উপজেলা ঘোষনা উপেক্ষিত, সেতু মন্ত্রীর কাছে গণমানুষের দাবী

সেলিম উদ্দীন, ঈদগাঁও:

কক্সবাজার সদরের ঈদগাঁও বাজার সৃষ্টির গোড়ার কথা ইতিহাসের কোথাও সুস্পষ্ট ভাবে লিখা নেই। এমনকি এতদাঞ্চলের বাস্তব ইতিহাস সুসংবদ্ধভাবে কোথাও লিপিবদ্ধ নেই। কক্সবাজারের ইতিহাস বইটিতে ঈদগাহ’র ইতিহাস প্রাধান্য পেয়েছে মাত্র কয়েকটি লাইন। স¤্রাট শাহ সুজার গতিপথ ও অবস্থানই মূলত ঈদগাঁওর ইতিহাসে প্রাধান্য পায়। শাহ সুজার পূর্বে ঈদগাঁওর পূর্বের নাম ছিল নয়াবাদ। স¤্রাট শাহ সুজার পদচারনা এবং ঈদের নামায আদায়কে ঘিরে নয়াবাদ নামকরণটি পাল্টে গিয়ে ঈদগাঁও নামে ইতিহাসে স্থান পায়। আরো অজানা ইতিহাস কালের বিবর্তনে স্মৃতির ডায়রি থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। তেমনি একটি ইতিহাস হচ্ছে বাজার স্থানান্তরের ইতিহাস।

সংরক্ষিত তথ্য সূত্র না থাকলেও এলাকার অতি বয়োবৃদ্ধ কালের প্রত্যক্ষদর্শী মুরব্বীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ব্রিটিশ আমলে ঈদগাঁও বাজারটি বর্তমান ইসলামাবাদ ইউনিয়নে নদীর উত্তর তীরবর্তী খোদাইবাড়ি নামক স্থানে ছিল। বাজারটি কোন অজানা দূর্ঘটনায় পুড়ে গেলে নাম পাল্টে পুরা হাটখলা নামে রুপ নেয়। সে সময়ে মুদ্রার প্রচলন ছিল না। মুদ্রার পরিবর্তে কড়ি নিয়ে লেনদেন চলতো বলে জানা যায়। তাই কড়ির বাজার হিসেবে পরিচিত। কালক্রমে বাজারটি চলে যায় একই ইউনিয়নের হিন্দু পাড়ার পার্শ্ববর্তী জায়গায় মমতাজ মেম্বারের বাড়ির পার্শ্বে। যার নাম ছিল মিনি বাজার। পরবর্তীতে স্থানান্তরিত হয় বর্তমান জালালাবাদ ইউনিয়নের তেলি পাড়া সংলগ্ন জলদাশ পাড়ায়। সেখানে বেচাকেনা চলে দীর্ঘদিন। তথনকার সময়ে এলাকার কোথাও কোন টিউবওয়েল (নলকুপ) ছিলনা এবং চিনতওনা। নদীর বালুচরে গর্ত খুড়ে বেশিরভাগ লোকজন খাবার পানি সংগ্রহ করতো। এমনি সময়ে তৎকালীন সরকার আমলে বর্তমান ঈদগাঁও বাজারের যেখানে জনকল্যান পরিষদ ও পাঠাগার রয়েছে সেখানে জনস্বার্থে একটি টিউব ওয়েল স্থাপন করলে বিভিন্ন স্থানের লোকজন তা দেখতে ভীড় জমায়। কারণ তখন টিউবওয়েল থেকে পানি উঠার ব্যাপারটি দেখেনি লোকজন। অবাক দৃষ্টিতে লোহার পাইপ দিয়ে মাটি থেকে কিভাবে পানি উঠে সে দৃশ্য এক পলক দেখার জন্য দিন দিন জনসমাগম ঘটতে থাকে। এভাবে জনসমাগম হতে থাকলে পার্শ্ববর্তী জলদাশ পাড়া হতে ব্যবসায়ীরা টিউবওয়েলটির আশেপাশেই ভাসমান পসরা নিয়ে ব্যবসা শুরু করে। ধীরে ধীরে চাউল,তরিতরকারী,মাছ ইত্যাদির বাজার বসে যায়। মোটামুটি ছোটখাট একটি বাজার হয়ে গেলে এ বাজারটির নাম বসে যায় পাইপ বাজার। অনেকে স্থানীয় ভাষায় পাইক বাজার বলতো। ছোট্ট এ বাজারে বোম্বা ও চেরাগ ছিল রাতের আলোর উৎস। পিডিবি বা পল্লী বিদ্যুৎ ছিল না। বর্তমান কালিবাড়ির পার্শে¦ মোহন দাশ নামক এক জমিদারের কাচারি বাড়ি ছিল। সে সময় বর্তমান প্রধান সড়ক অর্থাৎ ডিসি সড়কটি ছিল না। বাংলাদেশ স্বাধীনের পর সর্বপ্রথম বাজারের পশ্চিমে এজাহার হাজীর একটি চা দোকান এবং পরবর্তীতে বাদল রায় নামক এক হিন্দু ভদ্রলোক একটি চা দোকান শুরু করে। লোকজন আস্তে আস্তে উক্ত সড়ক সমুহ আবিষ্কার করতে শুরু করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও চাহিদার ফলে একের পর এক দোকান গড়ে উঠতে থাকে। বিশিষ্ট জমিদার বর্তমান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান খান বাহাদুর মোস্তাক আহমদ চৌধূরীর দাদা খান বাহাদুর মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী এম ই স্কুল নামে একটি স্কুল প্রতিষ্টা করেন। যা বর্তমানে ঈদগাহ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়। এছাড়া তার দাদী আলমাছ চৌধুরানীর নামানুসারে ঈদগাঁও আলমাছিয়া ফাজিল মাদ্রাসাও প্রতিষ্টা করেন। আশেপাশে কবিরাজ বাড়ি, বঙ্কিম বাড়ি ও রমজান মিয়ার স-মিলসহ বেশ কয়েকটি স্থাপনা গড়ে উঠে। এক সময় পাইপ বাজারটি সম্প্রসারন হতে খাকে। পরে মাছ বাজারটি বর্তমান মাছ বাজারের জায়গায় চলে গেলে পাইপ বাজারটি হয়ে যায় লাকড়ির বাজারে। তখন ইউনিয়নগুলো অবিভক্ত থাকায় বাজারটি ঈদগাঁও বাজার হিসেবে প্রতিষ্টিত হয়।

