সিবিএন ডেস্ক:
পর্যটকদের জন্য সুখবর। কক্সবাজার থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরত্বে টেকনাফ উপজেলায় সাবরাং নামক এলাকায় এক হাজার ৪১ কিলোমিটার জমিতে গড়ে উঠছে নতুন এক পর্যটন অঞ্চল। বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) যার নাম দিয়েছে ‘সাবরাং পর্যটন অঞ্চল’। থাইল্যান্ডের পাতায়ার আদলে সাবরাংকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন অঞ্চলে রূপ দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। পর্যটন এলাকার জন্য জমি অধিগ্রহণের কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। চারটা বুলডোজার, চারটা এস্ককাভেটর মেশিন দিয়ে এখন চলছে ভূমি উন্নয়ন ও বাঁধের নির্মাণকাজ। আগামী বছরের মধ্যে সংযোগ সড়কসহ ভূমি উন্নয়ন ও বাঁধের নির্মাণকাজ শেষ হবে বলে আশা করছে বেজা। প্রাথমিক অবকাঠামো নির্মাণের পর মূল পর্যটন এলাকা গড়ে তুলতে একই বছর ডেভেলপার নিয়োগ দেওয়া হবে বলে জানান বেজার কর্মকর্তারা।

একজন পর্যটক কল্পনায় ছবি আঁকতে পারেন। কক্সবাজারের কলাতলী থেকে ৮০ কিলোমিটারের মেরিন ড্রাইভ সড়কের এক পাশে সারি সারি পাহাড়; আরেক পাশে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত। তাতে সৌন্দর্যে মোহিত হতে বাধ্য যেকোনো পর্যটকের। মেরিন ড্রাইভ সড়ক যেখানে শেষ, সেখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বে সাবরাং পর্যটন অঞ্চল। বেজার কর্মকর্তারা বলছেন, সাবরাং হবে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা পর্যটন অঞ্চল। বিনিয়োগ হবে কয়েক হাজার কোটি টাকা। পর্যটন এলাকায় শুধু ব্যাটারিচালিত যান চলাচল করবে এমন পরিকল্পনাও রয়েছে বেজার। সরেজমিনে ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, সরকার সারা দেশে যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সাবরাং তার একটি। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাবরাং পর্যটন অঞ্চলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রস্তাবিত সাবরাং পর্যটন অঞ্চলের ভূমি উন্নয়ন ও বাঁধের নির্মাণকাজ করছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং ডার্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। ভবিষ্যতে যেকোনো ঝড়, জলোচ্ছ্বাস থেকে পর্যটন এলাকাকে রক্ষায় মেরিন ড্রাইভের সমান্তরাল অর্থাৎ ১৫ ফুট উচ্চতায় নির্মাণ করা হচ্ছে বাঁধ। ভূমি উন্নয়নও করা হবে সমানভাবে। দিন-রাত শতাধিকেরও বেশি শ্রমিক কাজ করছে পর্যটন অঞ্চলে। কর্মকর্তাদের থাকার জন্য চলছে প্রশাসনিক ভবন নির্মাণের কাজও। পুরো এলাকায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। স্থানীয় অনেকের চাকরি হয়েছে পর্যটন অঞ্চলে। সাবরাং পর্যটন অঞ্চলের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকদের কথা মাথায় রেখেই পর্যটন অঞ্চলটি করা হচ্ছে বলে জানান বেজার কর্মকর্তারা।

সরেজমিনে ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মেরিন ড্রাইভ সড়কের পর সাবরাং পর্যটন অঞ্চলের কাজ শুরুর পর থেকে সেখানে জমির দাম বেড়ে চলেছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে সাবরাং এলাকায় জমি কেনার জন্য। পাঁচ বছরের ব্যবধানে সেখানে জমির দাম বেড়েছে ২০ গুণ। ২০১৩ সালে টেকনাফের সাবরাং এলাকায় ৪০ শতক (এক কানি) জমির দাম ছিল এক লাখ টাকা। সেটি এখন বেচাকেনা হচ্ছে ২০ লাখ টাকায়। পাঁচ বছর আগে প্রতি শতকের জমির দাম ছিল পানির দরে আড়াই হাজার টাকা। সেটি এখন ৫০ হাজার টাকায় ঠেকেছে। প্রতিদিনই সেখানে জমির দাম বাড়ছে। সুইট ড্রিম, হোটেল সি ওয়ার্ল্ডসহ অনেক কম্পানির সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে রাখা হয়েছে। যারা পাঁচ বছর আগে জমি বিক্রি করে দিয়েছে, তাদের এখন মাথায় হাত। অনেকে বুঝতে পারেনি জমির দাম এতটা বাড়তে পারে। সাবরাং পর্যটন অঞ্চলের পাশে নিজ জমিতে একটি চায়ের দোকান দিয়েছেন স্থানীয় দোকানদার ইউনূস আলী। তিনি জানালেন, ‘তাঁর জমির বিক্রি করতে অনেকে বেশি দাম বলছেন। লোভ দেখাচ্ছেন। কিন্তু আমি এই জমি বিক্রি করব না। যারা আগে জমি বিক্রি করেছে, তারা এখন মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।’

