অনলাইন ডেস্ক: ‘আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির (লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক)’ ধ্বনিতে গতকাল সোমবার দিনভর মুখরিত হলো সৌদি আরবের ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দান। পবিত্র হজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই দিনে নিবিড় ইবাদত-বন্দেগি, হজের খুতবা শোনা এবং মহান আল্লাহর দরবারে আত্মশুদ্ধি ও পাপমুক্তি এবং মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনার মধ্য দিয়ে হাজিরা শেষ করলেন হজের মূল কাজ। আবহাওয়া পূর্বাভাস অনুযাযী, শেষ পর্যন্ত ধূলিঝড় না হলেও প্রচণ্ড গরম ও উচ্চ আর্দ্রতার মধ্যেই আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করেন হাজিরা। সৌদি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এবার বিশ্বের ১৭০টি দেশের ২০ লাখের বেশি মুসলমান পবিত্র হজ পালন করেছেন। তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশি এক লাখ ২৭ হাজার।

আজ মঙ্গলবার হাজিরা মিনায় শয়তানের ওপর পাথর নিক্ষেপ, কোরবানি ও পবিত্র কাবায় সমাপনী তাওয়াফ করে হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করবেন। মুসলমানরা বিশ্বাস করে, হজের দিন আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের পর হাজিদের জীবনের অতীতের সব গুনাহ মাফ হয়ে যায়। হজের আগের দিন গত রবিবার সন্ধ্যায় প্রচণ্ড ধূলিঝড় বয়ে যায় মিনা, আরাফাত ও মক্কাসহ আশপাশের এলাকায়। ধূলিঝড় ও বৃষ্টির সময় হাজিরা অবস্থান করছিলেন মিনায়। একপর্যায়ে বৃষ্টি এসে যেন হাজিদের স্বাগত জানায়। এ সময় আল্লাহর রহমত মনে করে অনেকে বৃষ্টির পানি পান করে। সৌদি আবহাওয়া বিভাগের বরাত দিয়ে সৌদি গেজেট জানায়, হজের দিনও আরাফাতে ভারি বৃষ্টিপাত, ধূলিঝড় বয়ে যেতে পারে। আর বৃষ্টি না হলে প্রচণ্ড গরম ও উচ্চ আর্দ্রতাও থাকবে। গতকাল সন্ধ্যায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ধূলিঝড় ও বৃষ্টি হয়নি বটে। তবে প্রচণ্ড গরম সহ্য করেই আল্লাহর দরবারে হাজিরা দেন হাজিরা।

মহান আল্লাহর কাছে হাজিরা দিতে গতকাল সূর্যোদয়ের পর লাখ লাখ হাজি মিনা থেকে রওনা দেন আরাফাতের ময়দানের দিকে। কারণ এই আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করাকেই হজের মূল কাজ বলা হয়। কেউ বাসে, কেউ ট্রেনে, কেউ হেঁটেই উপস্থিত হন আরাফাতের ময়দানে। সেখানে লাখো কণ্ঠে একটিই রব, ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়াননি’মাতা লাকা ওয়ালমুলক, লা শারিকা লাক।’ এর অর্থ হলো, ‘আমি হাজির। হে আল্লাহ আমি হাজির। আমি হাজির, তোমার কোনো শরিক নেই, আমি হাজির। নিশ্চয়ই সব প্রশংসা ও নিয়ামত শুধু তোমারই, সব সাম্রাজ্যও তোমার। তোমার কোনো শরিক নেই।)

মক্কা থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে আরাফাতের ময়দান। সেখানে গতকাল সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করেন হাজিরা।

সৌদি গণমাধ্যমগুলো জানায়, হাজিরা শনিবার বিকেল থেকেই জড়ো হতে শুরু করেন ১০ কিলোমিটার দূরে তাঁবুনগরী মিনায়। পুরুষরা সেলাইবিহীন ও নারীরা ঢিলা সাদা পোশাক পরে বিভিন্ন বর্ণ, ভাষা, জাতীয়তার লাখো মুসলমান কেউ বাসে, কেউ গাড়িতে, কেউ বা হেঁটে মিনার পথে রওনা হন। তাঁদের সবার মুখে ছিল একই ধ্বনি, ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক…।’

