শাহীন মাহমুদ রাসেলঃ

রামু হচ্ছে মূলতঃ ‘রম্যভূমি’ নামে খ্যাত। প্রাচীন বৌদ্ধ জনপদ এবং বৌদ্ধ বিহারের কারণে এর পরিচিতি ছিল আকাশছোঁয়া। শত শত বছরের প্রাচীন এসব বৌদ্ধ বিহার ও মন্দিরে হাজার বছরে হাজারো পুরাকীর্তির নিদর্শন। বিশ্বের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছাড়াও বৈচিত্রময় দৃষ্টিনন্দন বৌদ্ধ বিহারের কারণেই রামু ছিল বেশ পরিচিত ও সমাদৃত।

১৭০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত রামুর কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের সুপ্রাচীন মন্দিরের সাথে পুড়ে গেছে চার শতাধিক বুদ্ধমূর্তি, চারভাষায় অনূদিত ত্রিপিটক সহ অসংখ্য ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি। ৩০৬ বছরের পুরনো কাঠের তৈরী এ বিহারে রক্ষিত ছিল গৌতম বুদ্ধের পবিত্র অস্থি ধাতুসহ বহু মূল্যবান নিদর্শন। সবকিছু গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতের আগুনে নিঃশেষ হয়ে গেছে। সেই সাথে হারিয়ে গেছে বিশ্ব ঐতিহ্যের বহু স্মারক, বিরল সাংস্কৃতিক উপাদান। ঐদিন রাতে অনেক বুদ্ধমূর্তি লুট হয়ে গেছে। বছরের প্রায় সময়ই দেশি-বিদেশি পর্যটক ও ধর্মানুরাগীরা বিহারের এসব নিদর্শন দেখতে রামুর এ বিহারে ছুটে আসতো। রামুর সবকটি বিহারই মিয়ানমার থেকে আনা বিশেষ ধরনের কাঠ দিয়ে মিয়ানমারের কারিগর দ্বারাই অনিন্দ্য কারুকার্যে তৈরী হয়েছিল এবং কাঠের তৈরী প্রায় বিহারই ৩০০-৪০০ বছরের পুরনো। এশিয়ার সর্ববৃহৎ ১০০ ফুট সিংহশয্যা বুদ্ধমূর্তিটি নির্মিত হয়েছিল এ রামুতে। তারা এটিও ধ্বংস করতে চেয়েছিল, কিন্তু টেকসই নির্মাণশৈলীর জন্য তা ধবংস করতে পারেনি।

সেই ভয়াল বিভীষিকাময় ২৯ সেপ্টেম্বর। ২০১২ সালের এইদিনে কক্সবাজারের রামুতে ঘটে এক নারকীয় ঘটনা। একদল সংঘবদ্ধ দুষ্কৃতকারীদের হামলায় লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় ৩০০-৪০০ বছরের পুরনো ১৬টি বৌদ্ধ বিহারসহ অনেক প্রাচীন স্থাপনা। লুটপাট হয়ে যায় বুদ্ধমূর্তি সহ বহু মূল্যবান দুর্লভ সম্পদ। বৌদ্ধ বিহার ছাড়াও দুষ্কৃতকারীরা বিভিন্ন এলাকায় বসবাসরত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অর্ধ শতাধিক ঘরবাড়িতে লুটপাট চালায় ও অগ্নিসংযোগ করে। গভীর রাতে সংঘটিত দুষ্কৃতকারীদের এ নারকীয় তাণ্ডব সাধারণ মানুষ নির্বাক ও অসহায় তাকিয়ে দেখে। চোখের সামনেই নিমিষেই ধ্বংস হতে চলেছে তাদের পূজা-উপাসনার পবিত্র স্থান। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এ খবর প্রধান শিরোনাম হয়ে ভেসে আসে। প্রতিবাদে ফুঁসে উঠে বিশ্ববিবেক। বিশ্বের নানা স্থানে এ ঘটনায় বিক্ষোভ-প্রতিবাদের মাধ্যমে নিন্দা প্রকাশ করা হয়। শুধুমাত্র রামুতেই এ নারকীয় তাণ্ডবের সূচনা হলেও ঐ রাতেই মুহূর্তে তা ছড়িয়ে পড়ে কক্সবাজারের উখিয়াও। পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর দিন-দুপুরে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার লাখেরা ও কোলাগাঁও গ্রামের বৌদ্ধ বিহারগুলোতে হামলা চালানো হয়। আশ্চর্যের বিষয়, ঘটনার পরদিন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর রামুর ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময়কালীন দিন-দুপুরে পটিয়ায় দু’টি বৌদ্ধ বিহারে ভাঙচুর-লুটপাট করা হলো।