৮০র দশকে ইউনিয়ন বিভক্ত হয়ে ইসলামাবাদ, জালালাবাদ ও ঈদগাঁও এ ৩ ইউনিয়নে রুপ লাভ করে। ইউনিয়ন বিভক্তির রুপকারের অন্যতম ছিলেন সাবেক ইসলামাবাদ চেয়ারম্যান জাফল আলম। বাজারের এক অংশ ঈদগাঁও ও আরেক অংশ জালালাবাদ ইউনিয়নের অন্তভুক্ত। নদীর উত্তর পাড়ের অংশ ইসলামাবাদে পড়েছে। যদিওবা বহৃত্তর বাজারটি ৩ ইউনিয়নের অন্তভুক্ত তবুও পরিচিতি বা সঙ্গত কারণে ঈদগাঁও বাজার হিসেবেই চলে আসছে। এ পর্যন্ত জালালাবাদ অংশের স্থানটি জালালাবাদ বাজার হিসেবে কোন দাবীও উঠেনি।

ইদানিং লক্ষ্য করা গেছে, ঈদগাঁও শব্দটিকে অনেকে ঈদগাহ আবার কেউ কেউ ঈদগাঁও’ নামে ব্যবহার করে থাকেন। শব্দটি নিয়ে দ্বন্ধও হয় প্রায়শ:। আসলে মুল শব্দটি ঈদগাহ। অর্থ হচ্ছে ঈদের নামাযের স্থান, মাঠ। সম্রাট শাহ সূজার ঈদের নামায আদায়কে ঘিরে মূলত এতদাঞ্চলের নামকরণ। যাত্রাপথে সম্রাট বহর এখানকার একটি নির্দ্দিষ্ট স্থানে তিনি ও তার সৈন্যরা ঈদের নামায আদায় করেন। তাই উক্ত স্থানের নামকরন হয় ঈদগাহ। কোন জায়গায় নামায পড়া হয় তার সঠিক তথ্য কেউ প্রমাণ সহকারে দিতে না পারলেও বয়োজৈষ্ট মুরববীদের মুখ থেকে যা জানা গেছে তা হচ্ছে বর্তমান ইসলামাবাদ ইউনিয়নের ইউছুপেরখীল গ্রামেই ঐতিহাসিক ঈদের নামায আদায় করা হয়েছিল যেহেতু শব্দটি একটি নিদ্দিষ্ট স্থানের সেহেতু ঈদগাহ শব্দটি একটি নির্দ্দিষ্ট স্থান বা প্রতিষ্টানের ক্ষেত্রে বুঝানো হয়। গাঁও মানে গ্রাম। গাহ শব্দাংশ দিয়ে স্থান বা জায়গা বুঝতে পারি। যেমন-এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্টানের নামগুলোর ক্ষেত্রে ঈদগাহ ফরিদ আহমদ কলেজ, ঈদগাহ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, ঈদগাহ জাহানারা ঈসলাম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও ঈদগাহ আদর্শ শিক্ষা নিকেতন। অন্যদিকে ঈদগাঁও শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবর্হ্ত হয়। বিশাল এলাকা বেষ্টিত কতগুলো গ্রাম নিয়ে ইউনিয়ন গঠিত। সে ক্ষেত্রে নাম