সৌদি পত্রিকা আরব নিউজ অনলাইন লিখেছে, বিশ্বের নানা প্রান্তের বাসিন্দারা হজে এসে যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন, তা তাঁদের জীবনের অনন্যসাধারণ এক ঘটনা। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার আলেপ্পো থেকে পাঁচ বছর আগে পালিয়ে তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছিলেন ৫০ বছর বয়সী অ্যাকাউন্টেন্ট হিশমা মোস্তফা। এবার তিনি সৌদি আরবে এসেছেন হজ করতে। তিনি বলেন, ‘এই প্রথম নিজের চোখে কাবা দেখার সুযোগ হলো আমার। এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা।’

আল্লাহর কৃপা পেতে আরাফাতের ময়দানে : আগের দিন রবিবার সারা দিন এবং রাত হাজিরা ইবাদত-বন্দেগির মধ্য দিয়ে মিনায় অবস্থান করেন। আল্লাহার নৈকট্য লাভের আশায় তাঁরা জিকির করেন, নামাজসহ অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগি করেন। এরপর হজের মূল আনুষ্ঠানিকতার জন্য গতকাল সূর্যোদয়ের পর তাঁরা সকালে ছয় কিলোমিটার দূরে ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে যান, যে ময়দান ইসলামের শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর বিদায় হজের স্মৃতি বিজড়িত।

আরাফাত পর্বতের কাছে চার বর্গমাইল আয়তনের সমতল ভূমি আরাফাতের ময়দান। মুসলমানদের কাছে পবিত্র এই ভূমিতে হজের দিন হাজিরা সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নিয়ে ইবাদত শুরু করেন। কেউ কেউ অবস্থান নেন এক পাশের পাহাড় ‘জাবালে রহমতে’। এই পাহাড়ের পাশে দাঁড়িয়েই হজরত মুহাম্মদ (সা.) ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। হাজিরা আরাফাতের ময়দানে বা পাহাড়ে অবস্থান নিয়ে সমস্বরে বলতে থাকেন সেই শ্রুতিমধুর বাণী—‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। এরপর হাজিরা হজের খুতবা শোনেন এবং জোহর ও আসরের নামাজ পড়েন। এ বছর হজের খুতবা দেন মসজিদে নববির ইমাম শেখ হুসেইন বিন আব্দুল আজিজ। এ খুতবা গণমাধ্যমে সারা বিশ্বে সম্প্রচারিত হয়।

মুসলমানদের বিশ্বাস অনুযায়ী, আদি পিতা হজরত আদম (আ.) ও আদি মাতা হজরত হাওয়া (আ.)-এর পৃথিবীতে পুনর্মিলনের পর এই আরাফাতের ময়দানে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। ১৪০০ বছরের বেশি সময় আগে এখানেই ইসলামের শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) দিয়েছিলেন তাঁর বিদায় হজের ভাষণ।

এই আরাফাতে উপস্থিত না হলে হজের ফরজ আদায় হয় না। ইসলাম ধর্মের রীতি অনুযায়ী জিলহজ মাসের নবম দিনটি আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করে ইবাদতে কাটানোই হলো হজ।

আরাফাত থেকে মিনায় ফেরার পথে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় মুজদালিফায় মাগরিব ও এশার নামাজ পড়েন সমবেত মুসলমানরা। মুজদালিফায় রাতে থাকার সময় তাঁরা পাথর সংগ্রহ করবেন, যা মিনার জামারায় শয়তানকে উদ্দেশ্য করে ছোড়া হবে। আজ মঙ্গলবার সকালে মিনায় ফিরে সেই পাথর তাঁরা প্রতীকী শয়তানকে লক্ষ্য করে ছুড়বেন। এরপর কোরবানি দিয়ে ইহরাম ত্যাগ করবেন এবং সব শেষে কাবা শরিফকে বিদায়ী তাওয়াফের মধ্য দিয়ে শেষ হবে হজের আনুষ্ঠানিকতা। হজ উপলক্ষে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করে সৌদি সরকার। সূত্র : আরব নিউজ, সৌদি গেজেট ও এএফপি।

৫২ বাংলাদেশি হাজির মৃত্যু : ঢাকায় নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, চলতি বছরের হজে গতকাল পর্যন্ত সৌদি আরবে ৫২ জন বাংলাদেশি হাজি বার্ধক্য এবং অসুস্থতার কারণে ইন্তেকাল করেছেন। মক্কায় বাংলাদেশ হজ অফিস থেকে প্রকাশিত হজ বুলেটিনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীন মক্কা থেকে প্রকাশিত হজ বুলেটিন সূত্রে জানা যায়, নিহতদের মধ্যে ৪৩ জন পুরুষ এবং ৯ জন নারী। বাংলাদেশি হাজিদের সম্পর্কে .িযধলল.মড়া.নফ এই সাইটে জানা যাবে বলে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। – কালেরকন্ঠ