বিদেশ ডেস্ক:
সোমবার এক বিশেষ প্রতিবেদনে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হার নিয়ে ভীতিকর তথ্য হাজির করেছে জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক প্যানেল-আইপিসিসি। তাদের আশঙ্কা, কার্বন নিঃসরণের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যেই উষ্ণতা বৃদ্ধির হার ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করে যাবে। ৬০০০ নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে তথ্য নিয়ে আইপিসিসি উষ্ণতা বৃদ্ধির হার ১.৫ অতিক্রমের সম্ভাব্য প্রভাব লিপিবদ্ধ করেছে তাদের প্রতিবেদনে। তবে আইপিসিসির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন, এমন একদল পরিবেশ বিজ্ঞানী মনে করছেন, গুরুত্বপূর্ণ অনেক হুমকির প্রসঙ্গ ওই প্রতিবেদনে উপেক্ষিতই থেকে গেছে। তাদের দাবি, উষ্ণতা বৃদ্ধির সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে এরইমধ্যে প্রকাশ্যে আসা হুমকিগুলোকেই সামনে এনেছে আইপিসিসি। তবে ওই বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, সম্ভাব্য এমন আরও অনেক হুমকি আছে, যা মানুষের জানার বাইরে। অজানা সেই হুমকিগুলোকে আমলে নিয়ে তারা বলছেন, ঘটনার ভয়াবহতা সম্পর্কে আইপিসিসি যে সীমারেখা টেনেছে, তাতে মানুষের পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রস্তুতি ব্যহত হতে পারে। আমাদের অজান্তেই জলবায়ু পরিবর্তনের ঘূর্ণিপাকে হারিয়ে যেতে পারে আমাদের প্রিয় পৃথিবী।

সোমবার (৮ অক্টোবর) জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্যানেল (আইপিসিসি) তাদের এক বিশেষ প্রতিবেদনে সতর্ক করে, কার্বন নিঃসরণের বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ১২ বছরের মধ্যে পৃথিবীতে খরা,বন্যা আর ভয়াবহ তাপপ্রবাহের মতো মহাবিপর্যয় নেমে আসতে পারে। উষ্ণতা বৃদ্ধির বিপর্যয়পূর্ণ এই মাত্রার লাগাম টেনে ধরতে‘সমাজের সবক্ষেত্রে দ্রুত,বহুদূরপ্রসারিত ও নজিরবিহীন পরিবর্তন’র অপরিহার্যতা তুলে ধরে জাতিসংঘ প্যানেল। তবে প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর জলবায়ুবিষয়ক বিজ্ঞানীদের একটি অংশ মনে করছে, উষ্ণতা বৃদ্ধির হার ১.৫ ডিগ্রিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পরিণতির বিষয়টি নতুন কিছু নয়। কম জানা গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঝুঁকি রয়েছে যা নিয়ে আইপিসিসি সতর্ক করেনি।

ইন্সটিটিউট ফর গভর্নেন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট-এর প্রতিষ্ঠাতা ডুরউড জায়েলকে বলেন, ‘জলবায়ু চক্রের সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছে আইপিসিসি।’ জায়েলকে মনে করছেন, উষ্ণতা বৃদ্ধির সুনির্দিষ্ট কিছু প্রভাবকে সামনে এনেছে আইপিসিসি। ওইসব প্রভাবক থেকে নতুন নতুন প্রভাব আর হুমকি সৃষ্টি হতে পারে, যা আমলে নেওয়া হয়নি। আমরা ইতোমধ্যেই জানি, বাতাসে থাকা জলীয় বাষ্প বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রাকে ধরে রাখে। এ ক্ষেত্রে প্রতিফলকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় পৃথিবীর আইস ক্যাপগুলো (যেসব বরফখণ্ড ৫০ হাজার কিলোমিটার থেকে কম জায়গাজুড়ে বিস্তৃত)। এগুলো সূর্যরশ্মির একাংশকে প্রতিফলনের মধ্য দিয়ে মহাকাশে ফেরত পাঠায় এবং পৃথিবীকে ঠাণ্ডা করে। মেরু অঞ্চলের বরফের গলন, ভূগর্ভস্থ চির হিমায়িত অঞ্চলের ভেঙে পড়া এবং মেরু অঞ্চলের দিকে ক্রান্তীয় মেঘের এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কমবেশি জানাশোনা আছে আমাদের। তবে অজানা বিষয় হলো, বরফখণ্ডগুলো গলে সাগরের অস্বচ্ছ পানিতে রূপান্তরিত হলে তা তাপ শোষণ করে এবং স্বতন্ত্রভাবে উষ্ণতা বাড়ায়। গ্রীনল্যান্ড ও অ্যান্টার্কটিকার ক্ষেত্রেও যখন বরফ গলে, তখন পানি ভূপৃষ্ঠের তলদেশে প্রবেশ করতে শুরু করে। এতে শিলাখণ্ডের ওপর থাকা বরফখণ্ডগুলো পিচ্ছিল হয়ে পড়ে এবং ভাঙন ত্বরান্বিত হয়। বরফখণ্ডগুলো তখন আশেপাশের সাগরে ভেঙে পড়ে।