ব্যবহার করা হয় ঈদগাঁও। যেমন- ঈদগাঁও ইউনিয়ন পরিষদ, ঈদগাঁও বাজার, ঈদগাঁও পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র ইত্যাদি নামকরনে ব্যবহার করা হয়েছে। ভবিষ্যত উপজেলা নামকরনের ক্ষেত্রে ঈদগাঁও নামকরন আসছে। অন্যদিকে এতদাঞ্চল হতে ইতোপুর্বে প্রকাশিত বিভিন্ন সাহিত্য ও উন্নয়নধর্মী পত্রিকা যেমন-ঈদগাঁও বার্তা, ঈদগাঁও কণ্ঠ, ঈদগাঁও দর্পণ, আলোকিত ঈদগাঁও, ঈদগাঁও পত্র, ও অনলাইন পত্রিকা ঈদগাঁও নিউজ ডটকম সহ আরো অনেক প্রকাশনায় ঈদগাঁও শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে ব্যাপক অর্থ প্রকাশের জন্য। ঈদগাঁও, ইসলামাবাদ, জালালাবাদ, পোকখালী, ইসলামপুর, চৌফলদন্ডী, ভারুয়াখালী এ ৭ টি ইউনিয়ন একিভূক্ত নয়াবাদ নামে ছিল। যার সুত্র পুরনো দলিলপত্রের। সম্রাট শাহ সুজার ইতিহাস সৃষ্টির পরে নামকরন হয় ঈদগাঁও। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, চাহিদা ও ভৌগলিক কারনে ঈদগাঁও ভাগ হয়ে চৌফলদন্ডী, পোকখালী ও ঈদগাঁও এ ৩টি আলাদা ইউনিয়নে রুপ নেয়। পরবর্তীতে চৌফলদন্ডী ভাগ হয়ে ভারুয়াখালী ও চৌফলদন্ডী এবং পোকখালী ভাগ হয়ে ইসলামপুর ও পোকখালী হিসেবে রুপ লাভ করে। ৮০’র দশকে ঈদগাঁও ভাগ হয়ে ইসলামাবাদ, জালালাবাদ ও ঈদগাঁও এ ৩ টি পৃথক ইউনিয়নে পরিণত হয়। অদুর ভবিষ্যতে ঈদগাঁও-ইসলামাবাদ এ দু ইউনিয়ন আবারো ভাগ হয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। ঐতিহাসিক সেই শাহ সুজার স্মৃতি বিজড়িত ঈদগাঁও যতই ভাগ হচ্ছে ততই এর গুরুত্ব বৃদ্বি পাচ্ছে নামটির। নামটির ক্ষয় নেই। অক্ষয় হয়ে থাকবে। ঈদগাঁও নামটি শুধু ঈদগাঁও ইউনিয়নবাসীর নয়, বৃহত্তর ৭ ইউনিয়নের। ঈদগাহ, বর্তমানে ঈদগাঁও আমাদের ইতিহাস, আমাদের ঐতিহ্য। যদিও হই পোকখালি, ইসলামপুর অথবা চৌফলদন্ডী, ইসলামাবাদ, জালালাবাদ ও ভারুয়াখালীর অধিবাসি তবে কক্সবাজার বা পাশ্ববর্তী কোথাও গেলে প্রথমত: ঈদগাঁওর লোক বলে পরিচয় দিলেও সম্ভবনাময় ঈদগাঁও উপজেলা ঘোষনা বার বার উপেক্ষিত হচ্ছে।

