মুহাম্মদ তৈয়ব উল্লাহ


সকল প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্য যিনি মানব জাতিকে সর্বোত্তম আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে দিয়েছেন সম্মান ও মর্যাদা। মানুষকে তার আসল মর্যাদায় টিকিয়ে রাখার জন্য দিয়েছেন বিভিন্ন বিধি-বিধান। কুরবানির বিধান এর মধ্যে অন্যতম। যার মাধ্যমে মানুষকে একদিকে যেমন ত্যাগ স্বীকারের দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে আল্লাহর অনুগত্যের অধীনে থাকার সুযোগ পায়। অন্যদিকে তার মাঝে লুকিয়ে থাকা পশুত্বকে বিসর্জন দিয়ে মানুষ্যত্ববোধের জাগরণের সুযোগ পেয়ে থাকে। ব্যাহত কুরবানি হচ্ছে তার নির্দিষ্ট দিন সমূহে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পশু জবেহ করা। কুবানির রয়েছে শরীয় মর্যাদা ও গুরুত্ব। আবার কুরবানি আমাদের জীবন প্রবাহে এনে দেয় বিভিন্ন দিকেির্দশনা ও শিক্ষা যা জীবনকে আল্লাহর অনুগত্যের অধীনে থেকে নতুন ভাবে ঢেলে গঠন করতে সাহায্য করে। নিম্নে এ সম্পর্কে বক্তব্য উপস্থাপিত হল :
* কুরবানী কি?
কুরবানী শব্দটি আরবী কারনুন মুল ধাতু হতে এসেছে। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে নিকটবর্তী হওয়ার মাধ্যমে। যেমন বলা হয় সৎকর্ম দ্বারা আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া। কুরবানির অর্থ সৎকাজ, নৈকট্য, সন্নিকটে, ঘনিষ্ঠ হওয়া, উৎসর্গ ইত্যাদি। শরিয়তের দৃষ্টিতে ১০ জিলহজ্ব ফজর থেকে ১৩ জিলহজ্ব সন্ধা পর্যন্ত নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পশু জবেহ করাকে কুরবানি বলে। এই দিনে ঈদ পালন করা হয়ে থাকে। এই জন্য একে কুরবানির ঈদ বলে। এ দিনে অন্য নাম ঈদুল আযহা। আরবী শব্দ আযহা অর্থ কুরবানির পশু। যেহেতু এদিনে কুবানির পশু জবেহ করা হয়। তাই একে ঈদুল আযহা বলা হয়। কুরআনে এসেছে তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও পশু কোরবানি কর। (সুরা আল কাউসার-০২)
* পারিভাষিক অর্থে কুরবানী :
ইমাম রাগিব বলেন ‘‘ যে বস্তু দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় । চাই তা জবেহকৃত বা অন্য কোন দান খায়রাত হোক’’। তাফসিরে মাযারির বর্ণনা মতে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নজর মানত রূপে যা পেশ করা হয় তাকেই কুরবানি বলে। ঈমাম আবু বকর জাসসাস বলেন, আল্লাহর রহমতের নিকটবর্তী হওয়ার জন্য কৃত প্রত্যেক নেক আমলকে কুরবানি বলে।
* হযরত আদম (আ:) থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত প্রতিটি ধর্মে সকল যুগে কুরবানির প্রথা চালু রয়েছে। যদিও একেক ধর্মের নিয়ম পদ্ধতি একেক ধরনের। ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে যেহেতু প্রত্যেক নবীর যুগে কুবানির বিধান পদ্ধতি একেক ধরনের। ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে যেহেতু প্রত্যেক নবীর যুগে কুরবানির বিধান ছিল সেহেতু এর গুরুত্ব অত্যাধিক। যেমন পবিত্র কুরআনে সুরা হজ্জের ৩৪ নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, আর আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানির নিয়ম চালু করে দিয়েছি। তিনি তাদেরকে জীবনোপকরণ স্বরূপ যে সকল চতুষ্পদ জীব দিয়েছেন সেগুলোর ওপর তারা যে আল্লাহর নাম স্মরণ করে। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লাহকে আলমী (রা:) বলেন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরবানির প্রথা সকল আসমানি ধর্মে লিপিবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। মানুষের ইতিহাসে সর্বপ্রথম কুরবানির প্রচলন করা হয় হযরত আদম (আ:) এর পুত্র হাবিল ও কাবিলের হাতে। কুরআনে সুরা মায়েদায় বলা হয়েছে এবং হযরত আদম পুত্রদ্বয়ের সত্য ঘটনা লোকেদের শোনাও এবং অপরজনের (কাবিল) অগ্রাহ্য হয়। তখন কাবিল হাবিলকে বলে, আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব। হাবিল বলে আল্লাহ পরহেজগারিদের কুরবানিই কবুল করেন। (আয়াত ২৭) তাফসিরে হাক্কানিতে বলা হয়েছে-‘‘হযরত মুসা, ইয়াকুব, ইসহাক ও ইব্রাহিম (আ:) এর শরিয়তসমুহে কুরবানি করা ধর্মে ও আইনরূপে স্বীকৃত ছিল। বহুতর বিকৃত বর্তমান বাইবলেও কুরকানীর উল্লেখ রয়েছে অনেক স্থানে। এমনকি হিন্দু দর্মেও কুরবানির প্রচলন দেখা যায়। হযরত নূহ (আ:) এর যুগে প্রচলিত কুরবানি প্রথার উল্লেখ করে মিশরের প্রখ্যাত আলেম মুহাম্মদ ফরিদ ওয়াজেদি ‘‘দায়েরাতুল মায়ারিফ’’ গ্রন্থে প্রমান সহকারে বলেন ‘‘হযরত নূহ (আ:) জন্তু জবেহ করার উদ্দেশ্যে একটি কুরবান গান নির্মাণ করেছিলেন এবং এতে জবেহকৃত জন্তু আগুন দ্বারা জালিয়ে দিতেন। এরপর ইতিহাসে নজির বিহীন কুরবানি পেশ করেন হযরত ইব্রাহিম (আ:) আল্লাহ তার প্রিয় বান্দা হযরত ইব্রাহিম (আ:) কে বিভিন্ন পরীক্ষায় অবতীর্ণ করেছেন এবং ইব্রাহিম (আ:) সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। আল্লাহ বলেন আর স্মরণ কর যখন ইব্রাহিম কে তার রব কয়েকটি বনী দিয়ে পরীক্ষা করলেন। অত:পর সে তা পূর্ণ করলেন তিনি বললেন আমি তোমাকে মানব জাতির নেতা বানাবো, (বাকারা ১২৪)। নিজ পুত্র জবেহ করার মত কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন ইব্রাহিম (আ:) এ বিষয়ে সুরা আসসাফাতের ১০০ থেকে ১০৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে তিনি বললেন হে প্রভু আমাকে নেক সনতান দান করুন। অত:পর আমি তাকে সুসংবাদ দিলাম অত্যন্ত ধৈর্যশীল সন্তানের যার নাম (ইসমাঈল)। পরে যখন সে সন্তান তার সাথে দৌড়াদৌড়ি করে বেড়ানোর বয়সে পৌছল তখন তিনি ইব্রাহিমকে (আ:) বললেন হে বৎস আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি আল্লাহর হুকুমে তোমাকে জবেহ করছি। তুমি চিন্তা করে দেখ। তোমার অভিমত কি? ইসমাঈল বললেন, হে পিতা আপনি তাই করুন যা করতে আপনি আদিষ্ট হয়েছেন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন। অত:পর যখন দুজনই আল্লাহর আদেশ মানতে রাজি হলেন তখন তিনি (ইব্রাহিম (আ:) পুত্রকে জবেহ করার জন্য শুইয়ে দিলেন। আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইব্রাহিম তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছে। আমি এভাবেই নেক বান্দাদেরকে পুরষ্কৃত করে থাকি। নিশ্চয় এটি একটি বাড় পরীক্ষা। আর আমি তাকে বিনিময় করে দিলাম এক বড় কুরবানির দ্বারা এবং যা পরবর্তীদের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলাম। শান্তি বর্ষিত হোক ইব্রাহিম (আ:) এর প্রতি।
* কুরবানীর গুরুত্ব ঃ
কুরবানি আল্লাহর একটি বিধান। আল্লাহ তায়াল ইরশাদ করেন তোমার প্রতি পলকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং কুরবানি কর। (সুরা আল কাউসার-২) তাফসীরে হুকুল মাআনির ভাষ্যমতে কতিপয় ইমাম ঐ আয়াত দ্বারা কুরবানির ওয়াজিব হওয়াকে প্রমান করেছেন। আল্লাহর নির্দেশ পালন মূলত ওয়াজিব তথা ফরজ। তাই সামর্থ্যবান সকল মুসলমানদের ওপর কুরবানি করা আবশ্যক। হাদিসে হযরত যায়েদ ইবনে আরকান (রা:) হতে বর্ণিত হয়েছে সাহাবাদের কেউ কেউ রাসুল (স:) কে জিজ্ঞাসা করলাম হে রাসুল (স:) পশমের ব্যাপারে কি হবে? তিনি বললেন প্রতি পশমের বদলে একটি করে নেকি পাওয়া যাবে। (ইবনে মাজাহ, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমদ, হাকিম) রাসুল (স:) বলেছেন যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করেনা সে যেন আমার ঈদগাহে না আসে’’ (ইবনে মাজাহ ৩১২৩, হাদিসটি হাসান)