গ্রানথাম ইন্সটিটিউটের বব ওয়ার্ড বলেন, ‘নীতি নির্ধারকদের জন্য আইপিসিসি যে সারাংশ উপস্থাপন করেছে তাতে কেবল পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকা ও গ্রীনল্যান্ডের হুমকিগুলোকে শনাক্ত করা হয়েছে। এসব জায়গায় এরইমধ্যে খারাপ পরিস্থিতি শুরু হয়েছে।’ তার মতে, আইপিসিসি’র প্রতিবেদনটি সম্ভাব্য ঝুঁকির ব্যাপকতা নিয়ে আমাদের জানাশোনার স্বল্পতাকে প্রতিফলিত করেছে। বব ওয়ার্ড মনে করছেন, ওই প্রতিবেদন পৃথক পৃথকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকিগুলোর ভয়াবহতাকে সামনে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেছেন, হয়তো উষ্ণতা বৃদ্ধির হার আরও গতিশীল না হওয়া পর্যন্ত বিষয়গুলোতে অতোটা গুরুত্ব দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে না, তবে এর পরিণতি আরও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে। থামানো অসম্ভব, এ কথাটা না জানা পর্যন্ত আপনি এগুলোকে উপেক্ষা করতে পারেন না।’

ওই বিজ্ঞানীদের ভাষ্য অনুযায়ী, গুরুত্বপূর্ণ হুমকিগুলোকে উপেক্ষা করার কারণে বড় একটি সমস্যার জন্ম হতে পারে। হুমকিগুলো কখন বাস্তবে রূপ নেবে তা আমরা টেরই পাব না। ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক সার্ভের গবেষক রবার্ট লার্টার মের অঞ্চলের বিস্তৃত বরফ খণ্ডগুলোকে ‘সুপ্ত দানব’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘গত বরফ যুগের পর বরফখণ্ড গলতে শুরু করলে সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি শতাব্দীতে তিন মিটারেরও বেশি বেড়েছিল। যা বর্তমান হারের চেয়ে দ্রুত গতির ছিল। এ থেকে বোঝা যায়, আমরা যেভাবে দেখছি তার চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত গতিতে বরফ খণ্ডগুলো গলতে পারে। এ সুপ্ত দানবগুলোকে জাগিয়ে তোলার ব্যাপারে আমাদের সতর্ক হতে হবে।’

বরফ গলার আরেকটি প্রভাব হলো ভূগর্ভস্থ চির হিমায়িত অঞ্চলের অস্থিতিশীল হয়ে পড়া। এ স্তরে বিপুল পরিমাণে মিথেন গ্যাস রয়েছে। আর এটি কার্বন ডাই অক্সাইডের মতোই উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী একটি শক্তিশালী গ্রীনহাউস গ্যাস। ভূগর্ভস্থ হিমায়িত অঞ্চল গলতে থাকলে ওই গ্যাস বায়ুমণ্ডলে মিশে ধারণাতীত পরিণাম ডেকে আনতে পারে। এছাড়া উচ্চ তাপমাত্রার কারণে কিছু ভূমি শুকিয়ে যেতে পারে, এসব ভূমির নিচে সংরক্ষিত কার্বনের একাংশ বাতাসে মিশে যেতে পারে। উষ্ণায়নের প্রভাবে পৃথিবীর একাংশে বৃষ্টি বেড়ে গেলে অন্য এলাকার বন্য মাটির পক্ষে মিথেনের মতো গ্রিনহাউস গ্যাস ধরে রাখা কঠিন হবে।

ওজন স্তরের ক্ষয় নিয়ে কাজ করার স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯৫ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন বিজ্ঞানী মারিও মোলিনা। তিনি বলেন, ‘আইপিসিসির প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, জলবায়ুকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ রাখা এখনও সম্ভব। নজিরবিহীন পারস্পরিক সহযোগিতা, তীব্র গতি ও ব্যাপকভাবে এ ব্যাপারে কাজ করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তবে ক্রমবর্ধমান প্রভাবগুলো নিয়ে যে বর্ণনা ও সতর্কতা দেওয়া হয়েছে, তাতে দেখা গেছে গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকিগুলোকে আইপিসিসি উপেক্ষা করেছে।’