বিশেষ প্রতিবেদক:
আকলিমা আক্তার সুইটি (২৫)। কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার জালিয়া পালং ইউনিয়নের বড় ইনানী গ্রামের মোক্তার আহমদের মেয়ে সে। ছোট বেলা থেকে এই গ্রামেই বেড়ে উঠা তার। সহস সরল এই মেয়েটির বয়স বেড়ে উঠতে না উঠতেই পারিবারিকভাবে ধুমধাম করে বিয়ে দিয়ে দেয় একই ইউনিয়নের পশ্চিম সোনারপাড়া গ্রামের আজিজুল হকের ছেলে সাইদুল হক রুবেল (৩২) এর সাথে। কিন্তু, প্রথম কয়েক বছর সংসার জীবন ভালই কেটেছে আকলিমা আক্তার সুইটির। সংসারে রয়েছে দুইটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান। সারাদিন এরাই পুরো পরিবারকে মাতিয়ে রাখতো এদিকে-ওদিক ছুড়াছুড়িতে। তবে সে সুখ বেশীদিন কপালে জুটেনি। বেশী টাকার লোভে স্বামী সাইদুল হক রুবেল জড়িয়ে পড়ে মরণ নেশা ইয়াবা ব্যবসায়। এক পর্যায়ে স্ত্রীকেও ইয়াবা ব্যবসায় সম্পৃক্ত করতে বাধ্য করায় স্বামী। এতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ধীরে ধীরে বেড়ে চলে পারিবারিক কলহ। চলে স্ত্রীর উপর বর্বর নির্যাতন। প্রতিদিন স্বামীর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে সংসার ত্যাগ করে চলে যায় পিত্রালয়ে। এই অবিশ্বাস্য ঘটনা অনুসন্ধানে নামেন এই প্রতিবেদক। কথা হয় মরণ নেশা ইয়াবার জন্য সংসার ত্যাগ করা সেই নারী আকলিমা আক্তার সুইটির সাথে।

আকলিমা আক্তার সুইটি বলেন, ‘২০০৯ সালে সাইদুল হক রুবেলের সাথে বিয়ে হয়। সংসারে সাদেকা হক আরফিন (৭) ও সাইমুনা হক রোদেলা (১) নামের দুইটি ফুটফুটে কন্যা সন্তান রয়েছে। কিন্তু, স্বামী গত ৩/৪বছর ধরে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে এবং নিজে সেবন করে। পাশাপাশি আমাকেও ইয়াবার চালান নিতে বাধ্য করে।

প্রথম দুয়েক বছর অল্প পরিসরে এই অবৈধ ব্যবসা করলেও পরবর্তীতে পুরোদমে চলে ইয়াবার এই ব্যবসা। মিয়ানমার থেকে স্থল ও সাগরপথে একের পর এক ইয়াবার চালান আনতে থাকে স্বামী রুবেল। এক পর্যায়ে আমাকেও ইয়াবার সাথে সম্পৃক্ত করতে বাধ্য করে রুবেল। তার কথা মতো ইয়াবার চালানের জন্য না যাওয়ায় প্রতিদিন আমার উপর নির্যাতন করে। রাতে ইয়াবা সেবন করে বাড়িতে এসে শুরু করে পাষবিক নির্যাতন’।

