ডেস্ক নিউজ:
মিডউইকেটের ওপর দিয়ে বলটা পার করে দিতে চেয়েছিলেন শোয়েব মালিক। কিন্তু বাজপাখির মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা মাশরাফি বিন মর্তুজা। ফিল্ডারদের সবচেয়ে দুর্বলতম জায়গা, বাম পাশ। লাফ দিয়ে ওঠার পরই শরীরটাকে ধনুকের মতো বাঁকিয়ে, পেছনে দু’হাতকে বাড়িয়ে দিয়ে ক্যাচটা লুফে নিলেন তিনি। আউট হয়ে গেলেন পাকিস্তানের সেরা ব্যাটসম্যান শোয়েব মালিক। ম্যাচটাও তখন প্রায় পকেটে পুরে নিল বাংলাদেশ।

ক্যাচটা ধরে মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন মাশরাফি। আঙুলে ব্যথা পেয়েছেন। তবুও কাল বিলম্ব না করে উঠে দাঁড়ালেন। হাত তুলে বলটা নিয়ে সটান দাঁড়িয়ে থাকলেন ০.৮৪ সেকেন্ড। ২.৫৪ মিটার উঁচুতে তুলে ধরলেন ক্যাচ ধরা বলটা। ০.৮৪ সেকেন্ডের ওই সময়টায় মাশরাফিকে দেখে মনে হচ্ছিল, যেন একটি ভাস্কর্য। যেন প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে রাখা তার মোমের মূর্তি। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে সেটাকে এসে জড়িয়ে ধরলেন সৌম্য সরকার! এরপর একে একে অন্যরা!!

মাশরাফির চেহারায় তখন দৃঢ়তার চাপ। চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞায় ভাস্বর পুরো মুখমণ্ডল। ক্যাপটা মাথা থেকে একটুও নড়েনি। যথাস্থানেই রয়ে গেছে। মাথার উপরে তুলে ধরা বাম হাতের তর্জনি এবং বৃদ্ধাঙুলের বন্ধনে আবদ্ধ সাদা বলটি। নিচে নামানো ডান হাতটিতে বজ্রমুষ্ঠি। যেন একজন লড়াকু বীরের পুরো প্রতিচ্ছবি। এমন একজন বীর সেনানির অধীনে যখন পুরো বাংলাদেশ, তখন তাদেরকে হারায় সাধ্য কার?

ইমাম-উল হকের দুর্দান্ত ব্যাটিং, শোয়েব মালিক, আসিফ আলি কিংবা সরফরাজ আহমেদের লড়াই তো এমন লড়াকু বীরের চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞার সামনেই এসে লুটোপুটি খাওয়ার কথা। রুবেল হোসেনের বলে শোয়েব মালিকের ক্যাচটি নেয়ার পরই ব্যথাটা টের পেয়েছিলেন। ডান হাতের কনিষ্ঠায় চোট। তা নিয়ে চলে গেলেন মাঠের বাইরে। তিন ওভার পর চোট পাওয়া সেই আঙুল নিয়ে মাঠে প্রবেশ করলেন আবারও। এরপর ব্যান্ডেজ বাধা আঙুল নিয়ে বোলিং করলেন দুই ওভার।

লড়াকু বীর না হলে এমনটা কারও পক্ষে শোভা পাওয়ার কথা নয়। সেটা পেয়েছে কেবল মাশরাফি বলেই। সত্যিকারার্থেই ‘টাইগার’-এর প্রতিচ্ছবি। এমনিকেই মাশরাফির উইকেটের উদযাপনের চেহারাটা দেখলে প্রতিপক্ষের যে কারও ভয় পেয়ে যাওয়ার কথা। মাশরাফির চেহারাটা যে তখন হয়ে ওঠে, গর্জনরত একটি বাঘেরই মুখমণ্ডল! যার হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে প্রতিপক্ষের প্রতিটি গলি-ঘুপচি পর্যন্ত।

পাকিস্তানকে ৩৭ রানে হারিয়ে এশিয়া কাপের ফাইনাল নিশ্চিত করার পর ভারতীয় মিডিয়ার কাছে মাশরাফিরা এখন ‘বাংলার বাঘ’। বাঘের গর্জন এখন আর কালে-ভদ্রে বিশ্ব শোনে না, নিয়মিতই শোনে। বিশ্ব জানে, সুন্দরবন নয় শুধু, এখন বাঘেদের বিচরণ পুরো বাংলাদেশে। এখান থেকেই বাছাই করা বাঘেরাই চলে যায় বিশ্ব জয় করতে। অচীরেই হয়ত বিশ্ব পদানত হয়ে পড়বে এই বাঘেদের হাতেই। যার প্রারম্ভিক জ্বালা ভালোমতোই টের পেয়েছে শ্রীলঙ্কা এবং পাকিস্তান। সাবেক দুই বিশ্বজয়ী যে, মাশরাফিদের গর্জনের মুখে পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়েছে!

