ইমাম খাইর, কক্সবাজার
ঘুর্ণিঝড় তিতলির প্রভাবে জোয়ারে পানি বেড়ে যাওয়ায় টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপের মাঝার পাড়া ও দক্ষিণপাড়ায় ব্যাপক ভাঙন হয়েছে। গত তিন দিনের টানা বর্ষণে মসজিদসহ অর্ধশতাধিক বাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। জোয়ারের পানিতে ক্ষতির আশঙ্কায় থাকা অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ অন্যত্র সরে গিয়েছে। এ দ্বীপে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের বসতি।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ রবিউল হাসান সিবিএনকে বলেন, বৃহস্পতিবার সরেজমিন গিয়ে ৩৪টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত পেয়েছি। সেখানে প্লাবিত ৩০ পরিবারে ৩ হাজার এবং ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত ৪ পরিবারের ৫ হাজার টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক পরিবারে দেয়া হয়েছে ৩০ কেজি করে চাল। ক্ষতিগ্রস্তদের আরো সহায়তা করা হবে বলে জানান ইউএনও।
স্থানীয় সূত্র জানায়, বঙ্গোপসাগরে ভাঙনে সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপের মাঝের পাড়া ও দক্ষিণপাড়া অর্ধশতাধিক বসতবাড়ি বিলীন হয়ে যায়। এ ছাড়া ভাঙনের হুমকিতে আছে ইউনিয়নের ঘোলাপাড়া, পশ্চিমপাড়া, দক্ষিণপাড়া ও জালিয়াপাড়ার একাংশে ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে।
শুক্রবার (১২ অক্টোবর) দুপুরে ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন স্থানীয় এমপি আব্দুর রহমান বদি, উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রবিউল হাসান, জেলা অাওয়ামী লীগের সদস্য সোনা অালী, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি সরোয়ার অালম, শাহপরীরদ্বীপ রক্ষা কমিটির সভাপতি জাহেদ হোসেন প্রমূখ।
সংশ্লিষ্টদের মতে, সমস্যা-সংকটে এভাবে প্রায় বিচ্ছিন্ন জনপদে পরিণত হতে যাচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর শাহপরীর দ্বীপ। পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান হয়ে উঠতে পারে শাহ পরীর দ্বীপ, সেটির সংকট সমাধানে যথাযথ নজর নেই কর্তৃপক্ষের। দিনে দিনে তা নদিগর্ভে বিলীন হতে চলেছে।
গত বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার- এই তিনদিনে যেসব মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন- মাঝারপাড়ার নুর বেগম, সোনা মিয়া, মোহাম্মদ ইউনুছ, মোহাম্মদ ইছুপ, মোহাম্মদ জলিল, আমানউল্লাহ, মোহাম্মদ ইউনুছ, হাসিম উল্লাহ, নুর হাকিম, হাসিনা বেগম, খালেদা বেগম, আবদুল শক্কুর, আয়ুব আলী, মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, মোহাম্মদ হোসেন, মোহাম্মদ লালু, করিম উল্লাহ, ফজল হক, রশিদ উল্লাহ, মোহাম্মদ ইলিয়াছ, মোক্তার আহম্মদ, মোহাম্মদ ছব্বির, মোহাম্মদ শফিক, মোহাম্মদ রফিক, তৈয়ুবা খাতুন, আলী হোসেন এবং দক্ষিন পাড়ার দুদু মিয়া, সৈয়দ করিম, মোহাম্মদ শরীফ, কালা বানো, জোলেহা, মাহামুদা খাতুন, আবদুল হাকিম, শামসুল আলম, শাহ আলম, আবদুল রশিদ, খতিজা, আবদুল কুদ্দুস, মোহাম্মদ বশির, মোহাম্মদ শফিকসহ অনেক।
কথা হয় মাঝের পাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ ইউনুসের (৬৫) সঙ্গে। ইতোমধ্যে তার বাড়ি ও ভিটা চলে গেছে সাগরে। তিনি বলেন, ‘নাম লিখে কী করবেন, বাড়িঘর তো আর ফিরে পাবো না। গত পাঁচ বছর ধরে জোয়ারের পানিতে ভাসলাম। এখন সব কিছু গিলে নিয়েছে সাগর। বড় ভাই সুলতান আহম্মদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি।’
ঘর ভেঙে অন্যত্র আশ্রয় নেওয়া নুর বেগম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘জোয়ারের পানিতে ঘর ভেঙে যাওয়ায় অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছি। পাঁচ বছর ধরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে মরছি। কেউ আমাদের কষ্টের খবর নিতে আসে না।’
এ বিষয়ে সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের (স্থানীয় ইউপি) চেয়ারম্যান নুর হোসেন বলেন, গত বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্রবার তিনদিনেই অর্ধশতাধিত ঘরবাড়ি হারিয়েছেন দ্বীপের মানুষ। খোঁজখবর নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সহায়তা চেয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তালিকা পাঠানো হবে। দ্বীপের পশ্চিম পাড়ায় বেড়িবাঁধ না থাকায় সাগরের অস্বাভাবিক জোয়ারে মসজিদসহ ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে। শুক্রবার (১২ অক্টোবর) সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত অর্ধশতাধিক ঘর পানিতে ডুবে গেছে। এসব ঘরের লোকজন টেকনাফসহ অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। এইভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েকদিনে শাহপরীর দ্বীপের মাঝারপাড়া ও দক্ষিণপাড়ার আরও দুই শতাধিক ঘর সাগরে তলিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন সেখানকার বাসিন্দারা।
টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নুরুল আমিন বলেন, ‘সাগরের জোয়ারের পানিতে দ্বীপের মাঝারপাড়া ও দক্ষিণপাড়ার শতাধিক ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিতে ডুবে যাওয়ায় প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। গত পাঁচ বছর আগে দ্বীপের পশ্চিম দিক থেকে তিন কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে যায়। এরপর থেকে দ্বীপের বাসিন্দারা পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এছাড়া খোলা বাঁধ যদি মেরামত না করা হয় তবে আগামী কয়েকদিনের ভেতর আরও শতাধিক ঘর সাগরে বিলীন হয়ে যেতে পারে। ’
তিনি আরও বলেন, ‘দ্বীপের বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য সরকার ১০৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। ইতোমধ্যে কিছু কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ মুহূর্তে দ্রুতগতিতে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো নির্মাণ করা না গেলে পুরো দ্বীপ সাগরে তলিয়ে যাবে।’
জানতে চাইলে পাউবো কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী সবিবুর রহমান বলেন, ‘১০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে শাহপরীর দ্বীপের প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। এর মধ্যে ৫৪ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি কাজও দ্রুত সম্পন্ন করার লক্ষ্যে আমরা চেষ্টা করছি। তবে যে খোলা বাঁধ থেকে সাগরের পানি ঢুকছে সেখানে জিও ব্যাগ বসানো হয়েছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘উত্তর-দক্ষিণের দুই কিলোমিটারের ভেতর যেসব ঘরবাড়ি রয়েছে সেখানে জোয়ারের পানি প্রবেশ করেছে। যে স্থান থেকে পানি ঢুকছে সেখানে আবারও বালির জিও ব্যাগ ও বস্তা বসানো হবে। পুরো তিন কিলোমিটারের কাজের মেয়াদ ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। তবে আবহাওয়া ভালো থাকলে নির্দিষ্ট সময়ের আগে কাজ শেষ করা হবে।’