আনোয়ার জাহেদ 


কক্সবাজার সিটি কলেজ ‘ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি’ বিভাগের উদ্যোগে সিলেবাসের পাঠ্যভুক্ত (Assignment) এর অংশ হিসেবে কক্সবাজারের প্রাচীনতম দুই মুসলিম স্থাপত্য (সাচী চৌধুরী জামে মসজিদ ও বদর মোকাম জামে মসজিদ) পরিদর্শন করতে যায় বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকরা।ইসলাম সার্বজনীন ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি লাভের সাথে সাথে ইসলামী স্থাপত্য ও শিল্পকলার উম্মেষ ও বিকাশ ঘটে।ইসলামের ধর্মীয় ও সামাজিক পটপ্রেক্ষিতে মসজিদ শুধুমাত্র একটি প্রার্থণাগার নয় বরং ধর্মীয়,রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রাণকেন্দ্র; শিক্ষায়তনও বটে।মসজিদ ভিত্তিক ইসলামী স্থাপত্যের গোড়া পত্তন হয় রাসুলে কারীম (সা:) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মদীনা মসজিদে।তাই মুসলিম সমাজ ও সভ্যতার সম্প্রসারণে মসজিদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

স্থাপত্য:-Architecture বা স্থাপত্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে Professor W.R.Lethaby তাঁর Architecture গ্রন্থে বলেছেন যে “Architecture is the practical art or building touched which emotion, not only the past but now and in the future”. সুতারাং মুসলমানদের দ্বারা সৃষ্ট এবং স্বকীয় বৈশিষ্ঠ্যে ভরপুর স্থাপত্য রীতিকে মুসলিম স্থাপত্য বলা হয়।

মসজিদ :-মসজিদ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে ‘সাজাদা’ বা ‘সিজদাহ’ থেকে। এর অর্থ যে স্থানে সিজদা দেওয়া হয় বা সিজদার স্থান।নামাজের মধ্যে সিজদা একটি প্রধান অংশ।এ কারণে বিশেষ ব্যবস্থায় আয়োজিত নামাজের স্থানকে মসজিদ বলে।

মসজিদ পরিদর্শন:-২৩জুলাই’২০১৮,সোমবার;সকাল ১১:০০টায় ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ১০জন শিক্ষক ও ৮০জন ছাত্র-ছাত্রী দুই স্থাপত্য পরিদর্শন করার জন্য বিভাগীয় প্রধান জনাব আকতার উদ্দীন চেীধুরীর নেতৃত্বে কলেজ প্রাঙ্গন থেকে রওয়ানা হয়ে ১১.১৫ মিনিটে গন্তব্য স্থলে পৌঁছে।এতে ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনা বিরাজ করে।আমাদের মাঝে উপস্থিত থেকে পরিদর্শনকে আরও বেগবান ও সৌন্দর্যমন্ডিত করে কক্সবাজার ইতিহাস গবেষণা পরিষদের সম্মানিত উপদেষ্ঠা,সাংবাদিক ও গবেষক জনাব মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম। মসজিদ পরিদর্শনের শুরুতে মুসলিম স্থাপত্য ও প্রতœতাত্ত্বিক নির্দশন পরিদর্শনের উপর গুরুত্বরোপ করে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিভাগীয় প্রধান জনাব এস.এম.আকতার উদ্দীন চৌধুরী।বাংলাদেশে মুসলমানদের আগমন,মসজিদ প্রতিষ্ঠা,কক্সবাজার জেলার প্রাচীনতম মসজিদের ইতিহাস,বিশেষ ভাবে সাচী চৌধুরী মসজিদের তথ্যমূলক ও সুবিন্যাস্ত বক্তব্য রাখেন কক্সবাজার ইতিহাস গবেষণা পরিষদের সম্মানিত উপদেষ্ঠা,সাংবাদিক ও গবেষক জনাব নুরুল ইসলাম।মুসলিম শিল্পকলা ও স্থ্যপত্যের শিক্ষক জনাব সাইফুদ্দীন আযাদ ছাত্র-ছাত্রীদের মসজিদের অবকাঠামো সম্পর্কে তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে পর্যবেক্ষণ করান।