জানতে চাইলে হোটেল সি ওয়ার্ল্ডের কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন বলেন, ‘মেরিন ড্রাইভ সড়ক হয়ে যাওয়ার পর যাতায়াত ব্যবস্থারও উন্নতি হয়েছে। এসব দিক মাথায় রেখে আমরা সেখানে জমি কিনে রেখেছি। ভবিষ্যতে সেখানে হোটেল কিংবা মোটেল করা হবে।’

এদিকে প্রস্তাবিত সাবরাং পর্যটন অঞ্চল চালু হলে দেশের সর্ব দক্ষিণের স্থান সেন্ট মার্টিনসে যাওয়ার সময়ও কমে আসবে। দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপে যাওয়ার রুটেও কিছুটা পরিবর্তন আসবে। এখন টেকনাফের দমদমিয়া নামক জায়গা থেকে সেন্ট মার্টিনসে লঞ্চে যেতে সময় লাগে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। সাবরাং পর্যটন অঞ্চল হয়ে গেলে সেখান থেকে মাত্র আধা ঘণ্টায় যাওয়া যাবে সেন্ট মার্টিনসে। সময় কমবে দেড় ঘণ্টা। অর্থাৎ একজন পর্যটক কক্সবাজার সুমদ্রসৈকত দেখার পর সাবরাং পর্যটন অঞ্চল এবং সেন্ট মার্টিনস একসঙ্গে দেখার সুযোগ তৈরি হবে।

জানতে চাইলে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, ‘কোনো পর্যটক কক্সবাজার এলে তাঁকে সাবরাং আসতে হবে। সাবরাং দেখার পর সেন্ট মার্টিনসেও যাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। আমরা সাবরাংকে একটি আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন অঞ্চল করতে চাই। যেখানে বিদেশি পর্যটকদের আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হবে।’

এদিকে সাবরাং পর্যটন অঞ্চলে জমি চায় বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন। সেখানে জমি পেলে পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন বিনোদনের ব্যবস্থা রাখা হবে। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের পরিচালক আব্দুস সবুর মণ্ডল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মেরিন ড্রাইভের কারণে সাবরাংয়ের যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। পর্যটনের জন্য আদর্শ জায়গা সাবরাং। সাবরাং পর্যটন এলাকায় আমরা বেজার কাছ থেকে জমি চেয়েছি। জমি পেলে আমরা সেখানে পর্যটকদের জন্য বিনোদনের ব্যবস্থা করব।’

বেজার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাবরাং পর্যটন অঞ্চলে বিনিয়োগে এরই মধ্যে আগ্রহ দেখিয়েছে সিঙ্গাপুরভিত্তিক কম্পানি ইন্টার-এশিয়া পিটিই গ্রুপ। পর্যটকদের সামনে পাতায়া প্রবাল দ্বীপকে মোহনীয় করে তুলতে বড় আকারে বিনিয়োগ করেছিল সিঙ্গাপুরভিত্তিক কম্পানিটি। টেকনাফ সমুদ্রসৈকতের কোল ঘেঁষে সাবরাং পর্যটন অঞ্চলটি তৈরি করতে ১৫০ কোটি ডলার, বাংলাদেশি টাকায় ১২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে চায় কম্পানিটি। বিল্ড-ওন-অপারেট-ট্রান্সফার (বিওওটি) পদ্ধতিতে ৯৯ বছরের জন্য লিজ নিয়ে সাবরাং পর্যটন অঞ্চল করতে চায় ইন্টার-এশিয়া। সাবরাং পর্যটন পার্কে একাধিক আন্তর্জাতিক মানের হোটেল, রেস্টুরেন্ট, কটেজ, অডিটরিয়াম, কনভেনশন হল, নাইট ক্লাব, বার, বিচ ভিলা, ওয়াটার ভিলা, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, কার পার্কিং, সুইমিংপুল, ল্যান্ডস্কেপিংসহ বিভিন্ন পর্যটন সুবিধা রাখা হবে বলে জানিয়েছে ইন্টার-এশিয়া।

পর্যটক আকর্ষণে সাবরাংকে কিভাবে সাজানো হবে তারও একটি পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে ইন্টার-এশিয়া গ্রুপ। তাতে বলা আছে, সাবরাংয়ে একাধিক আন্তর্জাতিক মানের হোটেল ও রিসোর্ট নির্মাণ করা হবে। থাকবে পরিবেশবান্ধব শহর, সুন্দরবনের থিম পার্ক ও নাইট সাফারি, রয়্যাল ক্যাসিনো, গলফ ক্লাব, অ্যাকোয়ারিয়াম, জাদুঘর, হেরিটেজ পার্ক, শপিং মল, রেস্টুরেন্ট, ক্লাবসহ অন্যান্য সুবিধা। এ ছাড়া থাকছে ১০০ শয্যার হাসপাতাল এবং স্কুল।