লোকসানের কবলে পাঁচটি, মুনাফার দেখা পেলেও আগের বছরের তুলনায় কমেছে ১১টির, পরিচালন নগদ প্রবাহ বা ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়েছে ১০টির, সম্পদের মূল্য কমেছে ১০টির এবং ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে একটির সম্পদের মূল্য। এমন চিত্র দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা লিজিং কোম্পানিগুলোর।

সার্বিকভাবে আমানত, তারল্য, মুনাফা ও সম্পদের মূল্য নিয়ে এক প্রকার সংকটের মধ্যে রয়েছে দেশের অব্যাংকিং আর্থিকপ্রতিষ্ঠানগুলো।

চলতি বছরের প্রথমার্ধের হিসাবে, মুনাফা, সম্পদের মূল্য ও ক্যাশ ফ্লো- এই তিনটি সূচকের কোনোটিতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি তালিকাভুক্ত মাত্র দুটি অব্যাংকিং আর্থিকপ্রতিষ্ঠানের। আর জুলাই-জুন হিসাববর্ষ নির্ধারণ থাকায় ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)-কে বিবেচনায় নেয়া হয়নি।

বাকি ২০টি প্রতিষ্ঠানের মুনাফা, সম্পদের মূল্য অথবা ক্যাশ ফ্লো- এই তিনটির এক বা একাধিক সূচকে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি)। প্রতিষ্ঠানটি নগদ অর্থ সংকটের পাশাপাশি লোকসানে নিমজ্জিত রয়েছে। এমনকি ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে এর সম্পদের মূল্যও।

বাকিগুলোর মধ্যে লোকসানের পাশাপাশি সম্পদের মূল্য কমেছে চারটির। এর মধ্যে দুটির অর্থের সংকটও আছে। মুনাফায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ছয়টির মুনাফা ও সম্পদের মূল্য আগের বছরের তুলনায় কমেছে। এছাড়া মুনাফা কমে যাওয়ার পাশাপাশি অর্থসংকটে পড়েছে তিনটি প্রতিষ্ঠান। আবার মুনাফা কিছুটা বাড়লেও অর্থসংকটে রয়েছে তিনটি প্রতিষ্ঠান।

নিয়ম অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে প্রতি তিন মাস পরপর আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হয়। এরই আলোকে তালিকাভুক্ত ২৩ অব্যাংকিং আর্থিকপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২২টির চলতি বছরের প্রথমার্ধ শেষে এপ্রিল-জুন প্রান্তিকের পাশাপাশি অর্ধবার্ষিক (জানুয়ারি-জুন) প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকাশিত ওই আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধিকাংশ অব্যাংকিং আর্থিকপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর গ্রাহকের আস্থাও নেই। ব্যক্তি বা প্রাতিষ্ঠানিক আমানত না পাওয়ায় প্রতিনিয়ত কলমানি মার্কেটে ধরণা দিতে হচ্ছে। তারল্য সংকটের কারণে গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে অনেকে সমস্যায় পড়ছে। অবার ব্যাংক খাতও খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই। এর নেতিবাচক প্রভাবও আর্থিক খাতে রয়েছে। যে কারণে অব্যাংকিং আর্থিকপ্রতিষ্ঠানগুলোর অর্ধবার্ষিক প্রতিবেদনে এমন সংকটের চিত্র দেখা দিয়েছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, লিজিং কোম্পানিগুলোকে এখন ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়। সে কারণে হয়তো তাদের ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। তারা অনেকেই প্রায় লোকজনকে ম্যাসেজ পাঠায় যে, আমরা এত শতাংশ মুনাফা দিচ্ছে। আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণ হয়তো তাদের ভালো হচ্ছে না।

লিজিং কোম্পানিগুলো সংকটে আছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, অর্ধবার্ষিক প্রতিবেদনে লিজিং কোম্পানিগুলোর যে চিত্র উঠে এসেছে তা এ খাতের সংকটের ইঙ্গিতই বহন করে। ব্যাংক খাতের অবস্থাও ভালো নয়, তেমনি লিজিং প্রতিষ্ঠানের অবস্থাও ভালো নয়। তারা গ্রাহকের আস্থা পাচ্ছে না। এর সঙ্গে আমাদের দেশে আর্থিকপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অনেক বেশি। যে পরিমাণ ব্যাংক দেয়া হয়েছে, এত ব্যাংকের তো দরকার নেই। এতগুলো লিজিং কোম্পানিরও দরকার ছিল না।