১৯০০ সাল শুরুর পর তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার আমলে বৃহত্তর ঈদগাঁও সহ বিশাল এলাকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন বর্তমান কক্সবাজার জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ চৌধুরীর দাদা মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী। তৎসরকার তাকে খান ছাহেব উপাধি দিয়েছিলেন। সে সময়কার আমলে চৌফলদন্ডী ছিল বৃহত্তর ঈদগাঁওর রাজধানী। শাসন, সংরক্ষন, হুকুম জারী সহ যাবতীয় কাজ কর্ম সম্পাদন হতো খান ছাহেবের কাচারী হতে। লোকজনকে চৌফলদন্ডী না গেলেই কোন কাজ হতো না। বর্তমান চৌফলদন্ডীর খামার পাড়ায় ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে খান ছাহেব বাড়ি এবং পাহাড়ের উপরে কাচারীতে উঠার বিভিন্ন সিড়ি। যেখানে বসে তিনি পুরো এলাকার শাসন পরিচালনা করতো। ঈদগার উন্নয়নে তাঁর ছিল অনন্য দরদ। তার নিজের জায়গায় প্রতিষ্টা করেন এম ই স্কুল। যা বিবর্তন হয়ে বর্তমানের ঈদগাহ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ও ঈদগাঁও সরকারী প্রাইমারী স্কুল। কিন্তু স্কুল সংলগ্ন মার্কেটে দেরিতে হলেও খাঁন ছাহেবের নামটি স্থান পেয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্টানসমূহ কালের স্বাক্ষী হয়ে আজো সুমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। তারই সহধর্মীনি আলমাছ খাতুনের নামে বিপুল সম্পত্তি দানপূর্বক দ্বীনি শিক্ষা প্রসারের জন্য স্থাপন করেন ঈদগাহ আলমাছিয়া মাদ্রাসা। যা বর্তমানে কামিল স্থরের পর্যায়ে। উক্ত মাদ্রাসা হতে অসংখ্য আলেম ওলামা বের হয়েছে ও হচ্ছে। চৌফলদন্ডী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, খামার পাড়া জামে মসজিদ সহ কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য মসজিদ মাদ্রাসা ও শিক্ষা প্রতিষ্টান গড়ে তুলেছেন তিনি। হিসেব বিহীন অনেক বসতবাড়ি গড়ে তোলে তার জায়গার উপর যুগ যুগ ধরে বসবাস করছে। শেষ পর্যায়ে এ জমিদার ১৯৩৬ সালে হজ্বে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। এসব জমিদারীর নেতৃত্ব দিয়ে যচ্ছেন মোসতাক আহমদ চৌধুরী ও কানিজ ফাতেমা মোস্তাক। পরবর্তী সময়ে মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরীর চেয়ে অনেক ছোটখাট জমিদার শ্রেনিগোষ্টি এতদাঞ্চলের শাষনকার্য পরিচালনা করতো।

