পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা বিভিন্ন ধরনের কূটনীতিক তৎপরতা চালাচ্ছি।’

মিয়ানমারের সঙ্গে দর কষাকষির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি কোনও গোপন বিষয় নয় যে মিয়ানমারের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি আছে। আমরা সবসময় বলেছি এটি একটি রাজনৈতিক সমস্যা। এটিকে নিরাপত্তা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে হবে না। আমাদের কাছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিষ্কার নির্দেশনা আছে যে, বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গাদের যত সম্ভব সাহায্য করার। সেই অনুযায়ী আমরা আমাদের সীমান্ত এখনও উন্মুক্ত রেখেছি।’

তিনি বলেন, ‘এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে পাঁচ দফা প্রস্তাব উপস্থাপন করেন এবং এটিই আমাদের মৌলিক অবস্থান। আমরা টেকসই ও অধিকার ভিত্তিক প্রত্যবাসন চাই। প্রত্যাবাসন হবে স্বতঃপ্রণোদিত এবং আমরা চাই মিয়ানমার সেখানে একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করবে। যার ফলে রোহিঙ্গারা সম্মানজনক ও নিরাপদ জীবনযাপন করতে পারে।’

প্রত্যাবাসন কবে শুরু হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেদিন মিয়ানমার তাদের ফেরত নেওয়ার জন্য তৈরি হবে।’

পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক বলেন, ‘আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বারবার বলছি— রোহিঙ্গাদের রক্ষা করতে বাংলাদেশ যে ত্যাগ স্বীকার করেছে, তার জন্য যেন আমাদের শাস্তি না দেওয়া হয়।’

কীহয়েছিল২৫আগস্ট: গত বছরের ২৫ আগস্ট আরসা আক্রমণের অজুহাত দেখিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা বিরোধী অভিযান শুরু করে। তবে এটা ছিল পূর্ব পরিকল্পিত। ২০১৬ সালে আরসা বিরোধী অভিযানের নামে রোহিঙ্গা নিধন শুরু হলে ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। সেই সময়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এর কোনও বিরোধিতা না করার কারণে মিয়ানমার এর পুনরাবৃত্তি করার সাহস পায়। ২০১৭ সালে তারা একই কাণ্ড আরও বড় আকারে ঘটায়। ২০১৭ এর আগস্টের আগ পর্যন্ত প্রায় পুরোটা সময় তারা আরসাবিরোধী ছোট ছোট বিভিন্ন অপারেশন চালায়। আগস্টের শুরুর দিকে রাখাইনের মায়ো পাহাড়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয় এবং কুখ্যাত ৩৩তম লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনকে রাখাইনে পাঠানো হয়। মিয়ানমারের সামরিক কার্যক্রম বিবেচনা করলে মনে হয় ২৫ আগস্ট প্রায় ৩০ পুলিশ চৌকিতে আক্রমণের বিষয়টি একটি সাজানো নাটক ছিল।

বাংলাদেশ কী করেছে: এই সমস্যা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ তার সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিয়েছিল, যাতে করে রোহিঙ্গারা তাদের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়। এখন পর্যন্ত সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে এবং তাদের থাকার জন্য অনেকগুলো ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এর আগে থেকেই প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বাস করছে। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং মিডিয়াকে বাংলাদেশ অবাধ সুযোগ দিয়েছে অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য।

প্রত্যাবাসন চুক্তি: আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের মুখে মিয়ানমার আলোচনার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে বসতে রাজি হয়। দুই পক্ষ কয়েক দফা আলোচনার পরে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে নভেম্বরে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়। এরপর ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে মাঠ পর্যায়ে প্রত্যাবাসন সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য একটি ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট চুক্তি করা হয়।

গত এক বছর ধরে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। কিন্তু মিয়ানমারের অসততা এবং অসহযোগিতার কারণে প্রত্যাবাসন শুরু করা সম্ভব হয়নি।

সরকারের একজন কর্মকর্তা বলেন, “মিয়ানমার এখনও রোহিঙ্গা, প্রত্যাবাসন ও বাংলাদেশ নিয়ে মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছে। যখন জাতিসংঘসহ সারা বিশ্ব বলছে রাখাইনে ফিরে যাওয়ার মতো পরিবেশ নেই তখন মিয়ানমার বলছে— বাংলাদেশের জন্য প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা যাচ্ছে না। শুধু তাই না তারা এখন বলছে সব রোহিঙ্গাই সন্ত্রাসী এবং গত বছরের ২৫ আগস্টের পরে রাখাইনে নির্যাতন সংক্রান্ত সব খবর ফেক নিউজ।’’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক কর্মকর্তা বলেন, ‘‘আমরা সম্প্রতি রাখাইন পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। সেখানে আমরা হেলিকপ্টারে করে গিয়েছি এবং নিচে অনেক গ্রাম দেখেছি যেগুলো পুড়ে গেছে। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম গ্রামগুলো কীভাবে পুড়ে গেছে এবং তাদের সবার কাছে উত্তর তৈরি ছিল এবং সেটি হচ্ছে ‘অ্যাক্সিডেন্টাল ফায়ার’। পরে তারা আমাদেরকে বলেছে— রোহিঙ্গারা নিজেরাই তাদের গ্রামে আগুন দিয়েছে।”

তিনি বলেন, বাংলাদেশ এই সমস্যা সমাধানের জন্য সামনের দিনগুলোতে মিয়ানমার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে কাজ করবে।