সুইটি বলেন, ‘আমার স্বামীর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে গত এক বছর আগে আমি টেকনাফ থেকে দুইবার ইয়াবার চালান নিয়ে আসি। কিন্তু তৃতীয় বার চালান আনতে গিয়ে আমি ইয়াবা সহ পুলিশের হাতে আটক হয়। এই খবর আমার স্বামী জানার পর মোবাইল বন্ধ করে দেয়। পরে বাড়িতে সংরক্ষিত দুই হাজার পিস ইয়াবা ও এক লাখ নগদ টাকা ছিল, তা দিয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য রফিকের মধ্যস্ততায় পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে যায়। পরে আমার স্বামী বাড়ি এসে ইয়াবা ও টাকা কোথায় জানতে চাইলে আমি তার মোবাইল বন্ধ কেন জানতে চাই এবং পুলিশকে উৎকোচ দিয়ে ছাড়া পাওয়ার বিষয়টি খুলে বলি। কিন্তু, স্বামী রুবেল আমার কথা একদম শুনতে চায়নি। আমার স্বামীর সাফ জবাব- আমাকে ওই টাকা ও ইয়াবা গুলো এনে দিতে হবে। একই সাথে আমার পিতার কাছ থেকে আরো ৩ লাখ টাকা এনে দেয়ার কথা জানায়। কিন্তু, আমি তার দেয়া দাবি গুলো পূরণ করতে পারিনি। এতে আমার উপর নির্যাতনের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। কোন উপায় না দেখে একদিন আমি আমার পিত্রালয়ে চলে যায় এবং ইউপি চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে বিচার দায়ের করি। চেয়ারম্যান নুরুল আমিন চৌধুরী আমার স্বামীকে বার বার নোটিশ প্রদান করেও বিচারে হাজির করতে পারেনি। আমার স্বামী হাজির না হওয়ায় দীর্ঘ ৬মাস পর ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল আমিন চৌধুরী আমার পক্ষে লিখিত রায় প্রদান করেন এবং আমাকে কক্সবাজার আদালতে শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেন। তার পরামর্শে আমি চলতি ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতে একটি মামলা দায়ের করি। এতে স্বামী সাইদুল হক রুবেলকে একমাত্র আসামী করা হয়েছে। আদালত আমার আবেদনটি আমলে নিয়ে কক্সবাজার জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সব্রত বিশ্বাসকে তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন’।

সুইটির বড় ভাই মোহাম্মদ ইউনুচ ভুট্টো বলেন, ‘কেউ কি চাই নিজের সংসার ত্যাগ করে পিতার বাড়িতে চলে আসতে? কখনও চাই না। আমি নিজেও অনেক চেষ্টা করেছি যে অন্তত দুই সন্তানের দিকে তাকিয়ে যেন সংসারটি ঠিকে থাকুক। বিষয়টি সুইটির স্বামী সাইদুল হক রুবেলকে অনেকবার বুঝিয়েছি। তাকে এই অবৈধ ব্যবসা থেকে ফিরে এসে ভাল কোন ব্যবসা করতে বলেছি। কিন্তু, তিনি আমাদের কথা পাত্তা দিচ্ছে না’।

স্থানীয় ইউপি সদস্য রফিক আহমদ বলেন, ‘শুরু থেকে বিষয়টি আমি জানি। রুবেল অত্যান্ত খারাপ লোক। তার স্ত্রী সুইটি যে বক্তব্য দিয়েছেন তা পুরোপুরি সত্য। তিনি আমার আত্মীয় হওয়াতে আমি আর বেশী কিছু বলতে চাই না’।

জানতে চাইলে উখিয়া উপজেলার জালিয়াপালং ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল আমিন চৌধুরী বলেন, ‘ঘটনা সত্য। আমি ওই ঘটনায় বার বার নোটিশ দিয়েও কার্যালয়ে উপস্থিত করতে পারিনি। খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, বিচার প্রার্থী সুইটি স্বামী সাইদুল হক রুবেল একজন বড় মাপের ইয়াবা ব্যবসায়ী এবং সে নিজেও সেবন করেন। পরে তার স্ত্রীকেও এই অবৈধ ব্যবসায় জড়িত করার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে তার স্ত্রী সুইটিকে নিয়ে দুইবার ইয়াবার চালানও নিয়ে আসে স্বামী রুবেল। হয়তো সে কারণে তিনি আমার কার্যালয়ে উপস্থিত হয়নি’।

উখিয়ার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো: আবুল খায়ের বলেন, ‘বিষয়টি আমাকে কেউ অবহিত করে নাই। যদি কেউ অভিযোগ করে তাহলে নিশ্চিত ধরে নিতে পারেন যে আমি তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসব। কারণ, ইয়াবা ও মাদকের বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ ঘোষনা করছি। মাদক ব্যবসায়ী যত বড় শক্তিশালী হউক না কেন তার বিরুদ্ধে অবশ্য আইনগত ব্যবস্থা নিব’।