কুরবানীর শিক্ষা ঃ
কুরবানি একটি ইবাদত। আবার কুরবানির এ বিধান আমাদের জন্য অনেক কিছু শিক্ষা দিয়ে থাকে। যেমন :-
আনুগত্যের চরম পরাকাষ্ঠ :
আল্লাহতায়ালা বান্দাকে যে কোন আদেশ দেয়ার ইখতিয়ার রাখেন এবং বান্দা তা পালন করতে বাধ্য। আল্লাহর আদেশ সহজ ও আর কঠিন হোক তা পালন করার বিষয়ে এমন মানসিকতা থাকতে হবে এবং আল্লাহর হুকুম মানার বিষয়ে মায়া-মমতা প্রতিবন্ধক হতে পারে না। পবিত্র কুরআনে আমাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছি যে, আল্লাহ তায়ালা ইব্রাহিম (আ:) কে আনুগত্যের চরম পরীক্ষায় অবতীর্ণ করেছিলেন। আর ইব্রাহীম (আ:) এর আনুগত্য ছিল শর্তহীন। কুরআনে এসেছে যখন তার প্রভূ তাকে বললেন আতœসমর্পন কর, তিনি বললেন আমি বিশ্বপ্রতি পালকের জন্য আতœসমর্পন করলাম। (সুরা বাকারা- ১৩২) হযরত ইব্রাহিম (আ:) বলতে পারতেন, হে আল্লাহ তোমার জন্য আগুনে গিয়েছি, ঘর বাড়ি ছেড়েছি, আতœীয় স্বজন সব কিছু হারিয়েছি। এসব কিছুর বিনিময়ে আমার ¯েœহের সন্তানকে কুরবানি করা থেকে রেহাই দাও। কিন্তু তিনি তা করেন নি। বরং আল্লাহ যা হুকুম করেছেন তা শর্তহীনভাবে মেনে নিয়েছেন এবং তিনি আল্লাহর আনুগ্য পালনের ব্রাপারে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন। আর আল্লাহ যেভাবে বিশ্বমানবমন্ডলীকে বিভিন্ন জাতিতে বিভক্ত করছেন ঠিক সেভাবে সর্বশেষ মুসলিম জাতির পিতা হিসেবে ইব্রাহিম (আ:) কে মনোনয়ন দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, এটা তোমাদের পিতা ইব্রাহিমের মিল্লাত, তিনি পূর্বে তোমাদের নামকরণ করেছেন মুসলিম’’। (সুরা হজ্জ-৭৮)।
* তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জন :
তাকওয়া ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায় না। একজন মুসলিমের অন্যতম চাওয়া হলো আল্লাহর নৈকট্য অর্জন। পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে কুবানি দাতা আল্লাহর নৈকট্য অর্জ করে। কোরআনে এসেছে আল্লাহর নিকট পৌছায় না তাদের গোশত, রক্ত বরং পৌছায় তোমাদের তাকওয়া’’।
* ত্যাগ স্বীকার করা :
কুরবানির অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে ত্যাগ স্বীকার করার মানসিকতা তৈরী করা। আল্লাহর বিধি বিধান পালনে জান-মালের ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। কুরআনে এসেছে আর আমি তোমাদেরকে অবশ্যই ভয়, দারিদ্র, সম্পদ ও জীবনের ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে পরীক্ষা করবো। আপনি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দিন। (সুরা বাকারা ১৫৫)। কুরবানি ইসলামী শরীয়তের অন্যতম বিধান। ইব্রাহিম (আ:) ত্যাগের সর্বোচ্চ নজির পেশ করে কিয়ামত পর্যন্ত স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। একই সাথে আমাদের উচিত জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ ও রাসুল (স:) এর হুকুমের সামনে নিজেদের মত, জীবন, সম্পদের কুরবানি করে নিজদেরকে আল্লাহর রঙে রঙিন করে তোলা এবং আনুগত্যের সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত পেশ করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘‘আমরা আল্লাহর রঙ গ্রহণ করেছি আল্লাহর রঙের চেয়ে আর কার রঙ উত্তম হতে পরবে না। (সুরা বাকারা-১৩৯) আল্লাহ আমাদের সকলকে বুঝার তৌফিক দিন। আমিন। ছুম্মা আমিন