন্দ্রটি ছিল সেই হাওয়া ভবনই। রাজনৈতিক বিরোধীদের কাছে এই ভবন ছিল একধরনের আতঙ্ক। আর বিএনপির লোকজনের কাছে ছিল স্বার্থ হাসিলের কেন্দ্র। অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা এই ভবন নিয়ে কোনো কথা বলতে ভয় পেতেন, কেননা এই ভবনের মালিকের ওপরই তাঁদের মন্ত্রিত্ব থাকা না-থাকা নির্ভর করত। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করলে বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান আলতাফ হোসেন চৌধুরী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলেও কার্যত মন্ত্রণালয়টি চালাতেন প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরই।

গত বুধবার বিচারিক আদালতে ঘোষিত গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপি সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তাঁর ভাই ও জঙ্গিনেতা মাওলানা তাজউদ্দিনসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। এ ছাড়া বর্তমানে লন্ডনে বসবাসকারী বিএনপির ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান’ তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। বিএনপি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এই রায় প্রত্যাখ্যান করে যা বলেছে, তাতে প্রকারান্তরে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় তৎকালীন সরকার ও দলের দায় স্বীকার করেই নিয়েছে। তাদের আপত্তি শুধু তারেক রহমানকে নিয়ে। সম্পূরক মামলায় তাঁকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জড়ানো হয়েছে। আবার আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গ্রেনেড হামলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে তারেকের মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত ছিল। বিচারিক আদালতে রায় হয়েছে। যেকোনো পক্ষ ক্ষুব্ধ থাকলে উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারবেন। কিন্তু এই রায়ের মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হলো যে আমাদের রাজনীতিকেরা এই মামলায় দণ্ডিত বিএনপির অন্যান্য নেতা এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বিষয়ে কিছু বলেননি।

এর পাশাপাশি আমরা আদালতের পর্যালোচনা বিশ্লেষণ করলে কী দেখি। আদালত বলেছেন, ‘রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় প্রকাশ্যে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ঘটানো হয়। এই হামলা ছিল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা। বিরোধী দলের নেতাদের হত্যা করে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ফায়দা অর্জন করা মোটেই গণতান্ত্রিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ নয়।’ এতে আরও বলা হয়, ‘রাজনীতি মানে বিরোধী দলের ওপর পৈশাচিক আক্রমণ হতে পারে না। এ রাজনীতি দেশের জনগণ চায় না। সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে শত বিরোধ থাকবে। তাই বলে নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টা হতে পারে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ক্ষমতায় বিরোধী যে দলই থাকবে, বিরোধী দলের প্রতি তাদের উদারনীতি প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা থাকতে হবে।’

বর্তমানে বিরোধী দলে থাকা বিএনপির নেতারা নিশ্চয়ই আদালতের এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে দ্বিমত করবেন না। তাহলে কেন ২১ আগস্টের জঘন্য হত্যাকাণ্ড যারা ঘটিয়েছে, ক্ষমতায় থাকতে কেন তাদের বিচার করলেন না? কেন বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনকে দিয়ে একটি ভুয়া তদন্ত কমিশন করে ১৬২ পৃষ্ঠার হাস্যকর প্রতিবেদন দাখিল করেছিলেন? ওই কমিশন বলেছিল, প্রতিবেশী দেশের শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা এই হামলার সঙ্গে জড়িত।

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ১০ মাস পর ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার বীরকোট গ্রামের জজ মিয়াকে সিআইডি আটক করে এবং তাঁর কাছ থেকে গ্রেনেড হামলার দায় স্বীকারপূর্বক ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি আদায় করা হয়। সেই জবানবন্দিও যে অসত্য ছিল, ২০০৬ সালের ২১ আগস্ট তা ফাঁস করে দেয় প্রথম আলো। প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জজ মিয়ার মা জোবেদা খাতুন বলেছিলেন, জজ মিয়াকে আটকের পর থেকে তাঁর পরিবারকে সিআইডি মাসিক ভাতা দিয়ে আসছে। এ ছাড়া হামলার পরপর মাওলানা তাজউদ্দিনসহ জঙ্গি ঘাতকদের নিরাপদে পার করে দেওয়া হয়েছিল। এসব ঘটনা প্রমাণ করে রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তা ছাড়া এ জঘন্য হত্যাকাণ্ড ঘটানো সম্ভব ছিল না। জঙ্গিরা দেশে অনেক গুপ্ত হত্যা করেছে। কিন্তু এটি কোনো গুপ্ত হত্যা ছিল না। ছিল প্রকাশ্য ও পরিকল্পিত হত্যা, যার উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাসহ পুরো আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে নিঃশেষ করে দেওয়া। এ রকম ঘৃণ্য হত্যার সঙ্গে কোনো দলের কোনো নেতা বা কর্মী জড়িত থাকলে সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের বহিষ্কার ও বিচার করা ছিল সভ্য দুনিয়ার রীতি।

২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ তাঁর বইয়ে লিখেছিলেন, ‘পরবর্তীকালে অস্বীকার করলেও মুফতি আবদুল হান্নান স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে স্বীকার করে যে গ্রেনেড হামলার উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে উৎখাত করা।’ (বাংলাদেশে গণতন্ত্র: ১৯৯১-২০০৬, ইউপিএল, ঢাকা) সাংবাদিক আতাউস সামাদ ২০০৪ সালের ২৩ আগস্ট প্রথম আলোর প্রথম পাতায় মন্তব্য প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, ‘এই হামলা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর রাজধানীতে সবচেয়ে নারকীয়, ভয়াবহ ও ন্যক্কারজনক রাজনৈতিক সহিংসতা।’

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বিএনপি সরকার সেই ন্যক্কারজনক সহিংসতার তদন্ত বা বিচার কোনোটিই করেনি। সে সময়ে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত টেলিভিশনের ভূমিকা কী ছিল, সে কথাও আমরা ভুলে যাইনি। হামলার ঘটনা ঘটে সন্ধ্যায়। রাত ৮টা ও ১০টার বুলেটিনে বিটিভি এ সম্পর্কে কোনো খবরই প্রচার করেনি। জনগণের অর্থে পরিচালিত রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্র এভাবেই রাজার ইচ্ছা পূরণ করে।

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ১৪ বছর পর বিচারিক আদালতে রায় হলো। এরপর উচ্চ আদালতে আপিল হবে এবং তার নিষ্পত্তির আগে বলা যাচ্ছে না অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা গেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার শেষ করতে ৩৪ বছর লেগেছিল। কিন্তু এসব অপরাধের বিচারিক দায়ের পাশাপাশি যে একটি রাজনৈতিক দায় আছে, সেটিও ভুলে গেলে চলবে না।

এই মামলায় যেসব সাবেক সরকারি কর্মকর্তা দণ্ডিত হয়েছেন, তাঁদের দায় দল হিসেবে বিএনপির ওপর না বর্তালেও (যদিও বিএনপি সরকার সেই দায় এড়াতে পারে না) দলের বিভিন্ন পদে আসীন দণ্ডিত নেতা সাবেক প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রী ও সাংসদের দায় তাকে নিতেই হবে।

আমরা মনে করি, বিএনপির সামনে এখন দুটি পথ খোলা আছে: সেই দণ্ডিত ব্যক্তিদের দলে রেখে তাঁদের অপরাধের দায় বহন করে যাওয়া অথবা দণ্ডিত ব্যক্তি বা ব্যক্তিসকল যত উঁচু পদেই থাকুক না কেন তাঁদের সঙ্গে এই মুহূর্তে সম্পর্ক ছিন্ন করে ২১ আগস্টের জঘন্য হত্যাকাণ্ডের দায় থেকে নিজেদের দূরে রাখা। বিএনপি এখন কী করবে, তার ওপরই হয়তো তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি