ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের অসম্ভব তুখোড় মেধাবী ছাত্র ছিল ছেলেটা। ম্যাট্রিকে ফার্স্ট ক্লাস এবং ইন্টারে সারা দেশের মধ্যে ফোর্থ স্ট্যান্ড করেছিল ছেলেটা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর অবশ্য তার পরিচয়টা পাল্টে গেল, সে হয়ে উঠলো এনএসএফের গ্যাংস্টার, সারাদিন লোডেড পিস্তল হাতে ক্যাম্পাস দাবড়ে বেড়ায়, বাকি ছাত্র সংগঠনগুলোর সাথে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সিভিল ওয়ার নিত্যদিনের ডালভাত…

করাচি ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর একাত্তরের মার্চে যখন ও ঢাকায় ফিরে এল, তখন বাতাসে রক্তের গন্ধ, আসন্ন মহাপ্রলয়ের আভাস। ২৬শে মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর পরই নিরীহ বাঙ্গালীর তাজা রক্তস্রোত পেরিয়ে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগদানের নিয়োগপত্র হাতে এসেছিল ছেলেটার, ঘৃণাভরে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিয়েছিল, বুকে ভেতর বাজছে দামামা, যুদ্ধে যেতে হবে, ছিঁড়েখুঁড়ে আলাদা করে ফেলতে হবে পাকিস্তানী শুয়োরগুলোকে, চোখ দুটো তার জ্বলছিল, ভাটার গনগনে আগুনের মত… বাবা আবদুল বারী সাহেব টের পেয়েছিলেন সেটা, ছেলের মত নির্বিকারচিত্তে পাথরগলায় মা রওশন আরাকে বললেন, তোমার তো ছয় ছেলে, একজনকে না হয় দেশের জন্য দিয়েই দিলে।”…

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই গ্যাংস্টার ছেলেটা এরপর এক অদ্ভুত রূপকথার জন্ম দিয়ে বসলো। ঠিক ওর মতই কয়েকটা ক্র্যাক ছেলেপেলে জুটে গেল ওর সাথে, অত্যাধুনিক অস্ত্র হাতে অসংখ্য পাকিস্তানী শুয়োরে গিজগিজ করতে থাকা আতংকে জমে যাওয়া ঢাকা শহরকে কোন এক জাদুবলে পাল্টে দিল এই ডেয়ারডেভিলগুলো…। চোখের সানগ্লাস, ঠোঁটে সিগারেট, হাতে স্টেনগান– রাজপুত্রের মত চেহারা আর স্টাইলিশ বেশভূষা দেখে বোঝার উপায় নাই কি ভয়ংকর তারছিঁড়া পোলাপান এরা। ঢাকা শহরটা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য একেবারে নরক বানায়ে তুলছিল এই বাচ্চা ছেলেগুলো। তারছিঁড়া ক্র্যাক পোলাপান ছিল সব, অসামান্য দুঃসাহসী সব কর্মকাণ্ড দেখে দুই নম্বরের সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ বললেন, দিজ আর অল ক্র্যাক পিপল। তখন থেকেই এই ছোট্ট দলটার নাম ক্র্যাক প্লাটুন…।

এরপর সেই তারছিঁড়া অসমসাহসী ছেলেটা অংশ নিল একের পর এক অপারেশনে, অপারেশন এলিফ্যান্ট রোড পাওয়ার স্টেশন,অপারেশন যাত্রাবাড়ী পাওয়ার স্টেশন,অপারেশন সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন,অপারেশন ফার্মগেট চেক পয়েন্ট, অপারেশন ফ্লায়িং ফ্লাগস, অপারেশন ডেস্টিনেশন আননোন– পুরো ঢাকা শহরে হিট অ্যান্ড রান পদ্ধতিতে একের পর এক ভয়ংকর গেরিলা আক্রমন চালাইতে লাগলো, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্তরাত্মা কেঁপে গেল, শহরের প্রতিটা জায়গায় প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণে আর অ্যামবুশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হতভম্ব হয়ে গেল, ইন্দুরের বাচ্চার মত সন্ধ্যা হইলেই অসম্ভব আতংকে গর্তের ভিতর গিয়ে লুকাইতে লাগলো,শহর জুড়ে নিরীহ মানুষের উপর অত্যাচার তো দূরে থাক, স্রেফ সন্ধ্যার পর নিয়মিত টহল দিতেও তাদের খুঁজে পাওয়া গেল না। বিচ্ছুদের আচমকা গাবুইরা মাইরের ভয় আর আতংক ওদের পুরোপুরি তেলাপোকা বানিয়ে ফেললো… নর্দমার ময়লায় অন্ধকার কোনে লুকিয়ে থাকা তেলাপোকা…

ছেলেটা ধরা পড়ে ২৯শে আগস্ট।আলবদর কমান্ডার আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ইনফরমারের তথ্যে ধরা পড়ে ছেলেটাসহ ক্র্যাক প্লাটুনের নয় জন। অকল্পনীয় অত্যাচার চালানো হয়েছিল ওদের উপর, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং নেবার রুট আর অস্ত্রের চালানের রুটটা জানার জন্য ছেলেটার হাড়গুলো সব একটা একটা করে ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল,প্লায়ারস দিয়ে তুলে নেওয়া হয়েছিল সবগুলো নখ, একটা শব্দও উচ্চারন করেনি ছেলেটা। শেষ পর্যন্ত যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সুইচবোর্ডের সকেটের ভেতর আঙ্গুল ঢুকিয়ে শক খেয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল সে, পারেনি। এক পাকিস্তানী হাবিলদার পেটাতে পেটাতে তাকে সরিয়ে এনেছিল, ঝরঝর করে রক্ত ঝরতে থাকা মুখটা তুলে বলেছিল, পাশের সেলে ওর বন্ধুরা তথ্য দিচ্ছে, ওরা মুক্তি পেয়ে যাবে, সেও যদি তথ্যগুলো দেয়, তবে ছেড়ে দেওয়া হবে তাকে। ভাটার মত জ্বলছিল চোখদুটো, কণ্ঠে অসম্ভব গাম্ভীর্য এনে প্রায় আধমরা ছেলেটা পাথরকঠিন গলায় বললো, “আমি কিছুই বলব না, যা ইচ্ছা করতে পারো। ইউ ক্যান গো টু হেল..

সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে ছেলেটাকে মেরে ফেলা হয়, বাকিদের সাথে,লাশটা খুজে পাওয়া যায়নি। একটা স্বাধীন দেশের লাল-সবুজ পতাকা আনতে অকাতরে প্রানটা উৎসর্গ করেছিল ছেলেটা,ছেলেটার নাম বদি, বদিউল আলম বীর বিক্রম, মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত ছেলেটা অসম্ভব গাম্ভীর্যে নিতান্তই অবহেলার দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল পাকিস্তানী শুয়োরগুলোর দিকে, ভাটার মত জ্বলতে থাকা চোখ দুটোতে ছিল কেবল অসম্ভব ঘৃণা… অসম্ভব অসম্ভব ঘৃণা…

আর আজ ৪৭ বছর পর শিক্ষিত শুষিল ভদ্রসমাজের বিদগ্ধজন ঘৃণার চাষাবাদ না করে পাকিস্তান এবং পাকিস্তানীদের প্রতি ভালোবাসার গোলাপ বয়ে নিয়ে যেতে আহ্বান জানান আমাদের, উদাত্ত কণ্ঠে বলেন,

“কিন্তু তাই বলে আমরা প্রত্যেক পাকিস্তানিকেই ঘৃণা করব? সেই ঘৃণার বীজ ছড়িয়ে দেব প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে? পাকিস্তানে কি ভালো মানুষ একটিও নেই?”

শহীদ বদিউল আলম বীর বিক্রমের টকটকে তাজা রক্তে ভেজা এই জমিনে দাঁড়িয়ে পাকিস্তান আর পাকিস্তানীদের ভালোবেসে বুকে টেনে নেবার আহ্বান জানাতে শুষিল ভদ্র সমাজের কি একটু লজ্জাও হয় না? একবিন্দুও না?

সহযোগী তথ্যসুত্র-
১। ব্রেইভ অফ হার্ট
২। একাত্তরের দিনগুলি
৩। ক্র‍্যাক প্লাটুনের বদি
৪। শহীদ রুমি স্মারকগ্রন্থ
C: rahman raad

—সংগৃহিত