ছফওয়ানুল করিম, পেকুয়া থেকে:
আরেফিন জন্নাত শিবলী (১৫)। চকরিয়া উপজেলার বিএমচর ইউনিয়নের বহদ্দারকাটা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণির মেধাবী ছাত্রী। আর দশজন শিক্ষার্থীর মতো তারও জীবনের স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা করে সেও একদিন বড় হয়ে ডাক্তার হবে। দেশের এবং দেশের মানুষের সেবা করবে। কিন্তু বিধিবাম, সেই স্বপ্ন কাতর মেয়েটির জীবনের সব স্বপ্ন আটকে আছে দরিদ্র বাবার পলিথিন ঢাকা ভাঙা ঘরের মাটির বিছানায়। তার একটাই কারণ মেয়েটির হাঁটুতে ধরা পড়েছে বোন ক্যান্সার। আরেফিন জন্নাত চকরিয়া উপজেলার ভেওলা মানিকচর (বিএমচর) ইউনিয়নের দক্ষিণ বহদ্দার কাটা ৪ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মোহাম্মদ শফি ও মা রেনুআরা বেগমের ৩য় কন্যা।
মা রেনুআরা বেগম জানান, “৯ম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার মাসখানেকও পার হয়নি। প্রতিদিনের মতো সেদিনও বই, খাতা, কলম নিয়ে স্কুলে যায় আরেফিন জন্নাত। স্কুল থেকে ফেরার পথেই অনুভব হয় তার হাঁটুর প্রচন্ড যন্ত্রণা। পরদিন থেকে আর স্কুলে যেতে পারেনি সে। কয়েকদিনে যন্ত্রণা তীব্র আকার ধারণ করলে চট্টগ্রামের ডাক্তারদের কাছে নিয়ে গেলে তারা বলেছে মেয়েটির হাঁটুতে ক্যান্সার।” পিতা মোহাম্মদ শফি কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, “আমি এমন এক হতভাগ্য বাবা যে কিনা সারারাত মেয়ের ব্যথার যন্ত্রণার আহাজারি শুনি কিন্তু মেয়ের জন্য কিছুই করতে পারিনা। আমি গরীব মানুষ। বয়সও হয়েছে। কাজ করতে পারিনা। আমার থাকার ঘরটি পর্যন্ত নেই। পরিবারের ৮ সদস্যের আহার জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছি। তবুও আমি চেষ্টা করেছি আমার মেয়েদের পড়ালেখা করাতে। কিন্তু বিধিবাম আমার মেয়ে আরেফিন এখন বোন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। মানুষের সাহায্য নিয়ে অর্ধেক চিকিৎসা করালেও অর্থের কারণে সঠিক সময়ে কেমো থেরাপি গুলোও দিতে পারছিনা এখন। এভাবে চলতে থাকলে আমার মেয়েটি চোখের সামনেই মরে যাবে…” বলে উচ্চস্বরে কেঁদে উঠেন তিনি।
ক্যান্সার আক্রান্ত মেধাবী ছাত্রী আরেফিন চিকিৎসাপত্রগুলো নিয়ে দেখা যায়, সে এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের রেডিওথেরাপী বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা: এম এ আউয়ালের তত্বাবধানে চিকিৎসা নিচ্ছে। দীর্ঘ ৭ মাস ধরে তিনি চিকিৎসা চালিয়ে গেলেও তার দেয়া ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী কেমোথেরাপি গুলোও ঠিকমত দিতে পারছেননা দরিদ্র পিতা শফি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মো: শফি ৪ মেয়ে ২ ছেলেকে নিয়ে থাকেন একটি ভাঙা ঝুপড়ি বাড়িতে। ঘরের চালা ভেঙে যাওয়ায় পলিথিন দিয়ে ঢেকে কোনরকম রোদ বৃষ্টি থেকে রক্ষা করেছেন। ঘরের ভিতরে গিয়ে দেখা যায়, ঘরে কোন আসবাবপত্র নেই। মাটি দিয়ে বানিয়েছেন বিছানা। এখন এ মাটির বিছানায় শুয়ে বসেই কাটছে মেধাবী ছাত্রী স্বপ্নকাতর আরেফিনের জীবন। কখনো কখনো ব্যথার যন্ত্রণা সইতে না পেরে চিৎকার করে আহাজারি করেন। কখনো নিরবে চোখের পানি ফেলেন। মা রেনুআরা বেগম আর ছোটবোন আশরাফুল জন্নাত সবসময় থাকেন তার পাশেই।
তুমি পড়ালেখা করে কি হতে চাও জানতে চাইলে ভেজা চোখে কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল থাকিয়ে থেকে জবাব দেয় আরেফিন। বলেন, “আমার স্বপ্ন ছিল আমি পড়ালেখা করে বড় হয়ে ডাক্তার হব। গরীব রোগীদের ফ্রী চিকিৎসাসেবা দেব। দেশের মানুষের সেবা করব। কিন্তু এখন আমার সব স্বপ্ন আটকে আছে এ বিছানায়। যদি আল্লাহর রহমতে সুস্থ হতে পারি তাহলে আবার স্কুলে যাব, মন দিয়ে পড়ালেখা করব।”
হতভাগা পিতা শফির ২ ছেলে ৪ মেয়ে। কিছুদিন হল প্রথম ছেলে বিয়ে করে শ্বশুড় বাড়িতে চলে গেছে। আরেক ছেলে কক্সবাজারের একটি হোটেলে চাকরি করে কোনরকম সংসার চালাচ্ছে। ৪ মেয়ের সবার বড় জন্নাতুন নঈম পড়ছেন এইচ এসসি ২য় বর্ষে। টিউশনি করে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে সে। ২য় মেয়ে জন্নাতুল বকেয়া পড়ে পেকুয়া শহীদ জিয়াউর রহমান উপকূলীয় কলেজের প্রথম বর্ষে। পেকুয়ার এক বাড়িতে লজিং থেকেই নিজের পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে সে। ৩য় মেয়ে আরেফিন জন্নাত ক্যান্সার আক্রান্ত। আর চতুর্থ মেয়ে আশরাফুল জন্নাত পড়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে। পিতা শফি ও মাতা রেনুআরা এখনো আশায় আছেন, তাদের মেয়ে সঠিক চিকিৎসা পেলে সুস্থ হয়ে উঠবে। এজন্য দেশের দানশীল বিত্তবানদের সাহায্যও কামনা করেছেন তিনি। এলাকার লোকজন জানান, দেশের বিত্তবানরা যদি একটুখানি দয়ার হাত বাড়ান তাহলে একটি মেধাবী মেয়েকে বাঁচানো সম্ভব হবে। অন্যথায় চোখের সামনেই পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে একটি মেধাবী মুখ।