মো. নুরুল করিম আরমান, লামা:

আবহাওয়া অনুকূলে ও রোগবালাই, পোকা মাকড়ের আক্রমণ না থাকায় এবার পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর তামাক চাষের পরিবর্তে বান্দরবানের লামা উপজেলায় আখের আশানুরূপ উৎপাদন হয়েছে। পর পর কয়েক বছর ধরে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ায় কৃষকরা এখন এ চাষে ঝুঁকে পড়ছেন। উৎপাদিত আখের আশানুরূপ দাম পেয়েও খুশি চাষিরারা। কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে পার্বত্য চট্টগ্রামে ইক্ষু গবেষণা ও উম্নয়ন জোরদার করণ প্রকল্পের আওতায় ১৮জন কৃষক পরীক্ষামূলকভাবে আখ চাষ করেছেন। এছাড়াও ব্যক্তিগত উদ্যোগে আখ চাষ করেন ২৫জন কৃষক। এসব আখ চাষের অধিকাংশ জমিতেই আগে তামাক চাষ হতো। তামাক চাষের জমিতে আখের এ বাম্পার ফলনকে ‘ক্ষতিকর তামাকের ক্ষেতে মিষ্টি আখের হাসি’ বলে মন্তব্য করছেন স্থানীয়রা। ক্ষতিকর তামাক চাষের বিকল্প হিসেবে আখের চাষ বৃদ্ধিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে ইক্ষু গবেষণা ও উম্নয়ন জোরদার করণ প্রকল্পের পাশাপাশি কৃষি বিভাগের মাধ্যমেও সরকারি ভাবে সার্বিক সহায়তা প্রদান অপরিহার্য বলে মনে করছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে উপজেলায় প্রায় ১০০ একর জমিতে আখ চাষ হয়েছে। এর মধ্যে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে পার্বত্য চট্টগ্রামে ইক্ষু গবেষণা ও উম্নয়ন জোরদারকরণ প্রকল্পের আওতায় ১৮জন কৃষক ৬ একর ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে ২৫জন কৃষক ৯৪ একর জমিতে আখ চাষ করেছে। এতে বিএসআরআই-৪২ রং বিলাস, চায়না-২৮, অমৃত- ৮৪১, সিও-২০৮ ও বিএমসি-৮৬-৫৫০ জাতের আখ রয়েছে। যা উপজেলার চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন জেলা উপজেলা শহরে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি হচ্ছে। আখ উৎপাদনে ঝুঁকি কম এবং অধিক ফসল উৎপাদন করে বাড়তি টাকা আয় করা যায়। যার কারণে আখের উৎপাদন খরচও কম হয়। এতে করে কৃষকরা অন্যান্য ফসলের চেয়ে আখ চাষে বেশি লাভবান হন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ৩ যুগের বেশি সময় ধরে লামা উপজেলার ১টি পৌরসভা ও ৭টি ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকার আবাদি জমিতে ক্ষতিকর তামাক চাষ হয়ে আসছে। তামাক চাষে লাভ বেশি হলেও শারীরিক ক্ষতি, পরিশ্রম এবং মূলধন বেশি লাগার কারনে অনেক কৃষকই সম্প্রতিকালে ক্ষতিকর তামাক চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। একই সাথে তারা তামাকের বিকল্প ফসল চাষের চেষ্টা চালাচ্ছে। যে সকল কৃষক ক্ষতিকর তামাক চাষ করতেন; তাদের অনেকেই এখন আখসহ বিভিন্ন ফসলের চাষ করে লাভের মুখ দেখছেন। সরেজমিন দিয়ে দেখা যায়, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন (কেজিএফ) এর অর্থায়নে পার্বত্য চট্টগ্রামে ইক্ষু গবেষণা ও উন্নয়ন জোরদার করণ প্রকল্পের আওতায় ১৮ জন চাষী বিএসআরআই-৪২ রং বিলাস, চায়না-২৮, অমৃত– ৮৪১, সিও-২০৮ ও বিএমসি-৮৬–৫৫০ জাতের আখ চাষ করেছেন। আবার কোন কোন চাষী এ প্রকল্পের বাইরে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও আখ চাষ করেছেন। শুধু তাই নয়, এ সকল চাষীরা আখ ক্ষেতে সাথী ফসল হিসেবে আলু, গাজর.মুলা ও ফরাশসিম চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। আখ ক্ষেতে সাথী ফসল হিসেবে বাঁধাকপি, ফুলকপিসহ আরো কয়েকটি কৃষি ফসল চাষে লামা কৃষি বিভাগ প্রযুক্তি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।

