তাজুল ইসলাম পলাশ, চন্দনাইশ থেকে ফিরে :

পেয়ারা চাষ করে বদলে গেছে দক্ষিণ চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হাজারো পরিবারের ভাগ্য। স্বাদে-গুণে ভরপুর চন্দনাইশের পেয়ারার কদর এখন সারাদেশে। খেতে সুস্বাদু হওয়ায় এখানকার পেয়ারার চাহিদা রয়েছে দেশব্যাপী। এমনকি বিদেশেও রয়েছে এসব পেয়ারার চাহিদা।

দক্ষিণ চট্টগ্রামে পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশে উৎপাদিত স্বাস্থ্যসম্মত পেয়ারা প্রতি বছর মৌসুম শুরু হলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের হাটবাজারগুলোতে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের আনাগোনা বেড়ে যায়। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে টানা চার মাস ধরে বাগানে উৎপাদিত পেয়ারা পাওয়া যায়।

এই মৌসুমে পেয়ারা বহন ও বিক্রির সঙ্গে ১০-১৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। প্রচুর বৃষ্টিপাতে পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশে জমা হওয়া নতুন পলিমাটিতে পেয়ারার চাষ হয়। এই পলি খুবই উর্বর। ফলে পেয়ারা চারার গোড়ায় কোনো ধরনের রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হয় না।

গাছে কোনো ধরনের কীটনাশকও ছিটানোর প্রয়োজন হয় না। এ কারণে জৈব সারে উৎপাদিত পেয়ারা বা স্বাস্থ্যসম্মত পেয়ারা বলা হয়। চাষিরা ডাঁটা ও পাতাসহ এই পেয়ারা সংগ্রহ করে থাকেন। তাই ফরমালিন ও রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো ছাড়াই চার-পাঁচ দিন অনায়াসে সংরক্ষণ করা যায়।

দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়া, চন্দনাইশ, বোয়ালখালী, সাতকানিয়া, বাঁশখালী ও লোহাগাড়া উপজেলায় অন্তত ১৫-২০ হাজার একর পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশে হাজার হাজার পেয়ারা বাগান রয়েছে। তবে পটিয়া উপজেলার খরনা, কেলিশহর, হাইদগাঁও শ্রীমাই এলাকা, চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর, জঙ্গল হাশিমপুর, ছৈয়দাবাদ, লট এলাহাবাদ, কাঞ্চননগর, দোহাজারী, ধোপাছড়ি এলাকার উৎপাদিত পেয়ারা সর্বোৎকৃষ্ট। পেয়ারা বাগান মালিক মোহাম্মদ আলী, আবু বক্কর, আবুল হাশেম, আমিনুল ইসলাম, ফজল আহমদ, কামাল উদ্দীন ও মালেক মিয়া সাথে কথা হলে তারা জানান, চলতি মৌসুমে শত কোটি টাকার পেয়েরা বিক্রি হবে বলে আশা করছেন তারা। তারা জানান, এখানকার উৎপাদিত পেয়ারা সাইজে বড়, দেখতে সুন্দর, খেতে সুস্বাদু এবং পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ হওয়ায় সারাদেশে এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। ফলে উৎপাদিত পেয়ারা ফাঁড়িয়ারা দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতারা এসে ট্রাকে করে কিনে নিয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরবরাহ করে থাকে। তাছাড়া চাহিদার কারণে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বর্তমানে অল্প সংখ্যক পেয়ারা বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে বলে জানান তারা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঝুবড়ি করে লালসালুর পুঁটলিতে বাঁধা অবস্থায় থরে থরে সাজানো হয়েছে পেয়ারার সারি। আর দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ীরা কিনে নিচ্ছে শ’ হিসেবে। কিন্তু বাজারে বিক্রি করেন ডজন হিসেবে। ভোর থেকে বসে পেয়ারার পাইকারি বাজার। অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে এখানকার পেয়ারা চাষিরা দলবেঁধে গভীর রাতে পেয়ারা সংগ্রহ করতে বাগানে চলে যান। ভোরের আলো ফুটতেই শত শত পেয়ারা চাষি কাঁধে করে পেয়ারার ভার নিয়ে ৭/৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আসে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সংলগ্ন অস্থায়ী বাজারে বিক্রি করতে দেখা গেছে। এখান থেকে ফাঁড়িয়ারা পেয়ারা কিনে ট্রাকসহ বিভিন্ন পরিবহনে করে সরবরাহ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এছাড়াও কাঞ্চননগর, কাঞ্চননগর রেলস্টেশন, খানহাট, গাছবাড়িয়া কলেজ গেইট, বাদামতল, বাগিচাহাট, দোহাজারীতেও বসে পেয়ারার বাজার। এসব এলাকা ছাড়াও উপজেলার মহাসড়ক সংলগ্ন রওশন হাট বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় প্রতিদিন ভোর থেকে বসে পেয়ারার পাইকারি বাজার। মহাসড়কে কোন বিলাসবহুল গাড়ি থামলেই হাতে পেয়ারা নিয়ে দৌড়ে যায় গাড়ির কাছে। আর যাত্রীরাও লোভ সামলাতে না ফেরে স্বাচ্ছন্দে কিনে নেয় রসালো এই কাঞ্চন পেয়ারা। পেয়ারা বিক্রির নির্দিষ্ট কোন বাজার না থাকায় বাধ্য হয়ে পেয়ারা বিক্রেতারা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশে বসেই পেয়ার বিক্রি করতে দেখা গেছে। প্রতি ডজন পেয়ার ৭০- ৮০ টাকা এবং মাঝারি সাইজের পেয়ারা ৪০Ñ৫০ টাকা দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে। মাঝামাঝি সময় দাম কমলেও শেষের দিকে আবারও এই পেয়ারার দাম চড়াও থাকে। পেয়ারা বিক্রেতারা অভিযোগ করে বলেন, এ অঞ্চলে উৎপাদিত বিপুল সংখ্যক পেয়ারা সংরক্ষণের জন্য কোন ব্যবস্থা না থাকায় পেয়ারা কিনতে আসা পাইকারীরা নিজেদের ইচ্ছেমতো দামে পেয়ারা কিনে নিয়ে যায়। ফলে আসল দাম পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে পেয়ারা চাষিরা। কোন সময় চাষিরা পাইকারিদের বেঁধে দেয়া দামে পেয়ারা বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানালে সেদিন পেয়ারা নিয়ে চাষিদের পোহাতে হয় চরম ভোগান্তি। শুধুমাত্র সংরক্ষণের অভাবে বাধ্য হয়েই পাইকারদের বেঁধে দেয়া দামে বিক্রি করতে হয় চাষিদের। এতে তাদের বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।

