সরকার ও ইউনিসেফের সিদ্ধান্ত উপেক্ষিত

জনকন্ঠ:
বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা প্রদানে সরকার গৃহীত সিদ্ধান্ত মানা হচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে নানা মহলে আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা না গেলে ভবিষ্যতে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা এসব শিশু ও পালিয়ে আসার পর এদেশে জন্ম নেয়া শিশুদের নিয়ে বড় ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে বর্তমানে উখিয়া-টেকনাফের ৩০ রোহিঙ্গা শিবিরে ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশু রয়েছে। এছাড়া গত ১ বছরে নবজাতক এসেছে বহু। যে সংখ্যা ইউনিসেফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৫০ সহ¯্রাধিক।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে সরকারের উচ্চ মহলের নির্দেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানে দেড় হাজার লার্নিং সেন্টার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে এসব লার্নিং সেন্টারে মিয়ানমারের রাখাইন ও ইংরেজী ভাষায় শিক্ষা দেয়া হবে। বিশ্ব ব্যাংকের বরাদ্দকৃত ২৫ মিলিয়ন ডলার অনুদানের অর্থে এ কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এর মধ্যে অর্ধেক অর্থ রোহিঙ্গা শিশুদের লার্নিং সেন্টার স্থাপন ও পরিচালনা এবং বাকি অর্ধেক অর্থে রোহিঙ্গাদের বসবাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চলে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবকাঠামো ও বিদ্যালয়ের যাতায়াতের সড়ক সংস্কার নিয়ে। পুরো কার্যক্রমটির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে।

কিন্তু তার আগেই কিছু সংখ্যক এনজিও পরিচালিত প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রোহিঙ্গা শিশুদের বাংলাদেশী পাঠ্যপুস্তক দিয়ে শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে। সরকারী সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে এসব এনজিও পরিচালিত শিক্ষালয়ে রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যা ভবিষ্যতে দেশের জন্য ক্ষতির দিকটি ডেকে আনার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে এসব শিশুরা নিজেদেরকে এদেশে থেকে যাওয়ার প্রত্যয়ে রয়েছে।

এদিকে, আশ্রিত রোহিঙ্গারা যেহেতু মিয়ানমারের নাগরিক, সেক্ষেত্রে প্রত্যাবাসন শুরু হলে তাদেরকে নিজ ভূমে ফিরে যেতে হবে। তখন এসব রোহিঙ্গা শিশুদেরও তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে এদেশ ত্যাগ করতে হবে। তাই তাদের জন্য রাখাইন তথা বার্মিজ ভাষা অপরিহার্য। ইংরেজী শেখানোর বিষয়টি ইতিবাচক। কিন্তু মিয়ানমারে ফিরে গেলে বাংলা সিলেবাসের ভাষা অর্জন তাদের কোন কাজে আসবে না। অভিযোগ উঠেছে, অতি উৎসাহী কিছু এনজিও তাদের স্কুলগুলোতে রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরদের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সিলেবাস অনুযায়ী শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, যা সরকারী সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে। এর ফলে এসব রোহিঙ্গা শিশু-কিশোররা বাংলাদেশী সিলেবাসে শিক্ষা গ্রহণ করে ভুয়া ঠিকানার মাধ্যমে এদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ নেবে। যা আগামীতে প্রত্যাবাসনকালে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে। ইতোমধ্যেই উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত হওয়ার পর সহ¯্রাধিক শিশু-কিশোর কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে পটিয়া ও হাটহাজারীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিছু রোহিঙ্গা শিশু-কিশোর লেখাপড়ার সুযোগ পেয়ে গেছে। ভুয়া নিবন্ধন জমা দিয়ে তারা এসব সুযোগ নিয়েছে বলে ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। অপরদিকে, এসব রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরদের নামে প্রতিনিয়ত রেশম সামগ্রী সরবরাহ হচ্ছে আশ্রয় শিবিরগুলোতে। এখানে বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য পুরনো রোহিঙ্গা নেতাদের পরিচালনাধীন মাদ্রাসা এবং এতিমখানায় এ জাতীয় শিশু-কিশোরদের সংখ্যা বেশি। ওইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রিত রোহিঙ্গা মৌলবিদেরও শিক্ষক হিসেবেও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। টেকনাফের মোচনি-২ ক্যাম্পে রোহিঙ্গা বিদ্রোহী সংগঠনের সঙ্গে জড়িতরা অবৈধভাবে দাওরায়ে হাদিস মাদ্রাসা করেছে। এই মাদ্রাসার মূল দায়িত্বে রয়েছে একই ক্যাম্পের রোহিঙ্গা মৌলবি মোঃ ইয়াছিন। কিছুদিন আগে কক্সবাজার সদর মডেল থানার অদূরে একটি হোটেলে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের সঙ্গে গোপন বৈঠককালে পুলিশ মৌলবি ইয়াছিনসহ ৬ সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করে। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যে এরা ছাড়া পেয়ে যায়। এছাড়া উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পেও পুরনো রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের সঙ্গে জড়িতদের অর্থায়নে একটি মাদ্রাসা খোলা হয়েছে। রোহিঙ্গা শিবির অভ্যন্তর ছাড়াও পুরনো রোহিঙ্গা নেতাদের পরিচালনায় কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় শিক্ষকতায় নিয়োজিত রয়েছেন রোহিঙ্গা মৌলবিরা। যা এদেশের ভুয়া ঠিকানায় কাজ করছে। শুধু তাই নয়, এ পুরনো রোহিঙ্গাদের অনেকেই দেশের বিভিন্নস্থানের মাদ্রাসা ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সার্টিফিকেটও হাতিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন।

