সৈয়দ শাকিল :
নিষিদ্ধ জাল দিয়ে বঙ্গোপসাগর উপকূলে চলছে চিংড়িপোনা ধরার মহোৎসব চলছে। রেনু পোনা ধরার জাল বেঁধে রাখতে দরকার হয় খুঁটির। আর এই খুঁটির জন্য ঝাউবনের গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে।
এতে পরিবেশেরও মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। আবার ধ্বংস হচ্ছে সাগরের মৎস্যভান্ডারের। একটি চিংড়িপোনার জন্য অন্যান্য প্রজাতির ৮০টি পোনা ধ্বংস করা হচ্ছে বলে মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চিংড়িপোনা আহরণ করে যা আয় হয়, সমুদ্রের নানা প্রজাতির মাছের পোনা ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস এবং বনের গাছ কাটার কারণে ক্ষতি হয় তার সাতগুণ বেশি। অন্যদিকে সামুদ্রিক পোনা আহরণের কারণে কক্সবাজার উপকূলে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে স্থাপিত চিংড়িপোনা উৎপাদনের ৫৪টি হ্যাচারি বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
নাজিরারটেক থেকে শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত সমুদ্র সৈকতের দৈর্ঘ্য ১০০ কিলোমিটারের বেশি। লাবণী পয়েন্টের তিন কিলোমিটার বাদে পুরো সৈকতজুড়ে দাঁড়িয়ে আছে কেবল ঝাউগাছের খুঁটি।
সূত্র মতে, টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া, শিলখালী, জাহাজপুরা, বড়ডেইল, সাবরাং ও শাহপরীর দ্বীপ, উখিয়া উপজেলার মনখালী, ছেপটখালী ও ইনানী; রামু উপজেলার হিমছড়ি ও বড়ছড়া, সদর উপজেলার কলাতলী, নাজিরারটেক, নুনিয়াছরাসহ বিভিন্ন এলাকার সৈকত ও সৈকতের পাথরে অসংখ্য গাছের খুঁটি পুঁতে রাখা হয়েছে।
কক্সবাজার চিংড়িপোনা আহরণ ও বিক্রি ব্যবসায়ীরা জানান, দীর্ঘ সৈকতজুড়ে অন্তত ৮০ হাজার নারী-পুরুষ-শিশু প্রতিদিন পোনা ধরে। এর মধ্যে মিয়ানমারের অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা আছে প্রায় ৫০ হাজার। সৈকতের ঝাউবাগান ও পাশের সংরক্ষিত বনাঞ্চল দখল করে এসব রেনু আহরণকারীরা গড়ে তুলেছে বসতবাড়ি। পোনা ধরে দিনে ৫শ’ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত উপার্জন করছে। হ্যাচারিতে উৎপাদিত প্রতিটি চিংড়িপোনা বিক্রি হয় ৬ থেকে ১১ পয়সায়। আর সমুদ্র থেকে আহরণ করা পোনা বিক্রি হয় ৩০ থেকে ৫০ পয়সায়। ফলে পোনা ধরা মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।
পোনা আহরণকারী কয়েকজন জানান, জোয়ারের পানিতে পাথর ডুবে গেলে নানা প্রজাতির মাছের বিচরণ বাড়ে। জালে পোনা মাছও ধরা পড়ে বেশি।
দেখা গেছে, প্রতিটি জালের মাথায় দুটি করে গাছের খুঁটি বাঁধা। জোয়ার শুরুর সময় খুঁটিতে মশারির জাল বেঁধে দেওয়া হয়। জালে বিভিন্ন প্রজাতির রেনু পোনা আটকা পড়ে। সেখান থেকে শুধু চিংড়ি পোনা বেছে নিয়ে অন্যান্য প্রজাতির মাছের অসংখ্য পোনা বালুচরে ফেলে দেওয়া হয়। এতে মৎস্যসম্পদ ধ্বংস হচ্ছে। বিলীন হচ্ছে নানা জলজ প্রাণী।
সৈকতে কচ্ছপসহ সামুদ্রিক প্রাণী সংরক্ষণে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা জানায়, সৈকতে জালে আটকা পড়ে মারা যাচ্ছে অসংখ্য ডিম ছাড়তে আসা মা কচ্ছপসহ বিভিন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণী।