মাশরাফি একটি প্রেরণার নাম। পুরো দলের জন্য প্রেরণার বাতিঘর। খুব বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এই এশিয়া কাপেরই তো ঘটনা। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে তামিম হাতে আঘাত পেয়ে মাঠ ছেড়েছেন। হাসপাতালে গিয়ে হাতের কব্জিতে ব্যান্ডেজ বেঁধে এসেছেন। স্লিংয়ে ঝোলানো হাত। মাঠে এসে তিনি দেখলেন একা মুশফিক লড়াই করছে। অন্যরা শুধু আসা-যাওয়ার মিছিল করছেন। এমন অবস্থায়, তামিম নিজেও পূনরায় ব্যাট হাতে মাঠে নেমে যাবেন, তা ভাবেননি।

কিন্তু ভেবেছেন একজন। অধিনায়ক মাশরাফি। তামিম হাসপাতাল থেকে স্লিংয়ে হাত ঝুলিয়ে মাঠে প্রবেশ করার পরই তামিমকে বারবার মাশরাফি বলেছেন, তাকে মাঠে নামতে হবে। প্রথমে তামিম মনে করেছিলেন ঠাট্টা। কিন্তু পরে বুঝলেন মাশরাফি সত্যি সত্যিই চান তামিম মাঠে নামুক। আর তাদের ওপর মাশরাফির প্রভাব এতটাই প্রবল যে, তার চাওয়াও দলের অন্যদের কাছে আদেশ হয়ে দাঁড়ায়। পুরো দল একবাক্যে মেনে নেয় মাশরাফির সব কথা এবং নির্দেশ।

মাশরাফির কথাতে উজ্জীবিত হয়েই মাঠে নামেন তামিম এবং একহাতে ব্যাট করে দারুণ অনুকরণীয় এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। মুশফিকও সে অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে করলেন দুর্দান্ত ব্যাটিং (১৪৪ রান, ৩২ রান এসেছিলেন তামিমের সঙ্গে শেষ উইকেট জুটিতে) এবং বাংলাদেশ জিতলো ১৩৭ রানের বিশাল ব্যবধানে।

পাঁজরে ব্যথা নিয়েও বীরের মতো লড়াই করে যাচ্ছেন মুশফিকুর রহীম। প্রথম ম্যাচে খেলেছেন ১৪৪ রানের ইনিংস। পাকিস্তানের বিপক্ষে ১ রানের জন্য সেঞ্চুরি মিস করলেও তার করা ৯৯ রানই বাংলাদেশের পুঁজিটা সমৃদ্ধ করে দেয়। পরে ঝাঁপিয়ে পড়ে সরফরাজের একটি ক্যাচও নিলেন তিনি। এমন আঘাত এবং ব্যথা নিয়ে এতটা সাহস কোত্থেকে পেলেন মুশফিক? প্রশ্ন ছিল তার কাছে।

সে সাহসের রহস্য জানাতে গিয়ে মাশরাফির প্রসঙ্গই টেনে আনলেন মুশফিক। অধিনায়ক যে তাদের জন্য কত বড় অনুপ্রেরণার নাম, সেটা অকপটে স্বীকার করলেন সাবেক টেস্ট অধিনায়ক। তিনি সরাসরি জানিয়ে দিলেন, ‘মাশরাফি ভাই আমাদের একটা কথা বলেন, আমরাও বলি : যুদ্ধের সময় পেছনে তাকানো যায় না। যদি আপনি ভাবেন আমি যুদ্ধে গিয়ে নিরাপদে থাকার চেষ্টা করব, তবে কাজ হবে না। হয় মারো, না হয় মরো-যে কোনো একটা করো। এটা আসলে বড় প্রেরণা। কারণ আপনি যখন যুদ্ধে থাকবেন, তখন আপনার অধিনায়ক কে, সেটি দেখবেন না, কে সেখানে আছে বা নেই তা-ও দেখবেন না।’

পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচেই দেখুন না! শোয়েব মালিকের ক্যাচ ধরতে গিয়ে আঙুলে ব্যথা পেলেন। বোলিং করা হাতের (ডান হাত) কনিষ্ঠা আঙুলে ব্যথা পেলেন। ব্যান্ডেজ বাধা হলো। সেই হাত নিয়ে দিব্যি খেলেতে নেমে গেলেন। ঝাঁপিয়ে পড়ে ফিল্ডিং করলেন, সাদাব খানের ক্যাচ ধরতে গিয়ে আবারও ব্যথা পেলেন। নিজেকে নিরাপদ জায়গায় রাখলেন না। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন। এমনকি ব্যান্ডেজ বাধা হাত নিয়ে বোলিং করতে নেমে সবাইকে অবাক করে দিলেন। লড়াকু বীর না হলে কি এমন কিছু করে দেখানো সম্ভব?

যার ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই ইনজুরির ভয়াল থাবা। ছোট-বড় মিলিয়ে ১১টি অস্ত্রোপচার হাঁটুতে। যেখানে এত অস্ত্রোপচারের পর হাঁটু ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে মাশরাফি দিব্যি খেলে যাচ্ছেন। দেশকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তার উপস্থিতিতে দলের চেহারা বদলে যায়। সম্প্রতি শেষ হওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের শুরুতে ২ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে খুব বাজেভাবে হারের কারণে পুরো দলেরই যখন মানসিক বিধ্বস্ত অবস্থা, তখন গিয়ে যোগ দিলেন মাশরাফি এবং পুরো দলের মানসিক অবস্থা বদলে ফেললেন তিনি। করে তুললেন দারুণ উজ্জীবিত। যেখান থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২-১ ব্যবধানে ওয়ানডে সিরিজ জয় করলো বাংলাদেশ। সেই অনুপ্রেরণায় বলিয়ান হয়ে টি-টোয়েন্টি সিরিজও বাংলাদেশ জিতে নিলো ২-১ ব্যবধানে (যদিও টি-টোয়েন্টিতে নেই মাশরাফি)।

২০১৪ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর যে বিপ্লব মাশরাফি ঘটিয়ে দিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে, তা অবিশ্বাস্য। একবার তো এমনও খবর এসেছে, অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের এই বদলে যাওয়া নিয়ে গবেষণা চলছে। মাশরাফি এমনই এক জিয়ন কাঠির নাম, যার ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া বাংলাদেশ এখন বিশ্ব ক্রিকেটের পরাশক্তিগুলোর দরজায় গিয়ে হুঙ্কার ছাড়ছে। টানা দ্বিতীয়বার খেলছে এশিয়া কাপের ফাইনালে। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে শুরু করে খেলেছে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল। আগামী বিশ্বকাপেও বাংলাদেশ যে অনেক দুর যাবে, তা বলেই দেয়া যায়। সেটা সম্ভব হবে শুধুমাত্র মাশরাফির তুখোড় নেতৃত্ব আর বজ্রকঠিন লড়াকু মানসিকতার কারণে।

শোয়েব মালিকের ক্যাচটি নেয়ার পর মাশরাফির গুণমুগ্ধ বাংলাদেশের এক প্রথিতযশা ক্রীড়া সাংবাদিক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘তার ওই ক্যাচের রিপ্লে মনের আয়নায় দেখব বহুকাল। তার এ ম্যাচের অধিনায়কত্ব ক্রিকেট ক্লাসে দেখানো হবে বহুবার…। এ জয় মাশরাফির। এ জয় বাংলাদেশের। কারণ মাশরাফিই বাংলাদেশ।’

সত্যিই তো, মাশরাফিই বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশের লড়াকু মানসিকতা যে মাশরাফির চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা এবং বজ্রমুষ্ঠিতে ধরা ক্রিকেট বলের মধ্য দিয়েই প্রকাশ পাচ্ছে। ভারতের বিপক্ষে এই চেহারা দিয়েই হয়তো প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক ট্রফি মাশরাফি উপহার দেবেন বাংলাদেশকে।