সাচী চৌধুরী জামে মসজিদ , চৌধুরী পাড়া, ঝিলংজা , কক্সবাজার

সাচী চৌধুরী জামে মসজিদ:-সাচী চৌধুরী মসজিদটির নির্মাণ শৈলী মোগল আমলের আদলে হলেও মসজিদটি মোগল আমলে নির্মিত হয়নি।গ্রামের আদি পুরুষ জনাব সাচী চৌধুরী ১৮৬১ খিস্টাব্দের দিকে মসজিদটি নির্মাণ করেন।সাচী চৌধুরীর আদি নিবাস চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায়।১৮৫৪ খিস্টাব্দে কক্সবাজার মহকুমায় উন্নীত হওয়ার পরেই জনাব সাচী চেীধুরী কক্সবাজারে আগমন করেন এবং বর্তমানের(পূর্বের ঝিলংজা ইউনিয়ন) চৌধুরী পাড়া গ্রামে বসতি স্থাপন করেন।গ্রামের লোকজনের নামাজ পড়ার প্রয়োজনেই তিনি মসজিদটি নির্মাণ করেন।সাচী মসজিদ ছাড়াও এটি মোঘল আমলের মসজিদ,গায়েবী মসজিদ ও পোটকা মসজিদ নামে ও পরিচিত।আয়তনে ছোট মসজিদটির উত্তর পাশে রয়েছে একটি বিশাল দিঘি।মসজিদটির ভেতরে উত্তর-দক্ষিণ লম্বা ২৩ফুট,পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা ১৪ফুট।মসজিদের বাহিরে উত্তর-দক্ষিণে লম্বা ৩৪ফুট আর পূর্ব-পশ্চিমে ২৬ফুট।মসজিদের সামনে তথা পূর্ব দিকে পাঁচ ফুট বা ছয় ফুটের একটি বারান্দা ছিল।তার সামনে ছিল খোলা সাহান বা উঠান।মসজিদের মূল পিলার বা স্তম্ভ চারটি।প্রতিটি পিলারের ভিত্তি চার ফুট বাই চার ফুট।বর্তমানে নামায পড়ার জন্য চারটি কাতার বা সারি রয়েছে। মসজিদে পৃথক মেহরাব(ইমাম সাহেব দাড়ানোর স্থান) তৈরি করা হয়নি।মসজিদে তিন ধাপ বিশিষ্ট ছোট আকৃতির মিনবার রয়েছে।মসজিদে মিনার(আযান দেওয়ার স্থান) ও মাকসুরা (নিরাপত্তা বেষ্টনী) নেই।মসজিদে রিওয়াক(খিলান বিশিষ্ট সাহনের তিন দিকে আবৃত পথ) নেই।মসজিদের উত্তর দিকে জিয়াদা (মূল ভবনের বাহিরে খোলা চত্বর)দেখতে পাওয়া যায়।মসজিদের একটি মাত্র দরজা।দরজার উচ্চতা পাঁচ ফুট।জানালা রয়েছে দুটি।জানালার উচ্চতা সাড়ে চার ফুট,প্রস্থ তিন ফুট। বর্তমানে মসজিদের ফ্লোরটি পাঁচ থেকে ছয় ফুট ভরাট হয়ে গেছে।মসজিদের ছাদের উপর রয়েছে পাশাপাশি তিনটি গম্বুজ,তিনটি গম্বুজের মধ্যে মাঝের গম্বুজটি বেশ বড়,অবশিষ্ট দুটি ছোট।বড় গম্বুজের উপর লোহার রড় দিয়ে বৈদ্যুতিক বাতি লাগানো হয়েছে।মসজিদের পূর্ব,পশ্চিম ও দক্ষিণে রয়েছে কবরস্থান।মসজিদটি বর্তমানে নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে।মসজিদের ফ্লোরে বসানো হয়েছে টাইলস।ফলে কত নিচে মূল ফ্লোর রয়েছে তা বলা মুশকিল।

বদর মোকাম জামে মসজিদ:-আমাদের পরিদর্শনের দ্বিতীয় মসজিদ ছিল বদর মোকাম জামে মসজিদ।কক্সবাজার শহরের প্রাণকেন্দ্র থানা রোড়ের সোজা উত্তর প্রান্তে কক্সবাজার সদর মডেল থানার মাত্র ২০ গজ উত্তর-পশ্চিমে বাকঁখালী নদীর তীরে কস্তুরা ঘাটে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক মসজিদটি।আধ্যাতিœক জগতের মহান সাধক ও ধর্ম প্রচারক শাহ সুফী হযরত বদর শাহ(রহ:) এর নামানুসারেই এই মসজিদের নামকরণ হয়েছে বলে ঐতিহাসিক ভাবে প্রমাণিত ও সর্বজন গ্রিহীত।তবে(বাহার দরিয়া) থেকেও বদর মোকাম নামকরণ হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।মসজিদের সামনের দেওয়ালে এর প্রতিষ্ঠার সাল লেখা হয়েছে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দে।