নাম প্রকাশ না করে একটি আর্থিকপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, অনেক লিজিং কোম্পানি এখন আমানত পাচ্ছে না। এ খাতে এক ধরনের ইমেজ সংকট তৈরি হয়েছে। কস্ট অব ফান্ড বেড়ে যাওয়ায় কিছু প্রতিষ্ঠান লোকসানের মুখে পড়েছে। এখন আমাদের সবাইকে সিঙ্গেল ডিজিটে লেন্ডিং করতে হচ্ছে। আবার ব্যাংকগুলো অ্যাগ্রেসিভ ফাইন্যান্স করছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। এসব কারণে আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো কিছুটা সমস্যার মধ্যে আছে।

এদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি-জুন সময়ের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিআইএফসি’র পাশাপাশি ফারইস্ট ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং ও প্রাইম ফাইন্যান্স মোটা অঙ্কের লোকসানে রয়েছে। লোকসানের পাশাপাশি প্রাইম ফাইন্যান্স ও পিপলস লিজিং’র সম্পদমূল্যও আগের বছরের তুলনায় কমে গেছে। সেই সঙ্গে ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে ক্যাশ ফ্লো।

ক্যাশ ফ্লো বা পরিচালন নগদ প্রবাহ ঋণাত্মক হয়ে পড়ার অর্থ হলো- নগদ অর্থের সংকট তৈরি হওয়া। শেয়ারপ্রতি ক্যাশ ফ্লো যত বেশি ঋণাত্মক হবে নগদ অর্থের সংকটও তত বাড়বে। এ অবস্থা তৈরি হলে চাহিদা মেটাতে চড়া সুদে টাকা ধার করতে হতে পারে। এতে খরচ বেড়ে যায় এবং আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

এ বিষয়ে মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ক্যাশ ফ্লো বা পরিচালন নগদ প্রবাহ ঋণাত্মক হওয়ার মানে হলো- অবশ্যই তারল্য সংকট আছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া এবং আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।

ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে পড়া অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- বিডি ফাইন্যান্স, ফাস ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, আইপিডিসি, প্রিমিয়ার লিজিং, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল এবং ইউনাইটেড ফাইন্যান্স। এর মধ্যে ইউনাইটেড ফাইন্যান্স ও বিডি ফাইন্যান্সের শেয়ারপ্রতি মুনাফা ও সম্পদের মূল্য আগের বছরের তুলনায় কমেছে।

আগের বছরের তুলনায় সম্পদের মূল্য ও মুনাফা কমে যাওয়ার তালিকায় রয়েছে- বে-লিজিং, আইডিএলসি, ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স ও ফনিক্স ফাইন্যান্স। ক্যাশ ফ্লো ও সম্পদের মূল্যে নেতিবাচক প্রভাব না পড়লেও মুনাফা কমে যাওয়ার তালিকায় রয়েছে- জিএসপি ফাইন্যান্স, ইসলামিক ফাইন্যান্স, লংকাবাংলা ফাইন্যান্স ও মাইডস ফাইন্যান্স।

ডিএসই’র পরিচালক রকিবুর রহমান এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, ব্যাংকের পাশাপাশি আর্থিক কোম্পানি পুঁজিবাজারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আর্থিক খাতের খারাপ অবস্থা পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আমাদের এখানে অনেকে আছেন যারা বিভিন্ন জায়গায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। তারা অনেক সৎ। তারা ভালো একটা পুঁজিবাজার চাই। কিন্তু আমরা আইনের মারপ্যাঁচে অনেক কিছু করতে পারছি না। তবে একটা একটা করে বেরিয়ারগুলো (প্রতিবন্ধকতা) আমরা ভাঙতে পারবো বলে আশা করি। এছাড়া একটি কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন এক প্রান্তিকে খারাপ আসতেই পারে। খারাপ অবস্থার একটি পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত আমাদের পক্ষ থেকে ডিসটার্ব করা ঠিক হবে না।

অধিকাংশ অব্যাংকিং আর্থিকপ্রতিষ্ঠান খারাপ অবস্থায় থাকলেও উত্তরা ফাইন্যান্স ও ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং ফাইন্যান্স করপোরেশন লিমিটেড (ডিবিএইচ)-এর মুনাফার পাশাপাশি সম্পদমূল্য বেড়েছে এবং ক্যাশ ফ্লো পজেটিভ রয়েছে। এর মধ্যে উত্তরা ফাইন্যান্স জানুয়ারি-জুন সময়ে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে পাঁচ টাকা ৮১ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল পাঁচ টাকা ৫৮ পয়সা। চলতি বছরের জুনশেষে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি সম্পদের মূল্য দাঁড়িয়েছে ৫২ টাকা ৫৫ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৪৯ টাকা ৭৪ পয়সা।

ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং ফাইন্যান্স করপোরেশন লিমিটেড জানুয়ারি-জুন সময়ে শেয়ারপ্রতি মুনাফা করেছে চার টাকা ৮৩ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল চার টাকা ৭৬ পয়সা। চলতি বছরের জুনশেষে প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারপ্রতি সম্পদের মূল্য দাঁড়িয়েছে ৩৭ টাকা ৫৯ পয়সা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৩২ টাকা ৭৩ পয়সা।

