জে. জাহেদ, চট্টগ্রাম :

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের কর্ণফুলী টোলপ্লাজার পাশে স্থাপিত হচ্ছে ওজন মাপার স্কেল (এক্সেল লোড কন্ট্রোল। ইতিমধ্যে এক পাশে বসানো শেষ অন্য পাশে সেট করা হচ্ছে। এ যন্ত্রের কাজ ওভারলোড কন্ট্রোলের মাধ্যমে মহাসড়কে চলাচলকারী ভারীপণ্যবাহী ট্রাকের ওজন নিয়ন্ত্রণ করা।

ফলে মহাসড়কে চলাচলরত পণ্যবাহী যানবাহন গুলোর তিন ধরনের এক্সেল মাপা হবে। এর মধ্যে ৬ চাকাবিশিষ্ট দুই এক্সেলের ট্রাক পণ্য পরিবহন করতে পারবে ১৩ টন। ১০ চাকাবিশিষ্ট তিন এক্সেলের ট্রাক ১৮ টন ও চার এক্সেলের ১৪ চাকার ট্রাক ২৭ টন পণ্য পরিবহন করতে পারবে। এর আগে ওসব ট্রাক নিয়ম লঙ্ঘন করে নির্ধারিতের কয়েক গুণ পর্যন্ত পণ্য পরিবহন করতো।

তবে এই এক্সেল লোড কন্ট্রোল যন্ত্রটি এর পুর্বে চট্টগ্রাম বড় দারোগাহাট মহাসড়কেও স্থাপন করা হয়েছিলো। আবার ওই ওজন স্কেল স্থায়ীভাবে বন্ধের দাবিতে মানববন্ধনও করেছিল চট্টগ্রামের ২০টি স্বনামখ্যাত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান।

নতুন এই যন্ত্রের ব্যবহার ও পদক্ষেপে দেশের সাধারণ মানুষ সুফল পাবে কিনা? না বঞ্চিত হবে এবং ভোগ্যপণ্যের মূল্য বেড়ে যাবে ? না কমবে। জনগণের মাঝে প্রশান্তি আনবে, না ভোগান্তি বাড়াবে। এমন হিসাব কষতে শুরু করেছে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ।

শহরের প্রবেশদ্বার কর্ণফুলীর মইজ্জ্যারটেক টোল প্লাজায় যন্ত্রটি স্থাপনের ফলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে যানজট বৃদ্ধি করতে পারে। এমনটি আশংকা কেননা একই জায়গায় টোল আদায়। আবার নতুন করে যোগ হচ্ছে দুপাশে এক্সেল লোড কন্ট্রোল বা ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেল। অনেকের ব্যক্তিগত অভিমত টোলপ্লাজায় এ স্কেল না বসিয়ে অন্য জায়গায় বসানো উচিত ছিল। কেননা প্রবেশ ধারে পণ্যবাহী গাড়ির সাথে যাত্রীবাহী গাড়ির চাপ বাড়াবে দ্বিগুণ।

এতে ভোগান্তিতে পড়বে নানা পণ্য ও যাত্রীবাহী যানবাহন এমনটি ধারণা। এটা বসানোর পর কার্যকর হলে যানজট থাকার আশংকা করছে স্বয়ং হাইওয়ে পুলিশও।

কর্ণফুলী তৃতীয় শাহ আমানত সেতু ২ লেনের ছিল । যা বর্তমানে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে ফোর লেন মহাসড়কে। যদিও তা সেতুর টোল প্লাজা হতে শিকলবাহা ওয়াই ক্রসিং পর্যন্ত এরপর নেই। এখন টোল প্লাজার সামনে ওজন নিয়ন্ত্রণ স্কেল বসানো হচ্ছে। ফলে আটকে পড়ে থাকবে অহরহ যানবাহন। সময় ক্ষেপণ করে গাড়ি ছাড় দেয়ার নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করার সম্ভাবনা ও উড়িয়ে দিচ্ছেনা পরিবহন শ্রমিক ও ড্রাইভারেরা। এতে সৃষ্টি হবে ভোগান্তি সহ তীব্র যানজট।

তথ্যমতে, বর্তমানে কর্ণফুলী তৃতীয় সেতুর টোল আদায় করছে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ কোম্পানি ইউডিসি-ভ্যান জেভি। এ কোম্পানির আওতায় টোল আদায়, ব্যবস্থাপনা এবং এক্সেল লোড সিস্টেম পরিচালনার কাজ চলছে। কার্যাদেশ মতে, প্রতিষ্ঠানটি ৩ বছর এ দায়িত্বে থাকবেন।

যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ সহ ইউডিসি-ভ্যান জেভি কোম্পানীর উদ্দেশ্য হল এক্সেল লোড সিস্টেম স্থাপিত হলে মহাসড়কের সুরক্ষা বাড়বে, কমবে অতিরিক্ত পণ্য বোঝাই যানবাহনের সংখ্যা। কিন্তু জনগণ বলছে ভিন্ন কথা । তারা ভাবছেন সুফলের চেয়ে জনভোগান্তি বেশি হবে।

চট্টগ্রাম জেলা সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হয় কর্ণফুলীর নদীর উপর তৈরী শাহ আমানত সেত তৃতীয় সেতু। বাংলাদেশ ও কুয়েত সরকারের যৌথ অর্থায়নে ৩৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে, ৯৫০ মিটার দৈর্ঘ্য, ৪০ দশমিক ২৪ মিটার প্রস্থের সেতুটি নির্মাণ করে চীনের মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন। এটি বাংলাদেশের প্রথম এক্সেটার ডোজ সেতু।

ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সুত্রে জানা যায়, তারা এক্সেল লোড সিস্টেম স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। টোল প্লাজার পাশেই ৬টি এক্সেল লোড কন্ট্রোল মেশিন বসানো হবে। কিছুদিনের মধ্যে তা চালু হবে বলে আশা প্রকাশ করছেন।

একটি সাধারণ ছয় চাকার ট্রাকের ওজন বহন ক্ষমতা সর্বোচ্চ ১৫ টন হলেও ওই সড়কে চলাচলকারী ট্রাকগুলো ১৮ থেকে ২৪ টন পর্যন্ত মালামাল নিয়ে চলাচল করছে। এতে সড়কের আয়ু রাতারাতিই কমে যাচ্ছে। এজন্য যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীনে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

এদিকে ব্যবসায়িরা মনে করেন এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণে পরিমাপক যন্ত্র বসানো হলে কক্সবাজার ও আনোয়ারা, কর্ণফুলীর বড় বড় মিল কারখানা ও গার্মেন্টস থেকে পণ্য আনা-নেওয়ার খরচ বেশি পড়বে। যা অন্য জেলায় কম হবে। সরকার যদি সারাদেশের প্রধান সড়কগুলোতে একই নিয়ম চালু করে সেক্ষেত্রে কোন সমস্যা ছিলনা। কিন্তু চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারবাসীর জন্য আলাদা নিয়ম কেন এমন প্রশ্ন অনেকের!

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে পরিমাপক যন্ত্র বসবে আর অন্য কোন সড়কে বসবে না, এতে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের মাঝেও তখন চাপা ক্ষোভ বিরাজ করবে। দেশের অন্য কোনো মহাসড়কে ওজন নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে চট্টগ্রাম অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছেন কিনা এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কিনা তাও ভেবে দেখার দাবি জানান মন্ত্রণালয়ের কাছে। এতে মহাসড়কে এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণে পণ্য পরিবহনে বাধ্যবাধকতা শিথিল করা প্রয়োজন বলেও মত প্রকাশ করেন ব্যবসায়িরা।

ডায়মন্ড সিমেন্ট কোং লিমিটেড এর পরিচালক আলহাজ্ব আজিম আলী বলেন, মহাসড়কের সুরক্ষা ব্যবসায়ীরা ও চায়। সরকার যদি স্কেল বসায় তাতে ব্যবসায়ীদের আপত্তি থাকার কথা না। তবে সারা দেশে যেন একই নিয়মে ওজন নিয়ন্ত্রণ কার্যকর হয় দ্বিমুখী নিয়ম যেন নাহয়।’

প্রসঙ্গত, এরপুর্বে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বড় দারোগাহাট ও কুমিল্লার দাউদকান্দিতে ওজন পরিমাপক যন্ত্র স্থাপন করায় পণ্য পরিবহনে ১৩ টনের বেশি পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে পরিবহন ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। অন্যদিকে, আইনি জটিলতায় গ্রাহক বা সাধারণ ডিলার বা পাইকাররা চট্টগ্রাম থেকে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করার ক্ষেত্রে আগ্রহ কমেছে। ব্যবসায়ীদের মাঝে অসন্তোষ ও ক্ষোভ ছিল।

এমতাবস্থায় পুনরায় চট্টগ্রাম দক্ষিণ অঞ্চলে উৎপাদিত ও আমদানিকৃত পণ্য সামগ্রীর সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা এবং ব্যবসায়ীবৃন্দের আর্থিক ক্ষতি নিরসনের জন্য মহাসড়কে পণ্য পরিবহনে এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণ ওজন স্কেল ব্যবহার কতটা যুক্তিযুক্ত তা পুনরায় ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন।

ইউডিসি-ভ্যান জেভি এর পরিচালক (অপারেশন) অপূর্ব সাহা জানান, কিছুতেই দুই নিয়মে স্কেল কার্যকর হবেনা। সারা দেশের নিয়মে তা চলবে। আমাদের এক পাশে মেশিন বসানো শেষ অপর পাশে কাজ চলছে। আগামী মাসের ১ তারিখ চালু হবে।’

২০১৬ সাল থেকে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় ওজন নিয়ন্ত্রণ কার্যকরের চেষ্টা চালায়। এর পর বিভিন্ন সময়ে ওজন নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়া হলেও আপত্তি জানান পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা। গত ডিসেম্বর থেকে এটি পুরোপুরি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। বর্তমানে ১৩ টনের বেশি পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।

বর্তমানে এ নিয়ম লঙ্ঘন করলেই পণ্যবাহী পরিবহনগুলোকে উৎসস্থলে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। তবে অতিগুরুত্বপূর্ণ যানবাহনের ক্ষেত্রে নির্ধারিত এক্সেলের অতিরিক্ত পণ্যের প্রতি টনের জন্য ৫ হাজার টাকা করে জরিমানা আদায় করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে পণ্য লোডিংয়ের উৎসমুখে এক্সেল লোডের নির্দেশনা মেনে চলতে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কাছেও অনুরোধ জানিয়েছে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়।