ঈদগাঁও বারআওলিয়া এক অনন্য স্মৃতিতে মুহ্যমান অতিপ্রাচিন ১২টি বিশাল বৃক্ষ। প্রায় ৪’শ বছরের প্রাচিন ঐতিহ্যকে আজো ধরে রেখেছে বিশাল আকারের সেই বার আওলিয়ার দরগাহর বারটি তেলসুর বৃক্ষ। ঈদগাঁও বাসষ্টেশনের সামান্য পূর্বদিকে পুরনো একটি কবরস্থানের মাঝেই বৃক্ষরাজিপূর্ণ সমতল জায়গায় এ দরগাহটি অবস্থিত। কথিতআছে ১২ আওলিয়া প্রতি বৃহষপতিবার এখানে একত্রিত হয়ে জিকির করে। অবশ্য এ তথ্যটি মুখ থেকে বের করেছিলেন বোয়ালখালী গ্রামের অধিবাসি বিশিষ্ট দ্বীনি আলেম হযরত আবদুর রহমান জামি (র:)। তিনি ছিলেন ঈদগাঁওর সর্বোচ্চ দ্বীনিশিক্ষা প্রতিষ্টান আলমাছিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক। যদিও বা তিনি শিক্ষক তবুও তার চালচলন, ব্যবহার, খাওয়া দাওয়া সহ সমস্থ কাজ কর্ম অন্য ষ্টাইলের। রাত কিংবা দিন, ঝড় হোক বা রোদ হোক, এমন কি গোসল করার সময়ও তাঁর হাতে থাকতো খোলা ছাতা। প্রাতিষ্টানিক কাজ শেষে তিনি সোজা চলে আসতেন দরগাহ পাড়ার সেই বিশাল কবরস্থানে। ঘন বৃক্ষের জঙ্গলবেষ্টিত কবরস্থানের মাঝামাঝি জায়গায় ছোট্ট একটি ঘর তৈরি করে একাকী রাত দিন কাটাতে থাকে। জিকির, নামায, ও দরগাহ রক্ষনাবেক্ষনে ব্যস্ত থাকতেন। পরবর্তীতে উক্ত ঘরের সামনে মাটির গুদাম ও ছনের ছানিযুক্ত একটি মসজিদ ছিল। তাঁর জীবনের ৩৩ বছর এখানেই কাটান এবং বিগত ১৯৯৫ সালে তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। তখন আশে পাশে তেমন ঘর বাড়ি গড়ে উঠেনি। এলাকার সবচেয়ে প্রবীণ মুরব্বীরা জানান, ষাটের দশকে এলাকায় বেশ কয়েকটি বাড়ি ছিল। বিভিন্নস্থান থেকে সবেমাত্র লোক আসতে শুরু করেছে। স্থানীয় মীর আহমদ সওদাগর, মো: কালু, এজাহার ড্রাইভার, ফরিদুল আলম প্রকাশ কুরা আলম, মমতাজ আহমদ প্রকাশ পুথি মমতাজ, আমির হামজা, উলা মিয়া ও মীর আহমদ প্রকাশ চেরাগ আহমদ, শহরমুল্লুুক, মোখলেছুর রহমান আশে পাশে বসত ঘর তৈরি করে বার আওলিয়া দরগাহ নিয়ে কাজ শুরু করেন। মাওলানা আবদুর রহমান জামির খোঁজ খবর নিতেন। যতটুকু সম্ভব খাবারও যোগান দিতেন। বয়োবৃদ্ধ মুরব্বীরা এখন বেঁচে নেই।

দরগাহনুরাগী পাশ্ববর্তী বাড়ির মালিক ব্যবসায়ী মোস্তাক আহমদ জানান, তার নিকটাত্মীয় গফুরের মা’র কাছ থেকে যা শুনেছেন তা হচ্ছে, দরগাহ সংলগ্ন বিশাল পুকুরটি একসময় পাড়ার মহিলারা ব্যবহার করতো। একদিন কলসি নিয়ে উক্ত পুকুরে পানি আনতে গিয়ে তিনি আরেক আওলিয়া ওয়াজকরনী (র:) কে দেখেছিলেন। তখন থেকেই ভক্তি শ্রদ্ধা বাড়তেই খাকে। স্থানীয় মুরব্বীও নিয়মিত মুসল্লী আবদু রমিদ, শাহ আলম, হাফেজ মৌলানা সিরাজুল হক, নুরুল ইসলাম, মো: ইসলাম মিস্ত্রি, মকতুল হোছন ড্রাইভার, আলতাজ আহমদ বলেন, বারজন আওলিয়া এখানে জিকির করার দৃশ্য মাওলানা আবদুর রহমান জামি(র:)র মাধ্যমেই প্রকাশ পায়।

