ইমাম খাইর, সিবিএন:
পর্যাপ্ত লবণ মজুদ থাকার পরও সংকট তৈরি করে লবণ আমদানির পাঁয়তারা চালাচ্ছে এক শ্রেণীর অসাধু মিল মালিক। অথচ গত ২৫ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারে বিসিকের এক কর্মশালায় শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ‘এই মুহুর্তে লবণের সংকট নেই, অমদানি করা হবেনা’ ঘোষণা দেন। অবশ্য শিল্পমন্ত্রী আশ্বাস দেন লবণ চাষি, মিল মালিক ও বিসিকের সমন্বয়ে মাঠ পর্যায়ে যাচাই-বাছাইয়ের পর সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।
অভিযোগ এসেছে, নিজেদের ‘পেটমোটা’ করতে আমদানিকারক একটি সিন্ডিকেট আবারো সক্রিয় হয়ে ওঠেছে। সেই সিন্ডিকেটের বেশ কয়েকজন গত কয়েক দিন ধরে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে নানামুখি তদবির চালাচ্ছে। দেশীয় শিল্প ধ্বংস করে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করতে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছে। বিসিক বলছে, দেশে ১ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিকটন লবণ মজুদ আছে। লবণ চাষিদের দাবী, ৫ লাখ মেট্রিক টনের বেশি লবণ মাঠে অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে আছে। কোন সংকট নেই। মিলারদের সিংহভাগ লবণ আমদানির কড়া প্রতিপক্ষ।
এদিকে লবণের চাহিদা মজুদ নিরূপণের লক্ষ্যে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছে বিসিক। ২৬ সেপ্টেম্বর মহাব্যবস্থাপক মোঃ মাজহারুল ইসলাম স্বাক্ষরিত কমিটিতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মাহিদুর রহমান আহবায়ক ও বিসিক কক্সবাজারের লবণশিল্পের উন্নয়ন কর্মসূচির উপ-মহাব্যবস্থাপক দিলদার আহমদ চৌধুরীকে সদস্য সচিব করা হয়েছে।
কমিটির সদস্যরা হলেন- লবণ চাষি কল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কায়ছার ইদ্রিস, কক্সবাজার লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি রইছ উদ্দিন ও ইসলামপুর লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি মোঃ শামসুল আলম আজাদ। এদের মধ্যে একজনই আমদানির পক্ষে বলে জানিয়েছে লবণ মিল মালিক ও চাষিরা।
সুত্র মতে, সমুদ্রের লবণাক্ত পানি জমিয়ে সূর্যের কড়া রোদে পানি শুকিয়ে লবণ তৈরি করা হয়। কক্সবাজার, চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপজেলা (আংশিক)সহ ৬৪ হাজার ১৪৭ একর জমি রয়েছে। ৫৫ হাজারের বেশি চাষি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে লবণ উৎপাদন করে। কিন্তু দালাল, ফঁড়িয়া ও আমাদনির চক্রে বারবার ন্যায্যমূল্য বঞ্চিত চাষিরা। মাঠ পর্যায়ে চাষিদের কাছ থেকে স্বল্পমূল্যে লবণ কিনে অধিক মুনাফা করছে মধ্যস্বত্ত্বভোগি ও মিল মালিকরা। পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অসাধু একটি চক্র। সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে বসে এনে লবণ আমদানি করে। আমদানির পাঁয়তারা চালাচ্ছে এক শ্রেণির অসাধু মিল মালিক। অথচ আগামী নভেম্বর থেকে পুরোদমে লবণ মৌসুম শুরু।
মহেশখালী, চকরিয়া, ইসলামপুর, টেকনাফ, পেকুয়ার অন্তত ১০টি এলাকায় খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, এখানে প্রচুর পরিমাণ লবণ মজুদ আছে। উৎপাদনমূল্য না পাওয়ায় চাষিরা লবণ বিক্রি করছেনা। চাষিরা জানায়, যে লবণ গত এক মাস আগে বস্তাপ্রতি ৭৮০ টাকায় বিক্রি হতো সে লবণ বর্তমানে ৭০০ থেকে ৭২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চাহিদার তুলনায় যোগান বেশি হওয়ায় লবণের দাম নি¤œমুখি। বাজারে লবণের সরবরাহ ঠিক আছে। কোথাও ঘাটতি নেই।
ইসলামপুর লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি মোঃ শামসুল আলম আজাদ বলেন, ফঁড়িয়ারা ছাড়া অধিকাংশ মিল ও মাঠে প্রচুর লবণ মজুদ আছে। বিসিকের রিপোর্ট মতে ১ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন লনণ জমা আছে। ঘাটতির কোন অশংকা নেই। এরপরও লবণ শিল্পের ক্ষতি হয় এমন কোন সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত হবেনা।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) কক্সবাজারের লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্প কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে দেশে লবণের চাহিদা ছিল ১৫ দশমিক ৭৬ লাখ মেট্রিকটন। এই মৌসুমে উৎপাদন হয়েছে ১৩ দশমিক ৬৪ লাখ মেট্রিকটন। এ হিসাবে চাহিদার তুলনায় লবণের ঘাটতি ছিল ২ লাখ ১২ হাজার মেট্রিকটন। সেই বছর ৫ লাখ মেট্রিকটন আমদানি বাদে ২ লাখ ৮৮ মেট্রিকটন উদ্বৃত্ত থাকে।
২০১৮ সালে ১৬ লাখ ২১ হাজার মেট্রিকটন লবণ চাহিদা ছিল। এই বছর ১৪ লাখ ৯৩ হাজার মেট্টিকটন লবণ উৎপাদন হয়। ঘাটতি থাকে ১ লাখ ২৮ হাজার মেট্টিকটন। ২০১৭ সালের উদ্বৃত্ত ২ লাখ ৮৮ মেট্রিকটন বাদে বর্তমানে ১ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিকটন লবণ চাহিদার তুলনায় উদ্বৃত্ত রয়েছে।
ইসলামপুরের লবণ চাষি ফরিদুল আলম বলেন, দেশে চাহিদা অনুযায়ী প্রচুর পরিমাণ লবণ উৎপাদন হওয়ার পরও তারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে লবণ আমদানি করতে চাচ্ছে। মাঠে প্রচুর অবিক্রিত লবণ আছে। যা মৌসুম শুরু হয়েও বাঁচবে।
তবে কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত সভায় শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বক্তব্যে প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, লবণ চাষি, মিল মালিক ও বিসিকের সমন্বয়ে মাঠ পর্যায়ে যাচাই-বাছাইয়ের পর সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।
তিনি বলেন, লবণ চাষী, লবণ মালিক, বিসিকের প্রতিনিধি, মিল মালিক, বিসিকের প্রতিনিধি- এদেরকে নিয়ে মনিটরিং করা হবে। মনিটরিং করে যেটা সঠিক মনে হবে- সেভাবেই আমরা পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।
লবণের চাহিদা মজুদ নিরূপণে গঠিত ৫ সদস্যের কমিটির আহবায়ক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মাহিদুর রহমান বলেন, মিল ও মাঠের তথ্য যাচাই করে প্রতিবেদন দিতে বিসিককে বলা হয়েছে। সেই প্রতিবেদনের আলোকে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে, দেশের ক্ষতি হয় এমন কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হবেনা।
বিসিক কক্সবাজারের লবণশিল্পের উন্নয়ন কর্মসূচির উপ-মহাব্যবস্থাপক দিলদার আহমদ চৌধুরী বলেন, মিল ও মাঠের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। শীগ্রীই প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে।