রহিম আব্দুর রহিম

ভারতের অসমের ‘নাগরিকপুঞ্জি’ বিষয়টি ‘টক অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড’। হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টানসহ বহুজাতের শান্তির আবাসভূমি অসমে জাত-পাতের মত সম্প্রদায়িকতা নাই বল্লেই চলে। তবে এনআরসি নিয়ে আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক রাজনীতি-অপরাজনীতিতে সরগরম ভারত। আতঙ্ক, হতাশা, ভয়ভীতি কাজ করছে ভূক্তভোগী মহলে। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভক্ত হওয়ার পর থেকে ভারতবর্ষের এক প্রান্তের জনমানুষ জীবক জীবিকার তাগিদে অন্য প্রান্তে বসতি স্থাপন করেছে বলে মনে হচ্ছে, এছাড়া ভারত বর্ষের ২৯টি রাজ্যের মানুষরা যে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যায়নি এমন কোন সত্যতা রয়েছে? ৩৩টি জেলা নিয়ে গঠিত অসম রাজ্যের প্রতিবেশী অন্যান্য রাজ্যগুলো হচ্ছে, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মনিপুর, অরুণাচল, কাচার, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গ। প্রতিবেশী দেশের মধ্যে উত্তর-পূর্বঅঞ্চলীয় অসমের উত্তরে ভুটান-নেপাল, পূর্ব-দক্ষিণে মিয়ানমার এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে – বাংলাদেশ। অসমের জনমানুষরা নিজেদের নৃ-ত্ত্বাত্মিক পরিচয় বেঁচে থাকার তাগিদ সামনে রেখে ১৯৭৯ সালে (বহিরাগত অভিবাসী খেদাও আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়, ওই সময়ে গঠিত ‘অল অসম স্টুডেন্ট ইউনিয়ন’ নামের একটি সংগঠন। আন্দোলন চলে দীর্ঘ ৬ বছর (১৯৭৯-১৯৮৫ পর্যন্ত)। এই আন্দোলনে পুলিশ মিলিটারির গুলিতে সর্বমোট ৮শত ৫৫ জন ছাত্র-জনতা নিহত হয়। ১৯৮৫ সালে ১৫ আগস্টের মধ্যরাতে তৎকালীন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে ‘অভিবাসী খেদাও’ আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সাথে একটি চুক্তি হয়। চুক্তিতে উল্লেখ থাকে যে, ১৯৭১’র ২৪ মার্চ মধ্যরাত পর্যন্ত অসমে যারা প্রবেশ করেছে বা বসবাস করছে, তারাই অসমের নাগরিকত্ব পাবে। চুক্তির পরের বছরই ‘অভিবাসী খেদাও’ অল অসম স্টুডেন্ট ইউনিয়নের অন্যতম নেতা প্রফুল্ল কুমার মহন্ত, (এজিপি) আসাম গণপরিষদ নামে দল গঠন করেন এবং ওই দল থেকে তিনি রাজ্য সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জয়ী হন। প্রফুল্ল কুমার মহন্ত, রাজ্য সরকারে প্রবেশ করার পর তিনি উপলব্ধি করতে সক্ষম হন যে, অভিবাসী খেদাও আন্দোলন বিষয়ের সাথে বাস্তবতা মিলানোর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও মানবিক আবেদনের বিষয়টি পারস্পারিক। অর্থাৎ ‘কাজির গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই ’ অবস্থা। ফলে আর অভিবাসী খেদাও আন্দোলন চাঙ্গা হয়নি। আন্দোলনের বাস্তবতার সাথে পরিবেশ পরিস্থিতি মিলাতে গিয়ে দেখা গেছে, অসমে যারা বর্তমানে বসবাস করছে তারা ভারতের কোন না কোন রাজ্যেরই জনমানুষ। অভাব-অনটন, নদীর ভাঙ্গন পাহাড় ধস, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তারা হয়তো বা অসম অঞ্চলটিকে সেল্টার হিসেবে কোন না কোন সময় ব্যবহার করতেই পারে। তৎকালীন সময় আন্দোলনকারীরা হয়তো আঁচ করেছিল যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানিদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ থেকে বাঁচতে বাংলাদেশের অসংখ্য জনমানুষ ভারতের অসম রাজ্যে প্রবেশ করেছে। তাদের এ ধারনা হতেই পারে, তবে ইতিহাস এবং বাস্তবতা নিরিখে তাদের ধারণার সাথে বাস্তবতার কোন মিল নেই।

অসমে সরেজমিনে কথা হয়, স্কুটার চালক ১৮ বছর বয়সক কামালের সাথে। সে জানাল তার এনআরসি হয়েছে। এখানে হিন্দু মুসলিম ভেদাভেদ নেই। ওরা ভালো আছে। তার মতে, অসমের কিছু মানুষ নাকি মনে করে, মুসলমান হলেই নাকি তারা বাংলাদেশি বাঙ্গালী। অসমের আনাচে কানাচে শত বছর ধরে বসবাস করছে নেপালী, রাজস্তানী, মারাঠি, পাঞ্জাবী ও গুজরাট অঞ্চলের হিন্দু মুসলিমরা। অসম মানেই বহুজাতের জনমানুষের আবাসন ভূমি। বহুজাতিক মানবের এই চারণ ভূমিতে এক সময় যারা সোনা ফলিয়ে অসম রাজ্যকে পরিপুষ্ট করে তুলেছে তাদের নিয়েই শুরু হয়েছে এনআরসি বিতর্ক। অসমের রাজধানী ডিসপুরের ব্রহ্মপুত্র লজের সামনে কথা হয়েছে বরপেটার স্থায়ী বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেনের সাথে। এনআরসি তালিকায় তার এবং তার বাবা-মার নাম আসে নি, তবে তার ছোট বোন ও চাচা চাচিদের নাম এসেছে। তার কথাই বোঝা গেল খড়সা প্রণয়ন কালে মাঠকর্মীদের ভুলত্রুটি হয়েছে। বিষয়টি আতঙ্কের কিছুই নয়। ১৮বছর বয়স্ক আমিনুল ইসলাম সে লেখাপড়া করে ইডেন ভেলি কলেজে। তার পরিবারের সবার নামই তালিকায় এসেছে। তারা কথায় বুঝা গেল, এনআরসি বিষয়টি আতঙ্কের নয়, তার পরও আতঙ্ক ছড়ছে। ঝালোকবারির প্রান্তিক ব্যবসায়ী ময়নুল হক জানালেন, এনআরসি নিয়ে ভয়ের কিছুই নেই, আমরা তালিকা ভুক্ত হয়েছি, সবারই হবে, ভুল ভ্রান্তির কারণেই অনেকে হয়তো বা তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। অসমের যারা জন্মগ্রহণ করেছে তারা যাবে কোথায়? কামাক্ষা শহরের মালিগাঁও কথা হয়েছে, হাজু থানার টাঙ্গনমারির গ্রামের টাইটেলপাস মাওলানা, সাইফুল আলীর সাথে। তিনি একটি সিনিয়র ইসলামীয়া মাদরাসার শিক্ষক, এনআরসি তালিকা থেকে তাদের পুরো পরিবারের নাম বাদ পড়েছে। তাদের আত্মীয়-স্বজনদের ১৯৬৬ সালের অসমের ভোটার তালিকায় নাম অর্ন্তভুক্ত রয়েছে। এর পরেও তাদের তালিকায় নাম না থাকায়, তার ধারণা বংশলিঙ্গ তথ্য দিতে পারে নাই বলেই হয়তো এমনটা হয়েছে। বহু পুরোনো দিনের এসমস্ত কাগজ পত্র তাদের কাছেও নেই। তবে হবেটা কী ? উত্তর, ‘অসমের অধিবাসী অসমেই থাকব।’ অসমের মৌরাবারি জামিয়া ইসলাম দারুল উলুম মাদরাসার হাফিজুর রহমানসহ ২০ জন ছাত্রের সাথে কথা হয়েছে। তারা সবাই একসঙ্গে একবাক্যে বলেছে, তাদের সকল পরিবারের সকল সদস্যের নাম এনআরসিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাদের মাদরাসাটি এলাকার হিন্দু মুসলমানের অর্থে পরিচালিত হচ্ছে। অসমে হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে যে, মানবতার বন্ধন যে দৃঢ় এটা বোঝা গেল তাদের কথা বার্তায় ।

অসমের বামপন্থি নেতা, বিশিষ্ট সমাজসেবী, রোঙ্গীয়া সাবডিভিশনের পশ্চিম বুড়িগোগ মৌজার পঞ্চায়েত চেয়ারম্যান আবুল হোসেন (৬৫) এনআরসি সম্পর্কে বলেন, ‘অল অসম স্টুডেন্ট ইউনিয়নের নেতা কর্মীরা চেয়েছিল, অবৈধ অভিবাসীদের অসম থেকে তাড়াতে হবে। কিন্তু ওই আন্দোলনের নেতা প্রফুল্ল কুমার মহন্ত এজিপি করে ক্ষমতায় গেলেন, অথচ দাবি পূরণ হলো না, বৃট্রিশ কর্তৃক সৃষ্ট পুরোনো জটিলতা এত সহজে সমাধান সম্ভব নয়। ৩৩ বছরের পূর্বের একটি দাবি এনআরসি পদ্ধতি, এটি বাস্তবায়িত হলে রাজ্যের শৃঙ্গলাবোধ ফিরে আসবে, তবে তা যেন, কোন ভাবেই রাষ্ট্রের দৃষ্টি ভিন্ন খাতের প্রবাহের অপকৌশল না হয়।’ অসমের শিক্ষা-সংস্কৃতি, আচার-আচরণ ও বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয়েছে, অল ইন্ডিয়া কালচারাল সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক, মীরাবাঈ রাষ্ট্রিয় পদকে ভূষিত বিশিষ্ট্য শিল্পী, পকিলা কলিতার সাথে, তাঁর সাথে দীর্ঘ আলোচনায় উঠে এসেছে, অসমের মানুষরা অসম্প্রদায়িক চেতনায় গড়ে উঠেছে। এখানে হিন্দু -মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান এর মধ্যে কোন জাতিগত ভেদা-ভেদ নেই। যা প্রমাণ করতে তিনি আমাকে নিয়ে গিয়েছেন, অসমের নানা প্রান্তের নানা জনের কাছে। এনআরসি নিয়ে কথা বলেছি, অসমের সাংস্কৃতিক সংগঠন তক্ষশীলা কালচারাল সংগঠনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. অরনিমা বড়–য়ার সাথে। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এনআরসি বিষয়টিকে কেন্দ্র করে অসমে কোন মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে কি না? তিনি উত্তরে বলেছেন,‘মানবতার সম্মিহনে গঠিত অসম, এই রাজ্যেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন সুরের দেবতা, মানবতার মহাপুরুষ, সংগীত শিল্পী ভুপেন হাজারীকা। অসমের আকাশে বাতাসে দিবানিশি ঝংকৃত হয়, মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য। সেখানে মানবতার বিপর্যয় হাস্যকর।’

১৩০কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতের ২৯টি প্রদেশের মধ্যে পশ্চাৎপদ রাজ্য অসমের মোট ৩৩টি জেলার (এনআরসি) ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন এর জন্য আবেদন করেছিলেন ৩ কোটি ২৯ লাখ জনমানুষ। এর মধ্যে তালিকা ভুক্ত হয়েছেন, ২ কোটি ৮৯ লাখ। তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন ৪০ লাখ। বাদ পড়াদের আবেদনের সময়সীমা বৃদ্ধি করেছেন কেন্দ্রীয় সরকার। ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক দল বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ বলেছেন, বাদপড়া ৪০লাখ জনমানুষের মধ্যে ১৩ লাখ হিন্দু, বাকিরা মুসলিম। কেউ বলেনি বাদ পড়াদের কি হবে? বলার প্রয়োজন অনুভব না করে সবাই যার যার অবস্থান থেকে রাজনীতি -অপরাজনীতির চরম খেলায় মেতে উঠেছে। রাজনীতি যদি মানুষ ও মানবতার জন্য হয় তবে বিষয়টি এরকম হচ্ছে কেনো! সরেজমিনে পরিদর্শন করে স্পষ্টত্বই বলা যায়, এনআরসি থেকে কেউ বাদ পড়বে না, পড়ার কথাও না। কোন কোন ভাবে তাদের নাম অবশ্যই তালিকা ভুক্ত হবে। অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত খেঁটে খাওয়া জনমানুষরা এনআরসি নিয়ে প্রথম দিকে কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। এখন বিষয়টি সবাই গুরুত্ব সহকারে আমলে নিয়েছে। সময়ের ব্যবধানে যারা নথিপত্র হারিয়ে ফেলেছে, তারাও বুঝতে ও বলতে শিখেছে। আমরা ভোটার হওয়ার সময় নাগরিক থাকি, এনআরসির সময় বাদ পড়বো! গত ১২ আগস্ট ভারতের একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, অসমের বরপেটা জেলার সরুক্ষেত্রী বিধান সভার অর্ন্তগত পাকা বেতবরিয়া আজাহার আলীর স্ত্রী সাজেদা বেগম (৫৫) হার্ট এ্যাটাক করে মারা গেছেন। তিনি ১১ আগস্ট ১৭ নম্বর এনআরসি কেন্দ্রে গিয়ে দেখতে পান তার নামটি এনআরসি তালিকায় নেই, তিনি বাড়ি এসেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। সরকার সংশ্লিষ্টরা বারবার আশ্বাস দিচ্ছে যে, বৈধ নথিপত্র ধারীরা কোন ভাবেই এনআরসি থেকে বাদ পড়বে না। সরকারের আশ্বাসের বাস্তবতা মিলেছে অসমের পশ্চিম সীমান্ত ঘেষা ভবানীপুরের হাবিবার কথায়। সে দিল্লির লখনৌতে শ্রমিকের কাজ করেন, প্রায় ১৪শ কিলোমিটার দূর থেকে এসেছে এনআরসি সংগ্রহ করতে। তার এনআরসি হয়েছে, সে ১৭ আগস্ট আবার কাজে ফিরেছে। অসমের একটি নাট্যদল অল অসম স্টুডেন্ট আন্দোলনের ঐতিহাসিক ঘটনা এবং এনআরসি থেকে বাদ পড়াদের মানবিক আবেদন নিয়ে লেখা পথনাটক ‘বু’ অর্থ্যাৎ ‘অহেতুক ঘেউ ঘেউ’ প্রদর্শন করছে।

অসম ঘুরে যা দেখলাম তা একটি রাজ্যের নিয়মশ্ঙ্খৃলা রক্ষার রুটিন ওয়ার্ক মাত্র। কিন্তু হাওয়ায় উড়ছে, পুঁথি সাহিত্যের সেই, ‘লাখো লাখো মরে সৈন্য, হাজারে হাজার ; হিসাব করিয়া দেখি আছে জনা চার।’

 

রহিম আব্দুর রহিম-  লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক, শিশু সংগঠক, নাট্যকার ও কলামিস্ট, মোবাইল- +৮৮০১৭১৪২৫৪০৬৬

ই-মেইল-rahimabdurrahim@hotmail.com