জাকারিয়া আলফাজ, টেকনাফ:
টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ ১০৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলছে পুরোদমে। চলতি বছরের শুরুতে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ইতোমধ্যে বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ অংশসহ এক কিলোমিটারের কাছাকাছি বাঁধ নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের পূর্বে কাজ শেষ করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন নৌ বাহিনীর ডকইয়ার্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড কনস্ট্রাকশন লিমিডেট এবং তাদের সহযোগি প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়েছেন এসএস ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। দ্বীপ রক্ষার এই বেড়িবাঁধ নির্মাণে অগ্রগতিতে আনন্দের শেষ নেই এ জনপদের অর্ধলক্ষাধিক মানুষের।

শাহপরীর দ্বীপের সাগরতীরবর্তী মাঝের পাড়ার বাসিন্দা ষাটোর্ধ বৃদ্ধ সোলতান আহমদ বলেন, ‘বেড়িবাঁধ ভেঙে মানুষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। আমাদের আশে পাশের শত শত ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গিয়েছিল। বাঁধ ভেঙ্গে জোয়ারের পানি এখানকার মানুষের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে দিন দিন আরো মানুষের ঘরবাড়ি গ্রাস করছিল। এমতাবস্থায় ১০৬ কোটি টাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ায় আমাদের বাড়ি ঘর রক্ষা পাওয়া সম্ভব হয়েছে। একসময় আমাদেরও এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার উপক্রম হলেও এখন বাঁধের কাজ দেখে মনে হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এ জনপদ বসবাসের জন্য অনেকটা নিরাপদ।’

গত ২০১২ সালের ২২ জুলাই দ্বীপের পশ্চিমের বেড়িবাঁধের অংশবিশেষ বঙ্গোপসাগরের জোয়ারে বিলীন হয়ে যায়। ওই সময়ে তড়িৎ কোন উদ্যেগ না নেওয়ায় প্রায় আড়াই কিলোমিটার বাঁধ বিলীন হয়ে দ্বীপের একাংশ অরক্ষিত হয়ে পড়ে। প্রতিনিয়ত বঙ্গোপসাগরের জোয়ারে প্লাবিত হয়ে শতশত মানুষের ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস হয়ে যায়। লোকালয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম টেকনাফ- শাহপরীর দ্বীপ সড়কের প্রায় চার কিলোমিটার সড়ক বিলীন হয়ে যায়। এভাবে পুরো জনপদটি পরিণত হয়ছিল ধ্বংসস্তুপে, জোয়ার ভাটার বৃত্তে বন্দি ছিল দ্বীপবাসী।

বেড়িবাঁধের দাবিতে তীর্থের কাকের মতো দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর গত ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সভায় শাহপরীর দ্বীপ বেড়িবাঁধ নির্মাণে ১০৬ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন লাভ করে। প্রকল্পটি অনুমোদন লাভ করায় আশায় বুক বাঁধে শাহপরীর দ্বীপের অর্ধলক্ষাধিক মানুষ এবং দাবি জানায় টেকসই ও সুষ্ঠু কাজের স্বার্থে নৌ বাহিনীর অধীনে কাজটি সম্পন্ন করার। শেষ পর্যন্ত কাজের দায়িত্ব পান বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর ডকইয়ার্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড।

নৌ বাহিনীর ডকইয়ার্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেড এবং তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসএস ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড কনস্ট্রাকশন বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করেন। বর্ষার আগ পর্যন্ত বিরতিহীন ভাবে চলা বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজে ইতোমধ্যে বাঁধের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ খালের মুখ বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কাজ শেষ হয়েছে। বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়াতে বাকী অংশের কাজও শুরু হয়েছে। যদিও বর্ষায় ধীর গতি থাকলে বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে আবারও পুরোদমে চলছে বাঁধ নির্মাণের কাজ।

বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর ডকইয়ার্ড এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিঃ এর প্রতিনিধি লে. মোঃ ফারুক বলেন, ‘ বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজটি নৌবাহিনীর তত্ত্ববধানেই হচ্ছে। শুরুতেই আমরা বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ অংশের কাজ সফলভাবে শেষ করতে সক্ষম হয়। বাকী অংশটুকু দ্রুত গতিতে কাজের মাধ্যমে আগামী বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই বেড়িবাঁধের পুরো অংশের কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। আশা করি উক্ত সময়ের আগেই আমরা বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারবো।’

এদিকে বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে এলাকাবাসীও। দীর্ঘ ভোগান্তি শেষে স্বপ্নের বেড়িবাঁধ টেকসই ও সুষ্ঠুভাবে নির্মাণ হওয়াতে দ্বীপবাসীর উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। কারণ এ বেড়িবাঁধ নির্মাণ হলেই তাদের বসবাসের সম্ভাবনাটুকু জিইয়ে থাকার পাশাপাশি রক্ষা পাবে দ্বীপের শত শত একর ফসলি জমি, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।

দ্বীপের বাসিন্দা ও শাহপরীর দ্বীপ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব মৌলভী রশিদ উল্লাহ বলেন, ‘শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষ থেকে এ বেড়িবাঁধ আমাদের জন্য একটি অন্যন্য উপহার। দ্বীপবাসী তার কাছে ঋণি থাকবে আজীবন। আমাদের ভয় ছিল প্রতিবারই বেড়িবাঁধ হলে ব্যাপক অনিয়ম এবং দূর্নীতি হতো, কিন্তু এবারের বেড়িবাঁধটি সম্পূর্ণ দুর্নিতীমুক্তভাবে এবং টেকসই হচ্ছে বলে মনে হয়েছে।’

নৌ বাহিনীর ডকইয়ার্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড কনস্ট্রাকশন লিঃ এর সহযোগি ঠিকাদারি প্রতিষ্টান এসএস ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড কন্সট্রাকশন এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক উত্তম কুমার শাখারী (ননী বাবু) বলেন, ‘ বর্ষায় আমরা তেমন কাজ করতে না পারলেও নির্মিত অংশের সুরক্ষা এবং নতুন করে যাতে কোন এলাকা বিলীন না হয় সেদিকে খেয়াল রেখে বাঁধ অরক্ষিত এলাকায় জিও টেক্সটাইল দিয়ে আপদকালীন বাঁধ দেয়ার ব্যবস্থা করেছি। এতে বর্ষায় নতুন করে জনবসতি উচ্ছেদ রক্ষা পায়। এখন বর্ষা শেষ হয়েছে আমরা আবারো পুরো শক্তি নিয়ে কাজ শুরু করেছি।’

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কক্সবাজার এর উপ সহকারী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, ‘শাহপরীর দ্বীপে নির্মাণাধীন বেড়িবাঁধ প্রকল্পের কাজটি আমাদের পক্ষ থেকে নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত কাজের মান ভালো, অগ্রগতিও সন্তোষজনক। এখন বর্ষা মৌসুম কেটে গেলে বিরতিহীন ভাবে কাজ করা সম্ভব হবে। আশা করছি, আগামী বর্ষা শুরুর আগেই বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ পুরো অংশে শেষ করা সম্ভব হবে।’