ঈদগাঁওর আরেক বিশিষ্ট আওলিয়ার নাম হযরত শাহ্ ছুফি পেটান শাহ। বর্তমান আওলিয়াবাদ গ্রামেই জন্মগ্রনকারী এ ছুফি সাধক পেটান ফকির হিসেবে স্থানীয়ভাবে ব্যাপক পরিচিত। বড় মাপের একজন আওলিয়া শুয়ে আছেন সদর উপজেলার ইসলামাবাদ ইউনিয়নের গজালিয়া সড়কের পার্শ্ববর্তী ঈদগাঁও নদীর পাড়ে সুউচ্চ পাহাড়ের চুড়ায়। মাজারটি তেমন একটা উন্নয়নের ছোঁয়া পায়নি। বলতে গেলে কোন প্রকার তথ্যবিহীন, জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় পড়ে থাকলেও তাঁর নাতি বয়োবৃদ্ধ কবির আহমদ খাদেম হিসেবে দেখাশুনা করছে। আরাকান সড়কের একটু পূর্বপার্শ্বে অবস্থিত এ আওলিয়ার মাজার কালের স্বাক্ষী হয়ে রয়েছে। পেটান শাহ বরকতময় পবিত্র মাসে পবিত্র দিনে ইহকাল ত্যাগ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর তারিখ ১৯৭৬ সালের ১৪ রমজান শুক্রবার ১১টা ৩০ মিনিটে। কোন প্রকার প্রাতিষ্টানিক লেখাপড়া কিংবা শিক্ষাগত যোগ্যতা এমনকি অক্ষরজ্ঞান না থাকলেও তাঁর হাতের লেখা এখনো কেবলই স্মৃতি। কি লিখতেন তিনি ? কেন লিখতেন ? উক্ত লেখার মধ্যে কি অর্থ রয়েছে। তা কেউ ভাবেনি। হয়তো এমনই তথ্য থাকতে পারে তা মানুষের, সমাজের, দেশের কোন না কোন উপকারে আসতে পারে। অথবা কোন চাঞ্চল্য কিছু রয়েছে। কোন ভাষাবিদ বা অভিজ্ঞ কেউ আজ পর্যন্ত গবেষনা করে উক্ত লেখার মর্মার্থ আবিষ্কার করতে পারেনি।

