বামে এককালের তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান মরহুম এভোকেট খালেকুজ্জামান , ডানে ছোট ভাই সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার সহিদুজ্জামান


ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মদ সহিদুজ্জামান :


সেপ্টেম্বর ২০০১ সাল। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ডামাডোলে উম্মাতাল দেশ। একদিকে দরিয়ানগর কক্সবাজারে সাগরের উত্তাল ঢেঁউ অন্যদিকে বি.এন.পির অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী এ্যাডভোকেট মোঃ খালেকুজ্জামান এর যাদুকরী নির্বাচনী প্রচারনায় মাতাল কক্সবাজার, আমরা বলি ক্লাইমেক্স বা পিক। ২৭ শে সেপ্টেম্বর ঈদগাও জনসভায় তিনি আবেগী ভাষায় বলেছিলেন “আপনাদের ভালবাসার ঋণ আমি ১০ বার জন্ম নিলেও শোধ করতে পারবোনা। শেষ জনসভায় আপনাদের সকলকে দাওয়াত দিলাম, আমার অনেক না বলা কথা আপনাদের বলবো।” এই মূল্যবান কথা ছিল তার প্রকাশ্যে জনসভায় শেষ বক্তব্য। তাঁর এই বক্তব্য বিশ্লেষন করলে আমাদের সামনে কিছু বিষয় পরিস্কার হয়। তিনি রাজনীতিকে মানুষের জন্য ভালবাসার মাধ্যম হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। প্রচলিত রাজনীতি দলকানা ও নেতান্ধ, মুখে জনগনের কথা বললেও ক্ষমতা ভোগ করার জন্য হেন কোন কর্ম নাই যা করতে কুন্ঠা বোধ করেন না। আজকাল একজন মেম্বার থেকে শুরু করে চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য নির্বাচনে মনোনয়ন পেতে সর্বোচ্চ চেষ্টা তদবির করেন। আর তখনই কমিন্টমেন্ট দল ও নেতাদের কাছে বাধা পড়ে। জনগনের ছায়াও দেখা যায়না। কঠিন এক শৃংখলের মধ্যে রাজনীতি ঘুরপাক খায়। নির্বাচনে নেতা জিতে দল জিতে আর জনগন পরাজিত হয় বার বার। কাগজ-কলমে ও জরিপে জ্বলজ্বল করে নেতাদের কীর্তি আর গভীর অন্ধকারে হারিয়ে যায় জনগন। কিন্তু ব্যতিক্রমি খালেকুজ্জামান জনগনকে উদ্ধুদ্ধ করেছিলেন তাদের আশা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে, তাদের ভালবাসাকে স্বীকৃতি দিতে। তাঁর কথার মধ্যে তোতা পাখির মত বারে বারে আউরে যাওয়া রাজনৈতিক বক্তব্য খুব কমই শুনতে পাওয়া যায়। উচ্চ শিক্ষিত, প্রতিভাবান, স্মার্ট ও পারদর্শী একজন খালেকুজ্জামান কিভাবে মাটি ও মানুষের মন জয় করল তা গবেষনার বিষয়। শুধু তাই নয় ধর্ম, বর্ণ ও ভিন্ন মতের সব শ্রেণীর হৃদয়ের মানুষ ছিলেন যা আমি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছি। যখন তার মরদেহ ২৮ শে সেপ্টেম্বর রাতে জামান ভিলায় রাখা হয়েছিল, আশেপাশে ছিল অগনিত খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। একজন কপালে সিঁধুর দেয়া সাদাশাড়ী পরা মহিলা লাশ থেকে কিছুটা দূরে মাতম করে কাঁদছিল। ভালবাসা নিংড়ানো এই কান্না শোকের যন্ত্রনাকে স্বান্তনার পরশ বুলিয়েছে।
নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : যখন আল্লাহ তাআলা কোন বান্দাকে ভালবাসেন তখন তিনি জিবরাঈল (আঃ) কে ডেকে কলেন নিশ্চই আল্লাহ তা’আলা অমুক বান্দাকে ভালবাসেন, তুমিও তাকে ভালবাসবে। তখন জিবরাইল (আঃ) ও তাকে ভালবাসবেন এবং তিনি আসমানবাসীদের নিকট ঘোষনা করে দেন যে, আল্লাহ তা’আলা অমুককে ভালবাসেন, অতএব তোমরাও তাকে ভালবাসবে। তখন আসমানবাসীরাও তাকে ভালবাসতে শুরু করেন। তারপর, আল্লাহ তা আল্লাহর তরফ থেকে যমিন বাসীদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা সৃষ্টি করা হয়। (বুখারী/৫৬০১-আবু হুরাইরা (রাঃ) বুখারী/২৯৭৪)। এই হাদিসটি জানার পর থেকে বার বার মনের মধ্যে একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে- খালেকুজ্জামানের ভালবাসার স্তর কি সেই সেই পর্যায়ে?