প্রকাশ থাকে যে,১৭৫১ সালের দিকে হযরত বদর শাহ (রহ:) ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম থেকে নদী পথে এসে কস্তুরাঘাট এলাকায় উঠেন।এখানে প্রায় ২০ একর পাহাড়ী জমি আবাদ করে বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তোলেন। এবং বর্তমান কদর মোকাম সংলগ্ন জায়গায় একটি বাসা বেধেঁ সেখানে দীর্ঘ কয়েক বছর অবস্থান করার পর আবাদী জমিতে তাহের মুহাম্মদ ফকিরকে তার কার্যকারক হিসেবে রেখে অন্যত্র চলে যান।পরবর্তীতে জৈনদ্দীন সওদাগর ব্যবসার উদ্দেশ্যে সুদুর চট্টগ্রামের আনোয়ারা থেকে নদী পথে কক্সবাজার এসে কস্তুরাঘাট এলাকায় উঠেন।তিনি ধর্মপরায়ণ লোক ছিলেন।তাই তাহের মুহাম্মদ ফকিরের সাথে গড়ে উঠে তার গভীর ঘনিষ্ঠতা। এর ভিত্তিতে তাহের মোহাম্মদ ফকির বর্তমান মসজিদের জায়গায়সহ প্রায় ১৬ একর জায়গা জৈনুদ্দীন সওদাগরকে লা-খেরাজ হিসাবে দান করেন,সেই দানকৃত জমির একাংশে আনুমানিক ১৭৯০ খ্রিষ্ঠাব্দের দিকে জৈনুদ্দীন সওদাগর হযরত বদর শাহ(রহ:) এর নামানুসারে এই মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮২ সালে প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে,দ্বিতল বিশিষ্ট করে মসজিদটি পনু: নিমার্ণ করা হয়।১৯৯৭ সালে এই মসজিদের সীমানায় মহিলা মুসল্লিদের জন্য করা হয় আলাদা নামাজের ব্যবস্থা।

বর্তমানে জেলার ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদকে দেশের অন্যতম দর্শণীয় মসজিদ হিসাবে রুপান্তর করা হয়েছে।আগের কোন নকশা বা চিহ্ন এখন বিদ্যমান নেই,মসজিদের ফ্লোরে বিছানো হয়েছে ইতালিয়ান মার্বেল পাথরের টাইলস, জাপান ও থাইল্যান্ডের তৈরি ৬ টি এসি,বিদেশী ঝাড়বাতি,ইন্দোনেশিয়ান মাইক, আর্ন্তজাতিক মানের বুশ স্পীকার ও আর্কষনীয় ডিজাইনের মাধ্যমে মসজিদটিকে মানসম্পন্ন ও সুশোভিত করে গড়ে তোলা হয়েছে।বর্তমান মসজিদ কমিটির সুন্দর পরিচালনায় মসজিদটি শুধু কক্সবাজার জেলার নয় দেশের একটি ঐতিহ্যমন্ডিত মসজিদ হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। মসজিদ কমিটি জানায় ভবিষ্যতে মসজিদের সামনে প্রতীকি আলিফ সংকেতের ১০০ ফুট লম্বা একটি মিনার গড়ে তোলা হবে।বদর মোকাম মসজিদ পরিদর্শন শেষে বিভাগীয় শিক্ষক জনাব নাছির উদ্দীন-১, মসজিদের ধারাবাহিক ইতিহাস ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে তোলে ধরেন।

পরিদর্শন শেষে ছাত্র-ছাত্রীরা ইসলামের অনিন্দ সুন্দর স্থ্যপত্য কলার ধর্মীয় অনুভূতিকে ধারণ করে এক উৎসব মুখর সময় কাটার আন্দ হ্য়দয়ে ধারণ করার মুগ্ধতা নিয়ে চলে আসে।


লেখক : আনোয়ার জাহেদ ,প্রভাষক ,ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ কক্সবাজার সিটি কলেজ