এ ব্যাপারে পৌরসভা এলাকার হরিণঝিরি গ্রামের আখ চাষি আবদুল হানিফ বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ইক্ষু গবেষণা ও উম্নয়ন জোরদারকরণ প্রকল্পের আওতায় ৩৩শতক জমিতে বিএসআরআই আখ-৪২ জাতের আখের চাষ করেছি। ক্ষেতে প্রায় ১০হাজার আখ রয়েছে। এতে সব মিলিয়ে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা। আখ বিক্রি করে কমপক্ষে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা পাব বলে আশা করছি। তিনি আরও বলেন, আগে এসকল ভূমিতে তামাক চাষ করে তিনি খরচ বাদ দিয়ে ৫ হাজার টাকাও লাভ করতে পারতাম না। সাথী ফসল হিসেবে আখের ফাঁকে গাজর, ফরাশসিম ও আলু চাষ করেছি। এ থেকেও প্রায় ২০ হাজার টাকা পেয়েছি। একই কথা জানালেন, রুপসীপাড়া ইউনিয়নের ইব্রাহিম লিড়ার পাড়ার আখ চাষী মোর্শেদুল আলম, গজালিয়া ইউনিয়নের মানিকজন ত্রিপুরা পাড়ার চাষী সমেন্দ্র ত্রিপুরা। তারা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ইক্ষু গবেষণা ও উম্নয়ন জোরদারকরণ প্রকল্প আওতায় আমাদেরকে সার, চারা, কীটনাশক দেয়া হয়েছে। এছাড়া গুড় উৎপাদনের জন্য পাওয়ার ক্রাসার, গুড় তৈরীর কড়াই, মিনি পাওয়ার ক্রাসার, সেচ মেশিন ও পাওয়ার স্পেয়ার মেশিন প্রদান করা হয়েছে। পৌরসভা এলাকার মধুঝিরি গ্রামের খুচরা আখ ব্যবসায়ী আবুল কালাম বলেন, প্রতি শত আখ ২ হাজার ৫শ’ টাকা হারে ক্রয় করে তিনি সাড়ে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকায় বিক্রি করছেন। পৌরসভার চাষী জসিম উদ্দিন, হায়দার আলী ও মোমেনা বেগম জানান, ভাদ্র থেকে আশ্বিন মাসের মধ্য চারা লাগানো হয়। চলতি মাসে আখ বিক্রির সময় হয়েছে। এখন পর্যন্ত ফলন ভালো আছে। দামও ভালো আছে। সামনে যদি ঝড়বৃষ্টি হয় তাহলে মাথায় মাথায় হাত উঠবে। কারণ ঝড়ে ভাঙা আখ বাজারে বিক্রি হয়না। ভালো ফলন হওয়ায় প্রতি ৩৩শতক জমি থেকে ১ লক্ষ ৮০ হাজার থেকে ২০ হাজার পর্যন্ত বিক্রি করা যাবে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ইক্ষু গবেষণা ও উন্নয়ন জোরদার করণ প্রকল্প লামা উপজেলায় দায়িত্বরত বৈজ্ঞানিক সহকারি বসন্ত কুমার তঞ্চঙ্গা জানান, তাঁরা কয়েকজন কৃষকের মাধ্যমে পরীক্ষা মূলকভাবে এবার ৬ একর জমিতে আখ চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে বিআরএসআই আখ-৪১ (অমৃত), ৪২, ৪৩, ৪৪ (রং বিলাস), সিও- ২০৮, চায়না, বনপাড়া গ্যান্ডারী, মিশ্রিমালা,মধুমালা, রনাঙ্গন, কিউ৬৯ ও বিএমসি-৮৬-৫৫০ জাতের আখ চাষ রয়েছে। এসবের মধ্যে চিবিয়ে খাওয়া ও চিনি বা গুড় জাত রয়েছে। গত বছর পরীক্ষামূলক চাষে উৎপাদিত আখ থেকে তিনজন চাষী ১ হাজার ৫০০ কেজি গুড় উৎপাদন করে লাভবান হয়েছেন। চলতি মৌসুমে প্রায় সাড়ে আটশ থেকে নয়শ মেট্রিক টন আখ উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে লামা উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মো. নুরে আলম জানিয়েছেন, উপজেলার জমিগুলোতে আখ চাষের অনুকুল পরিবেশ বিদ্যমান। মাটি ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকা, ভালো জাত নির্বাচন, রোগব্যাধি কম থাকায় বিগত বছরগুলোর তুলনায় এ বছর ফলন বেশি হয়েছে। আগাম আখ বাজারে আসায় কৃষকরা দামও বেশি পাচ্ছে। তামাকের বিকল্প চাষ হিসেবে এখানকার মাটিতে আখ চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।