অন্যদিকে, প্রতিদিন শহর থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সৈকতে অন্তত ৩০ হাজারের অধিক নিষিদ্ধ জাল বসানো হয়। প্রতিটি জালের জন্য খুঁটি লাগে দুটি। এ হিসাবে ৩০ হাজার জালের জন্য লাগে ৬০ হাজার খুঁটি। এবং ১৫দিন অন্তর এই খুঁটি নষ্ট হয়। এতে প্রতি মাসে প্রায় লক্ষাধিক খুঁটি লাগে। পাশের সংরক্ষিত বন, সৈকতের ঝাউবাগান এবং সামাজিক বনায়নের বাগান ধ্বংস করেই এই খুঁটির জোগান দেওয়া হয়।
কক্সবাজার পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের এক কর্মকর্তা জানান, সৈকতের যত্রতত্র খুঁটি পোঁতার কারণে প্রথমে বালু সরে খুঁটির গোড়ায় গর্তের সৃষ্টি হয়। পরে জোয়ারের পানিতে বিলীন হয় সৈকত। তা ছাড়া এসব রেনু অহরণে ৮০ হাজারের বেশি মানুষ সৈকতে রাত-দিন বিচরণের ফলে রাজকাঁকড়ার বিচরণক্ষেত্র, কচ্ছপের ডিম পাড়ার স্থান নষ্টসহ জীববৈচিত্রের ধ্বংস হচ্ছে। সৈকতের সৌন্দর্য দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. আব্দুল আলীম বলেন, নিষিদ্ধ জাল জব্দ করতে অভিযান চালানো হয়। কিন্তু দুই দিন পর আবার জাল বসিয়ে পোনা ধরা শুরু হয়। স্বল্প জনবল দিয়ে বিশাল সৈকত এলাকার বিপুলসংখ্যক মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। অভিযান পরিচালনার মতো তহবিলও সরকার থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয় না।
কক্সবাজারের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (দক্ষিণ) আলী কবির জানান, পোনা ধরার জাল বাঁধার সিংহভাগ খুঁটি সংরক্ষিত ঝাউবন বা বনাঞ্চল উজাড় করে সংগ্রহ করা হয় বলে জানা গেছে। খুঁটিসহ বেশ কিছু পোনা আহরণকারীকে ধরাও হয়েছিল। কিন্তু পোনা ধরা বন্ধ করা যাচ্ছে না।
জেলার আইন শৃংখলা বাহিনী’র এক কর্মকর্তা জানান, ঝাউগাছ নিধন, সৈকতে পোনা নিধন, ট্রলারে করে মাছ আহরণ রোধে উক্ত বিভাগ পুলিশের সহযোগিতা চাইতে পারে। সংরক্ষিত বনাঞ্চলে সাধারণ রোহিঙ্গারা থাকে এবং তারাই বেশি সমুদ্রে চিংড়ি আহরণ করে।
এদিকে, লোডশেডিং আর অবিক্রির কারণে কক্সবাজারের কলাতলী, সোনারপাড়া, ইনানী ও টেকনাফে গড়ে ওঠা হ্যাচারিতে প্রতিদিন লাখ লাখ চিংড়িপোনা মারা যাচ্ছে। এ কারণে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে স্থাপিত হ্যাচারিশিল্প বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। জাহাজের মাধ্যমে গভীর সমুদ্র থেকে মা চিংড়ি হ্যাচারিতে এনে বিশেষ ব্যবস্থায় পোনা উৎপাদন করে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটসহ সারা দেশে সরবরাহ করা হচ্ছে।
হ্যাচারির মালিকদের সংগঠন শ্রিম্প হ্যাচারি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (সেব) সাধারণ সম্পাদক নজিবুল ইসলাম জানান, অপরিকল্পিতভাবে সাগর থেকে চিংড়িপোনা আহরণের কারণে মৎস্যভান্ডার যেমন ধ্বংস হচ্ছে, তেমনি হ্যাচারির মালিকেরাও লোকসানের মুখে পড়ছেন। হ্যাচারিশিল্প ধ্বংস হলে দেশে চিংড়ি চাষে ধস নামতে পারে।
হ্যাচারির মালিকরা জানান, আগে হ্যাচারিতে উৎপাদিত প্রতিটি চিংড়িপোনা বিক্রি হতো ৩০ পয়সায়। আর এখন পাঁচ-ছয় পয়সায়ও অনেকে কিনছেন না। কারণ চাষিরা ধরে নিচ্ছেন, দুর্বল প্রকৃতির এই পোনা ঘেরে ছাড়া হলে ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে পুরো ঘেরই ধ্বংস হবে। তাই তাঁরা হ্যাচারির পোনা বাদ দিয়ে সৈকত থেকে আহরিত পোনা চড়া দামে কিনছেন।
বর্তমানে সারা দেশে তিন লাখ ৭০ হাজার একর জমিতে চিংড়ির চাষ হচ্ছে। এসব জমিতে চাষের জন্য প্রয়োজন প্রায় এক হাজার কোটি পোনা। সবকিছু ঠিক থাকলে কক্সবাজারের হ্যাচারিগুলোয় উৎপাদিত হয় প্রায় ৯০০ কোটি পোনা।