আরেকটু বিশ্লেষন করি । ২৭ শে সেপ্টেম্বর তিনি ঈদগাও জনসভায় সকলকে ২৯ শে সেপ্টেম্বর জেলে পার্কের মাঠের শেষ জনসভায় উপস্থিত হওয়ার জন্য আহবান জানিয়ে ছিলেন না বলা কথা শুনার জন্যে। এদিকে আবার আমাদের পরিবারের সদস্যদের ২৬ শে সেপ্টেম্বর থেকে তিনি জেলে পার্ক ময়দানে লক্ষাধিক মানুষের সমাগম নিশ্চিত করার জন্য তাগাদা দিয়েছেন। লক্ষাধিক জনসমাবেশ করতে হলে কয়েকশ যানবাহনের ব্যবস্থা করতে হবে কারণ তিনি বিশ্বাস করেন সাধারন মানুষ ২৯ শে সেপ্টেম্বর শেষ জনসভায় অংশগ্রহন করার জন্য মুখিয়ে আছে। তাই যানবাহন পেলে আনাচে কানাচে থেকে সবাই জনসভায় উপস্থিত হবে। ২৮ শে সেপ্টেম্বর যখন রামুর জনসভায় যাওয়ার প্রস্ততি নিচ্ছিলেন তখনো তিনি খুব জোর দিয়ে বলেছিলেন আমার লক্ষ মানুষ চাই। বিদায় বেলায় তার শরীরিক অবস্থা দেখে আমরা বাধা দিয়েছিলাম, তিনি তার উত্তরে বললেন- আমি গাড়ী করে জনসভায় যাব, সরাসরি মঞ্চে উঠব অর্থাৎ জনতার সাথে কোলাকুলি করব না (এর মধ্যে তিনি লক্ষাধিক মানুষের সাথে কোলাকুলি করেছেন) বক্তৃতা দিয়ে সেখান থেকে হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার দেখাব তারপর বাসায় আসব। কি সাবলিল ও অবলিলায় তিনি আমাদের শান্তনা দিয়ে গাড়ীতে উঠে পড়লেন এবং তার এই অলৌকিক কথাগুলো পর্যায়ক্রমে সত্য বলে প্রমানিত হল। তিনি গাড়ী থেকে হাত নেড়ে জনতার সাথে ভালবাসা বিনিময় করেছিলেন, মঞ্চের কাছাকাছি গিয়ে তিনি পড়ে পেলেন। তাকে ধরে মঞ্চে তোলা হল, তখন তিনি অচেতন। শুধু বক্তৃতা দেয়া হল না, হাজার মানুষের ভিড় ঠেলে যখন কক্সবাজার সদর হাসপাতালে পৌছলেন তখন মাগরিবের ওয়াক্ত। তারপর খালেকুজ্জামানের লাশ আসলো জামান ভিলার বাসায়। খবর প্রচার হওয়ার পর দিকবিদিক শূন্য হয়ে জামান ভিলায় ভিড় করল আর তার সেই না বলা কথা শুনার জন্যে ২৯ শে সেপ্টেম্বর লক্ষাধিক মানুষ জেলে পার্ক ময়দানে উপস্থিত হল। আমাদের আর কোন যানবাহনের ব্যবস্থা করা লাগেনি, কারণ মৃত খালেকুজ্জামান তার না বলা কথা, ভালবাসার কথা বুকের ভিতর জমা রেখে দুনিয়া থেকে হাসিমুখে বিদায় নিয়েছেন। আর তার মনের শেষ আকাংখা লক্ষাধিক মানুষ জানাযায় উপস্থিত হয়ে পূরন করেছে।
এখানে আমাদের পরিবারের কিছু কথা যোগ করি। আমরা ৪ ভাই ও এক বোন। বড় ভাই মোঃ হারুনুজ্জামান (যুক্তরাষ্ট প্রবাসী), মরহুম মোঃ খালেকুজ্জামান, মোঃ কামরুজ্জামান (অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী), আমি মোঃ সহিদুজ্জামান ও আমার ছোট বোন জাকিয়া আনাম। আমাদের গোষ্ঠির মধ্যে আমার পিতা ফরিদ আহমেদ ও মোঃ খালেকুজ্জামান জ্ঞান গরিমা ও প্রতিভায় শ্রেষ্ঠত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। আল্লাহ্র হুকুম দু’জনেই ৪৮ বছর হায়াত পেয়েছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর আমাদের রত্নগর্ভা মা রিজিয়া আহমেদ আমাদেরকে ভালবাসতে ও ধৈর্য্য ধরতে শিখিয়েছেন। আর মোঃ খালেকুজ্জামান চঞ্চু দিয়ে শুধু ভালবাসা সঞ্চিত করেছেন যা আপামর জনসাধারনের মধ্যে বিলিয়ে গেছেন।
ভালবাসা কত শক্তিশালী, কত বিস্তৃত আমাদের সামনে এরকম উদাহারন আর নেই। পরবর্তীতে সাধারণ জনগনের চাপে আমাকে নির্বাচনে দাড়াতে হল। দল থেকে নমিনেশন পেলাম না। আমি তখনও কক্সবাজারের জনগনের কাছে অজ্ঞাত, অখ্যাত। কিন্তু কক্সবাজারের মানুষের মাঝে খালেকুজ্জামানের প্রতি ভালবাসার তীব্রতা ও বিশ্বাস সমস্ত বাধা-বিপত্তি, ষড়যন্ত্র চুরমার করে কলাগাছের এক অলৌকিক আন্দোলন গড়ে তুলল। বিজয়ী হল স্বর্গীয় ভালবাসা। জনগনের ভালবাসা, খালেকুজ্জামানের ভালবাসা। আজ ১৭ টি বৎসর পার হল খালেকুজ্জামানের অফুরান ভালবাসা বহমান, হাজার হাজার নেতা-কর্মী, আম-জনতা বুকের মধ্যে লালন করে। অনুভবে জেগে উঠে “এত ভালবাসা কোথায় পাই।”


লেখক: মরহুম এড খালেকুজ্জামানের ছোট ভাই ও সাবেক এমপি কক্সবাজার সদর-রামু।