শাহেদ মিজান, সিবিএন:
‘হোপ ফাউন্ডেশন’ দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজারের জন্য একটি অতিপরিচিত সেবামূলক সংস্থা। এই সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে রামুর চেইন্দায় অবস্থিত হোপ হসপিটাল। মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা এই হাসপাতালটি অনেক আগেই বেশ সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এক কথায় মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যসেবায় নিন্ম ও মধ্যবিত্ত মানুষের ত্রাতাস্থল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মানবসেবার এই আতুড়ঘর।

শুধু এই হাসপাতাল নয়; জেলার আরো কয়েকটি দুর্গম এলাকায় ‘বার্থ সেন্টার’ স্থাপন করেছে হোপ ফাউন্ডেশন। এসব সেন্টারগুলো দুর্গম এলাকার নিরুপায় মাতৃ ও শিশু সেবায় বিরাটা ভূমিকা রেখেছে চলেছে। একই সাথে ফিস্টুলা নিরোধ, ধাত্রীবিদ্যা প্রশিক্ষণসহ মাতৃসেবা নিয়ে আরো নানা কার্যক্রম অত্যন্ত সুনামের সাথে চালিয়ে যাচ্ছে হোপ ফাউন্ডেশন। মৃত্যুর হার কমিয়ে নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করাই হোপ ফাইন্ডেশনের এই প্রচেষ্টা- এমনটি জানালেন মানবসেবী এই প্রতিষ্ঠানের স্বপ্নদ্রষ্টা ও চেয়ারম্যান কক্সবাজারের কৃর্তিমান ব্যক্তিত্ব ডা. ইফতিখার মাহমুদ মিনার। হোপ ফাউন্ডেশনের স্বপ্নবুনন, পথচলা, বর্তমান ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে এক সাক্ষাতকারে তিনি একথা বলেন।

ডা. ইফতিখার মাহমুদ বলেন, বিশ্বজুড়ে গর্ভজনিত কারণে মাতৃমৃত্যু এখনো আলোচিত। বাংলাদেশে এর প্রভাব একটু বেশিই। সচেতনতার অভাবে প্রসবজনিত রক্তক্ষরণসহ বিভিন্নভাবে মাতৃমৃত্যু হচ্ছে। একজন চিকিৎিসক হিসেবে মাতৃমৃত্যু নিয়ে আমি নিজে খুব আত্মদহনে ভুগতাম। সেই দায়বদ্ধতা থেকে মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে হোপ ফাইন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। ১৯৯৯ সালে ক্ষুদ্র পরিসরে যাত্রা করে ২০০৫ সালে চেইন্দায় নিজস্ব জমিতে হোপ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করি। পরবর্তী পর্যায়ে হোপ ফাউন্ডেশন ট্রেনিং সেন্টারে মিডওয়াইফারি এডুকেশন প্রোগ্রাম চালু করি। কক্সবাজারের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের বেশ কয়েকটি হোপ মেডিকেল সেন্টার স্থাপন করি। এইসব সেন্টারে গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যসেবা ও নরমাল ডেলিভারি করানো হয়। জটিল হলে হোপ হাসপাতালে রেফার করে নিয়ে আসা হয়।

তিনি আরো বলেন, মেয়েদের জন্য অতি কষ্টের একটি রোগ ফিস্টুলা। প্রসবজনিত কারণে এই রোগ হয়। এই রোগের যন্ত্রণার কথা একমাত্র ভুক্তভোগী জানবেন। অপারেশনের মাধ্যমেই এই রোগ সারাতে হয়। ফিস্টুলা নিরোধে পুরো বাংলাদেশে হোপ ফাউন্ডেশন ফাউন্ডেশনই বেশি কাজ করছে। এই অগ্রগতি আরো বাড়াতে নির্মিত হচ্ছে বিশেষায়িত ফিস্টুলা সেন্টার। এর ভবন নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। বছরের শেষের দিকে উদ্বোধন করা হবে। এটিই হবে বাংলাদেশের প্রথম ফিস্টুলা চিকিৎসা সেন্টার। এই সেন্টারে ফিস্টুলা রোগের চিকিৎসা নয় শুধু, এখানেই সারাদেশ থেকে ফিস্টুলা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে আসবে।

ডা. ইফতিখার বলেন, বাংলাদেশ গ্রাম প্রধান দেশ হওয়ায় এখনো তৃণমুলে যথাযথ মাতৃ চিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়নি। বিশেষ করে গর্বজনিত সেবার অভাব বেশ রয়েছে। এখনো গ্রামের অশিক্ষিত প্রশিক্ষণহীন ধাত্রী মহিলা দিয়ে সন্তান প্রসবের ঘটনা ঘটে। এতে মাতৃমৃত্যুর ঘটনা থেকেই যাচ্ছে। সেই অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে গ্রাম পর্যায়ে প্রশিক্ষিত ধাত্রীসেবা নিশ্চিত করার জন্য হোপ ফাউন্ডেশন মিডওয়াইফারি এডুকেশন প্রোগ্রাম চালু করেছে। ইতিমধ্যে এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে— ধাত্রী সেবা কার্যক্রম চালাচ্ছে। তারা মাতৃমৃত্যু রোধে উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারছে।