স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী মুরববীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ছুফি সাধক পেটান শাহ সন্ধ্যার পর বেশিরভাগ সময় কাটাতেন গভীর বনাঞ্চলে বাঘ ও হাতির আড্ডাখানায়। তাঁর মৃত্যুর পর কবরের পার্শ্বে একাধিকবার বন্যপ্রাণির দর্শণ তারই প্রমাণ মেলে। মাজারের পার্শ্ববর্তী বাড়ির ষাটের কাছাকাছি বয়স্ক মোস্তাক আহমদ জানান মৃত্যুর পরও তাকে রাতে অনেকবার হাটাহাটি করতে দেখা গেছে। তিনি আরো জানান জীবদ্দশায় হালকা পাতলা শারিরীক গঠন ছিল। সবসময় কাগজ কলম হাতে থাকতো। লিখতো শুধু লিখতো। কিন্তু কি লিখতো কেউ বুঝার সাধ্য নেই। কথা বলতো কম কাজ করতো বেশি। চা পান করতো ঘন ঘন। একই এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি ইসলামাবাদ ইউপি চেয়ারম্যানের পিতা ও মমতাজুল উলুম ফরিদিয়া দাখিল মাদ্রাসার প্রতিষ্টাতা আলহাজ মমতাজুল ইসলাম সওদাগর প্রকাশ জাপানি মমতাজ পেটান শাহের কাছাকাছি সান্নিধ্যে ছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, আমি স্বচক্ষক্ষএকাধিক ঘটনা দেখেছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে একদিন ঈদগাঁও বাস ষ্টেশনে ছৈয়দ সওদাগরের দোকানে পেটান শাহ সহ চা পানরত অবস্থায় হঠাৎ আরেক ছুফি সাধক নুরুল হক ডুলা ফকির উপস্থিত হয়। এ সময় স্বয়ং ডুলা ফকির সাহেব পেটান শাহকে সম্মান দেখান এবং বলেন পেটান শাহ আওলিয়াদের সেক্রেটারী। অপর এক ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেন যখন আমি ভোমরিয়াঘোনা রেঞ্জের কাছাকাছি জায়গায় অবস্থান করেছিলাম তখন পেটান শাহ একটি রাস্তা দিয়ে গভীর জঙ্গলের দিকে হাটছে। এসময় দুর থেকে দেখতে পেলাম একটি হাতি এগিয়ে আসছে। পেটান শাহকে দেখার সাথে সাথে হাতিটি লাফ দিয়ে পাশের খাদে পড়ে বসে থাকে। তাঁর মৃত্যুর পর যথাসম্ভব মাজার শাসন সংরক্ষন করা হয়। মরহুমের নাতি কবির আহমদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বিশাল কবরস্থানের এক পার্শ্বে মাজার টি করা হয়েছে। এরই কাছাকাছি একটি জামে মসজিদ প্রতিষ্টিত হয়েছে। কোন প্রকার তথ্য সংরক্ষত করা হয়নি।

ঈদগাঁও’র শহীদ সাবের একজন সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী। ক্ষনজন্মা এই সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী শহীদ সাবের ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ৩১ মার্চ নিজ কর্মস্থল দৈনিক সংবাদ পত্রিকার কার্যালয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর লাগিয়ে দেওয়া আগুনে পুড়ে তিনি শহীদ হন

১৯৩০ সালের ১৮ ডিসেম্বর কক্সবাজার জেলার ঈদগাঁওর সোনাপুকুর গ্রামে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন শহীদ সাবের। তাঁর প্রকৃত নাম এ কে এম শহীদুল্লাহ, লেখক হিসেবে নাম শহীদ সাবের।

ঈদগাঁও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর পর্যন্ত অধ্যয়ণের পর কলকাতায় চলে যান শহীদ সাবের। সেখানে ছন্দ শিখা নামের হাতে লেখা পত্রিকার মাধ্যমেই তাঁর সাহিত্য জগতে প্রবেশ। ১৯৪৭ সালের দেশভাগে সপরিবারে তাঁরা পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। পরে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয়ে ১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন, কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছেন আজিমপুরের ওয়েস্ট অ্যান্ড হাই স্কুলে।

তিনি কারাবন্দি হন ১৯৫০ সালে, যখন সদ্য ম্যাট্রিক পাস করে কলেজে ভর্তি হয়েছেন। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। ছাত্র ফেডারেশনের এক সমাবেশে বক্তৃতারত অবস্থায় গ্রেপ্তার হন। সুনির্দিষ্ট কোনো মামলা না দিয়ে নিরাপত্তা-বন্দি হিসেবে বিনা বিচারে চার বছর আটক ছিলেন। সেকালের অসংখ্য রাজবন্দির মধ্যে তিনি ছিলেন কনিষ্ঠতম। জেলখানায় থাকাকালে তাঁর চট্টগ্রাম জেলে বসেই বন্দিজীবনের কাহিনি নিয়ে লিখেছিলেন ‘আরেক দুনিয়া থেকে’ নামক রোজনামচা। লেখাটি গোপনে জেল থেকে পাচার হয়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত নতুন সাহিত্য-এর চৈত্র ১৩৫৭ সংখ্যায় ছাপা হয়। লেখাটি নিয়ে চারদিকে সাড়া পড়েছিল। দুঃখের বিষয় তাঁর নিজের নামে তা প্রকাশিত হয়নি, লেখক হিসেবে নাম ছাপা হয়েছিল জনৈক জামিল হোসেনের। উভয় বাংলার পাঠক, লেখকের পরিচয় জানতে কৌতূহলী হয়েছিলেন। সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লেখাটির প্রশংসা করে এবং ওই নতুন লেখককে স্বাগত জানিয়ে পত্রিকার সম্পাদককে চিঠি লিখেছিলেন।