পেয়ারা চাষিরা জানান, পেয়ারা চাষের সাথে জড়িতদের আধুনিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সুদমুক্ত ঋণদানের ব্যবস্থা করা হলে এ অঞ্চলে শুধুমাত্র পেয়ারা চাষ করেই দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারবেন। এখানে উৎপাদিত পেয়ারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে রপ্তানি করা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, ওমান, বাহরাইন ও দুবাইসহ বেশ কয়েকটি দেশে। সরকারি বা বেসরকারি সহযোগিতা পাওয়া গেলে এখানকার উৎপাদিত পেয়ারা পাইকারীহারে মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে শত কোটি টাকার বৈদেশিক মদ্রা আয় করা সম্ভব বলেও মনে করেন পেয়ারা চাষের সাথে সংশিষ্টরা।

পেয়ারা চাষিরা জানান, এখানকার উৎপাদিত পেয়ারা সংরক্ষণের জন্য কটি আধুনিক হিমাগার না থাকায় প্রতিবছর নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার পেয়ারা। তাছাড়া ফাঁড়িয়াদের বেঁধে দেয়া দামে পেয়ারা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয় চাষিরা। তাই পেয়ারা চাষিরা সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে একটি পেয়ারা সংরক্ষণের জন্য হিমাগার অথবা পেয়ারা জুস কারখানা স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন।

চন্দনাইশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কামরুম মোয়াজেমাা বলেন, চন্দনাইশের পাহাড়ে বর্তমানে সাড়ে ১৮’শ মতো পেয়ারা বাগান রয়েছে। এক একটি বাগানে ৫শ থেকে ১হাজার পেয়ার গাছ রয়েছে। এর চেয়ে বেশিও রয়েছে। এখানকার পেয়ারা চাষিরা তাদের নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করেই পেয়ারা চাষ করে থাকেন। এসব পাহাড়ের মাঠি খুবই উর্বর। অল্প খরচে তারা পেয়ারা চাষ করে স্বাবলম্বি। এ উপজেলার শত শত পরিবার এখন পেয়ারা চাষ করছেন। তিনি বলেন, কৃষি অফিস থেকে তেমন কোন পরামর্শ নিতে তারা আসেন না। তবে পেয়ারা চাষিদের প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক পেয়ারা চারা বিতরণ করা হয় কৃষি অফিস থেকে। এর পরও তারা (চাষিরা) যদি কোন প্রকার সরকারি সহযোগীতা চায় আমরা তাদেও সর্বোচ্চ সহযোগীতা করবো।

বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট’র উদ্ভিদ বিঞানী ছৈয়দুল আলম সোহেল আজকালের খবরকে বলেন, পেয়ারা চাষে তেমন খরচ নেই। এটি লাভজনক একটি ব্যবসা। তবে খেয়াল রাখতে হবে কোন পোকা আসছে কিনা। বিশেষ করে বৃষ্টি’র পরে পাতা শুকিয়ে গেলে পাতার নিচে বাসা তৈরী করে একজাতীয় মাকড়। সাধারন ওষুধ ছিটিয়ে দিলে এগুলো সরে যায়। গাছের গোড়ার মাঠিগুলো যাতে শক্ত হয়ে না সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এক প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি গাছ গাছারি পরীক্ষা নিরিক্ষা করতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়েছি। উপজেলার কাঞ্চনাতে (চন্দনাইশ) যাওয়ার জন্য যদি সংশ্লিষ্টরা বলেন, তবে আমি যাব।