তিনি বলেন, মা সুস্থ্য থাকা একটি পরিবারই সুখী হয়। আমার স্বপ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের মায়েদের মাতৃত্ব নিরাপদ করে তাদের সুস্থ্য জীবন নিশ্চিত করা। মায়েদের স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে পুরো পরিবারের কাঠামো দৃঢ় করা এবং শিশুদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করা। শিশুদের সুস্বাস্থ্যের অধিকারী করা, যাতে করে দেশের সম্পদ শিশুরা সুস্বাস্থ্য নিয়ে গড়ে উঠতে পারে।

তিনি আরো বলেন. হোপ ফাউন্ডেশন এর মাধ্যমে সরকারের পাশাপাশি মায়েদের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য আমরা কাজ করছি। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের অবহেলিত এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সেবা করা এবং যারা আর্থিক অসুবিধার কারণে স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত তাদের উন্নত মানের সেবা প্রদান করার আমাদের অন্যতম লক্ষ্য।

অতীতের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে ডা. ইফতিখার মাহমুদ বলেন, হোপ ফাউন্ডেশন নিয়ে আমার দৃঢ় স্বপ্ন ছিলো। এই জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে আমরা একটা সফল অবস্থান দাঁড় হতে পেরেছি। মানুষ এখন বলে হোপ ফাউন্ডেশন একটি কিছু করে দেখিয়েছে। আমাদের উপর মানুষের আস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটাই বড় পাওয়া। এই সার্থকতা আমার একার না। এখানে কক্সবাজারের অনেকের সহযোগিতা আছে; যাদের সবার নাম বলা সম্ভব না। এছাড়া আমি স্বশরীরে সময়ে দিতে না পারলেও আমার একঝাঁক কর্মী বাহিনী হোপ ফাউন্ডেশনকে আজকের এই পজিশনে নিয়ে এসেছে।

তিনি বলেন, আমরা সরকারের সাথে কাজ করবো। সরকারকে সহযোগিতা করবো। সরকার চাইলে আমাদেরকে পাবে। স্বাস্থ্যসেবায় যেকোনো ইস্যুতে আমরা সরকারের সাথে কাজ করতে তৈরি আছি। কারণ দেশের উন্নয়ন সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রাইভেট সেক্টরকে এগিয়ে আসতে হবে। সবাই একসাথে হাত মিলিয়ে দেশকে এগিয়ে যেতে হবে।

হোপ ফাউন্ডেশন নিয়ে ভবিষ্যতে আরো বড় স্বপ্ন দেখেন ডা. ইফতিখার মাহমুদ। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার স্বপ্ন কক্সবাজার এবং বাংলাদেশ নিয়ে। আমরা সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। ভবিষ্যতে হোপ হাসপাতালকে অনেক বড় বিশেষায়িত বিভাগ সংযোজনের মাধ্যমে সেবার পরিধি আরো বাড়াতে চাই। একই সাথে মাবতবতায় সেবায় আরো নানা উদ্যোগ নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। গ্রাম পর্যায়ে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে একট বিপ্লব দেখতে চাই। দেখতে চাই যে আগামী পাঁচ বছরে মাতৃমৃত্যুর হার কমে এসেছে। আমার দৃঢ় বিশ^াস লক্ষ্য এগিয়ে গিয়ে হোপ ফাউন্ডেশন একদিন বাংলাদেশের রোল মডেল হিসেবে রূপ লাভ করবে। এই চলার পথে আমরা কক্সবাজারের সর্বস্তরের মানুষ, সরকার, প্রশাসন ও মিডিয়ার সহযোগিতা চাই। সবার কাছে আমার একটাই বার্তা- হোপ ফাউন্ডেশন আমার নয়; কক্সবাজারবাসীর সম্পদ।

ডা. ইফতিখার মাহমুদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়: তিনি কক্সবাজার শহরের তারাবনিয়ারছড়া এলাকার সাবেক জেলা প্রশাসন কর্মকর্তা মরহুম জহির উদ্দীন আহমদের পুত্র। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করে আমেরিকায় পাড়ি জমান। গত ২৮ বছর ধরে আমেরিকায় বাস করছেন। সেখানে পৃথিবীর বড় বড় মানুষের সাথে সম্পর্ক হয়েছে তাঁর। সে সুবাদে হোপ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। নিজের গড়া হোপ ফাইন্ডেশনের মাধ্যমে হোপ হাসপাতালটি পরিচালনা করছেন।

তিনি বলেন, কক্সবাজার এবং বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে স্বাস্থ্যসেবা মূলক প্রতিষ্ঠান করা আমার স্বপ্ন ছিলো। আমার শ্রদ্ধেয় পিতা আমাকে ডাক্তার হওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন এবং সেবামূলক কাজ করার জন্য সব সময় উৎসাহিত করেছেন। মূলত ওনার অনুপ্রেরণাই আমার স্বপ্নের হোপ ফাউন্ডেশন।