এরপর ১৯৫৫ সালে তিনি জগন্নাথ কলেজ থেকে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে বিএ পাস করলেন। বিএ পাস করে সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন দৈনিক সংবাদ-এ। কেন্দ্রীয় ইনফরমেশন সার্ভিসের (সিএসএস) জন্য পরীক্ষা দিয়ে সে বছরের কৃতকার্যদের ভেতর তাঁর অবস্থান ছিল শীর্ষে, কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার দরুন তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। সাহিত্যিক হিসেবে অল্প সময়ে অনেক কাজ করেছেন তিনি। ১৯৫৫ সালেই তাঁর ছোটগল্পের চমৎকার একটি সংকলন বের হয় ‘এক টুকরো মেঘ’ নামে; ‘ক্ষুদে গোয়েন্দার অভিযান’ নাম দিয়ে কিশোরদের জন্য একটি সুখপাঠ্য গ্রল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে; তিনটি বিদেশি রচনার অনুবাদও সম্পন্ন করেছিলেন, পুশকিনের ইস্কাপনের বিবি, গোগলের পাগলের ডায়রী, এবং ‘কালো মেয়ের স্বপ্ন’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। বেশ কিছু কবিতা লিখেছেন, গানও আছে তাঁর। তবে গ্রন্থাকারে তা প্রকাশিত হয়নি। বিভিন্ন দৈনিক ও পত্রপত্রিকায় তা ছাপা হয়েছিল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তাঁর কবিতাগুলো বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত সেলিনা হোসেন সম্পাদিত ‘শহীদ সাবের রচনাবলী’তে পুনর্মুদ্রণ হয়। এরমধ্যে ২৫ জানুয়ারি ১৯৫১ সালে ‘শোকার্ত মায়ের প্রতি’ কবিতাটি চট্টগ্রাম জেলে বসে লেখা। বাকী কবিতাগুলো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে লেখা। সাঁওতাল বিদ্রোহের নেত্রী ইলা মিত্রকে নিয়ে লেখা এ কবিতাটির প্রতি পঙ্ক্তিতে রয়েছে জীবনের বারুদ চেতনা। সংগ্রামের ইতিহাস।

১৯৫৮ সালের শেষের দিকে তাঁর মানসিক বিপর্যয় শুরু হয়। নিজের অবস্থানে টিকে থাকতে না পারার যন্ত্রণায় জীবনের প্রতি তীব্র অনীহা কিংবা ঘৃণায় নিজের মধ্যে গুটিয়ে যান। শ্রদ্ধেয় রকুনোজ্জামান খান দাদাভাইয়ে সহায়তায় চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হলেও আর্থিক অনটনে চিকিৎসার ধারাবাহিকতার অভাবে সেই সুস্থতা বজায় থাকেনি। ক্রমশ আরো বিপর্যস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তাঁর জীবন হয়ে পড়ে অসংলগ্ন এবং প্রথাবিরোধী। বংশালের সংবাদ অফিসই হয়ে উঠেছিল সাবেরের একমাত্র আশ্রয়স্থল। দিনময় ঘুরে রাতে ঘুমাতে যেতেন সংবাদ অফিসে।

১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দৈনিক সংবাদ অফিসে আগুন লাগিয়ে দেয়; তখন তিনি ওই অফিসে ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলেন। অগ্নিদগ্ধ হয়ে তিনি মারা যান। তাঁর সাহিত্যের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৭৩ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমী পুরস্কার (মরণোত্তর) দিয়ে সন্মানিত করা হয়।