সংঘবদ্ধ দুষ্কৃতকারীরা বৌদ্ধদের উপাসনালয়, প্যাগোডা ও বৌদ্ধবসতিতে হামলা চালালো। ভাঙচুর-লুট হয়েছে অনেক মূল্যবান সম্পদ- বুদ্ধমূর্তি, পুরনো বইয়ের পাণ্ডুলিপি তথা হাজার বছরের বৌদ্ধ ঐতিহ্য। বিনষ্ট হয়েছে হাজার হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। টিভি মিডিয়া বা পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে এ ঘটনার ভয়াবহতা কতুটুকু তা বুঝা সম্ভব ছিলনা, যারা সরেজমিনে গিয়ে তা প্রত্যক্ষ করেননি। বর্বরতার ভয়াবহতা দেখে সেদিন নীরব কান্নায় চোখের জলে সিক্ত হয়েছিল প্রতিটি বিবেকবান ব্যক্তি। খোলা আকাশের নীচে তাণ্ডবলীলায় আক্রান্তদের হতবাক দশাই প্রকটভাবে চোখে পড়েছে। গভীর বেদনা থেকে উৎসারিত কান্না আর নির্বাক চোখে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কোন অভিব্যক্তি তাঁদের চোখে মুখে দেখা যায়নি। ঘটনার শিকার এক বৃদ্ধ মহিলার আকুতি ছিল “ আমরা তো শান্তিপ্রিয় জাতি, কারো কোন ক্ষতি তো করিনা। তবে আমাদের কেন এ পরিস্থিতিতে পড়তে হলো। কেন আমাদের ঘরছাড়া করলো। এভাবে অত্যাচার নির্যাতন করলো। আমাদের উপাসনার স্থানকে এভাবে কলংকিত ও ধ্বংস করার চেয়ে আমাদের গলায় যদি ছুরি দিত, তাও আমরা হাসিমুখে মেনে নিতাম”। উল্লেখ্য, বিহার-মন্দির ধ্বংসযজ্ঞের এ ভয়াবহতা সইতে না পেরে পরদিন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে রামুতে দু’জন ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। একজন ৬১ বছর বয়সী বৃদ্ধা, অন্যজন ৪৬ বছর বয়সী পুরুষ।

এবার আসল কথায় আসি। আমরা সবাই এক বাক্যে বুঝি এবং যা আমাদের মজ্জাগত স্বভাবে পরিণত হয়েছে, এদেশের আইন, শৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনী নিয়ে সংশয়। তাদের আচরণ ও ভূমিকা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ..! এ ঘটনায়ও এর সুস্পষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশ রামুর ঘটনার দিন পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সহ অনেকেই উসকানি-ইন্ধন দিয়েছে। স্থানীয় আক্রান্ত বৌদ্ধদের মতে, দীর্ঘ সময় ধরে চলা ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে পুলিশ ওয়াকিবহাল ছিল, তা না হলে কেন পুলিশ প্রশাসন কোন তড়িৎ পদক্ষেপ নিলো না..?

কিন্তু রাতের বীভৎসতা পার হয়ে প্রভাতের অরুণ আলোয় সহিংসতা ঠেকাতে ঘটনাস্থলে ছুটে আসে আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা। প্রশ্নবিদ্ধ হলেন এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত ও আতংকিত বৌদ্ধ জনসাধারণ। তাদের অভিযোগ, ঘটনার ভয়াবহতা রূপ নেওয়ার আগেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে এতটুকু ঘটার আশঙ্কা থাকতো না।

সরকারের মন্ত্রী-নেতারা বলেছেন, বৌদ্ধদের ওপর হামলার ঘটনাটি পূর্ব পরিকল্পিত। যেকোন মানুষের অবস্থাদৃষ্টে মনে হবে, পূর্ব পরিকল্পনা না থাকলে মুহূর্তের মধ্যে এত লোকজন সংগঠিত করা মোটেও সম্ভব ছিল না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দুষ্কৃতকারীরা কি এতই শক্তিশালী ছিল? একটি জনগোষ্ঠীর ওপর এমনতর আঘাত করার পরিকল্পনা সরকারের দায়িত্বশীল গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কিছুই আঁচ করতে পারল না..!

রামুর বৌদ্ধ বিহার ও প্যাগোডাগুলো পুননির্মাণ করার পরিকল্পনা করলেন সরকার। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে আধুনিক নির্মাণ শৈলী ও পুরনো ঐতিহ্যের মিশেলে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলো। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে পটিয়ার বৌদ্ধ বিহারগুলো সংস্কারের তেমন কোন ছোঁয়া আজো পরিলক্ষিত হয়নি। ইতোমধ্যে জার্মান সরকারের আর্থিক সহযোগিতায় ও স্থানীয় বৌদ্ধদের প্রচেষ্টায় ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনা সংস্কার ও পুননির্মান করা হচ্ছে।