এখানে আরও উল্লেখ্য, ১৯৭৮ সালে যেসব রোহিঙ্গা দেশে অনুপ্রবেশ করে শরণার্থীর মর্যাদা পেয়েছে এদের সন্তানদের অনেকে ইতোমধ্যে এদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ডিগ্রীর সনদ নিয়েছে। এদের মধ্যে অনেকে স্থায়ী বসতি গড়ে তুলেছে। পূর্বে আসা রোহিঙ্গাদের অনুসরণে গেল বছর থেকে গত এক বছরে আসা আশ্রিত রোহিঙ্গারা তাদের শিশু-কিশোরদের দেশীয় সিলেবাসে শিক্ষার্জনে ব্যাপক তৎপর। জিয়াবুল নামের এক পুরনো রোহিঙ্গা নেতা বিদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ এনে এ জাতীয় কাজে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। মোঃ আলী নামের এক রোহিঙ্গা সৌদিআরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে অর্থ জোগাড় করে হুন্ডির মাধ্যমে নিয়ে আসার অভিযোগ রয়েছে।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, চট্টগ্রামে হালিশহরে বসবাসকারী দ্বীন মোহাম্মদ নামের জামায়াতের এক পৃষ্ঠপোষক বিদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে প্রতিনিয়ত এসব মৌলবাদীদের জন্য অর্থ এনে থাকে। এ দ্বীন মোহাম্মদও এখন রোহিঙ্গাদের নামে বিদেশ থেকে অর্থ আনার কাজে লিপ্ত রয়েছে। তার যত ব্যাংক এ্যাকাউন্ট আছে সবগুলো তল্লাশি হলে বেরিয়ে আসবে অবৈধ অর্থ জমা ও তোলার চিত্র।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একটি স্কুলে দায়িত্ব পালনকারী নাম প্রকাশ না করা শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, টেকনাফের নয়াপাড়া ও উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে ২৭ বছর ধরে বসবাসরত এবং মিয়ানমারের প্রত্যাবাসনে অপেক্ষমাণ রোহিঙ্গা পরিবারের অসংখ্য শিশু-কিশোর বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজী, সমাজবিজ্ঞান ইত্যাদি বই পড়ে শিক্ষা অর্জন করেছে। আবার এদের অনেকেই এনজিও পরিচালিত একাধিক স্কুলে স্থানীয়দের শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষকতাও করছে। এসব রোহিঙ্গারা এখন থেকে বলতে শুরু করেছে তাদের অনেকে পিতামাতার জন্য এদেশে। তারাও এদেশে জন্ম নিয়েছে। তাই তারা বার্মিজ ভাষায় শিক্ষা নিতে রাজি নয়। সঙ্গত কারণে আলোচনায় এসেছে এসব রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যতে প্রত্যাবাসনের আওতায় আনা যাবে কি না।
খবর জনকন্ঠের।।
সরকারী সূত্রে জানান হয়েছে, রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা প্রদানে শিক্ষক নিয়োগ দেবে ইউনিসেফ। এসব রোহিঙ্গা শিশুদের কোনভাবে বাংলাদশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ দেয়া যাবে না। এ নিয়ে গত সেপ্টেম্বরের শুরুতে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আর্থিক দিক নিয়ে চুক্তিও হয়েছে। কিন্তু এসব নিয়মকানুন কিছুই মানা হচ্ছে না। যা এদেশের জন্য উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। স্থানীয়দের পক্ষ থেকে জানান হয়েছে, বহু পূর্বে আসা এবং সম্প্রতি বছরগুলোতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা এ অঞ্চলের স্থায়ী বাসিন্দাদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে মিশে যাচ্ছে। এদেশের সরকার এদের প্রত্যাবাসনে যতই তৎপর হয়ে আছে মিয়ানমার ততই কালক্ষেপণ করছে। এই কালক্ষেপণের অন্তর্নিহিত রহস্যের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রোহিঙ্গাদর বাঙালী হিসেবে বিশ্ব দরবারে প্রমাণ করা। অথচ বিষয়টি হবে জঘন্য মিথ্যাচারীর শামিল। ওরা মিয়ানমারেরই নাগরিক। রাখাইন রাজ্যে ছিল বসতি। পালিয়ে এসেছে প্রাণ রক্ষার্থে। বাংলাদেশ মানবিক কারণে এদের আশ্রয় দিয়েছে এবং প্রাণে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ববোধ থেকে ত্রাণ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে মাত্র।