তালিকাভুক্ত লিজিং কোম্পানিগুলোর আর্থিক চিত্র 

প্রতিষ্ঠানের নাম শেয়ারপ্রতি মুনাফা (টাকায়) শেয়ারপ্রতি মুনাফা (টাকায়) শেয়ারপ্রতি পরিচালন নগদ প্রবাহ (টাকায়) শেয়ারপ্রতি সম্পদের মূল (টাকায়)
জানুয়ারি-জুন ২০১৮ জানুয়ারি-জুন ২০১৭ এপ্রিল-জুন ২০১৮ এপ্রিল-জুন ২০১৭ জানুয়ারি-জুন ২০১৮ জানুয়ারি-জুন ২০১৭ ৩০ জুন -২০১৮ ৩০ জুন -২০১৭
বে লিজিং .২৪ .৬২ .১৫ .৩৯ ২.৫৪ ১.২৬ ১৮.২৯ ১৮.৯৯
বিডি ফাইন্যান্স .০৩ .৫০ .০২ -.০৭ -১.৯৬ ৫.২৭ ১৪.৯৫ ১৬.৪১
বিআইএফসি -৩.৫৭ -৩.৪৫ -১.৬৫ -১.৭৫ -২.০১ .৫৮ -৬৯.৯৭ -.৩০
ডিবিএইচ ৪.৮৩ ৪.৭৬ ১.৪৫ ১.৭৩ ১২.৮৭ .৮০ ৩৭.৫৯ ৩২.৭৩
ফারইস্ট ফাইন্যান্স -১.৪৩ -৪.৪৩ -১.৩৯ -.৬০ ১.২১ -.০৪ ৪.৯৪ ৬.৩৭
ফাস ফাইন্যান্স .০৫ .৫৬ -.০১ -.০২ -৩.৩২ ২.৬৩ ১৩.৩৯ ১৩.৩৪
ফার্স্ট ফাইন্যান্স -১.৯৮ -.৪৭ -.২৮ .৩৫ ৬.১৩ -৪.১৯ ৮.৮৯ ১৩.০৩
জিএসপি ফাইন্যান্স .৮৯ ১.০৭ .৪৬ .৫৬ .৪৫ -৩.০১ ২১.৩৩ ২০.৪৪
আইডিএলসি ২.৯৫ ৩.২০ ১.৪৯ ১.৫৫ ৯.৬৬ ৩.৭৫ ৩৩.৩৬ ৩৩.৪১
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং .৫২ -.৬৫ .০৮ -.৬০ -৩.৬৬ -২.৩৭ ১৩.৩৫ ১২.৮২
আইপিডিসি .৭৮ .৬০ .৪৫ .৩১ -২.৬৮ .৪২ ১৫.০৪ ১৪.২৬
ইসলামিক ফাইন্যান্স .৬১ .৭৩ .৩০ .২১ ৩.৪৫ ২.৮৮ ১৩.৪৪ ১৩.২০
লংকাবাংলা .৫১ ১.৩৮ .৩৫ .৭৩ ১.২৬ ১.১৫ ১৮.৮০ ১৮.০৩
মাইডস ফাইন্যান্স .১৪ .৮৯ -.২৪ .৩০ .০৩ ১.৪৬ ১১.০৩ ১০.৮৯
ন্যাশনাল হাউজিং ফাইন্যান্স ১.১১ ১.২৬ .৬৩ .৭০ ২২.৩৮ -.২৯ ১৫.১৯ ১৫.৯৮
ফনিক্স ফাইন্যান্স .৮৮ ১.২৪ .৩৮ .৬৬ ৩.৬৩ ১.৯৬ ২২.২৯ ২২.৩১
পিপলস লিজিং -.৪৯ .৩১ -.৪৩ .১০ -১.০৩ ১.৫৫ ১০.৪০ ১১.১৫
প্রিমিয়ার লিজিং .০৮ .৪১ .০১ .০৪ -১.৬৪ ৬.৩৩ ১৫.৭৭ ১২.০২
প্রাইম ফাইন্যান্স -১.৭৪ -১.৪৫ -১.২৩ -.৮৯ -১.৮৭ .৭৫ ৬.৭৯ ৮.৭৬
ইউনিয়ন ক্যাপিটাল .০৫ -১.২৭ -.১৩ -১.৭১ -৫.৫৯ -৩.৭২ ১৩.৯৭ ১৩.৯২
ইউনাইটেড ফাইন্যান্স .৫৬ .৬৫ .২৫ .৩১ -.৬৪ -.৯৭ ১৫.৭৫ ১৬.১৪
উত্তরা ফাইন্যান্স