ডেস্ক নিউজ:
মুঠোফোনে মন্তব্য করতে সাধারণত অস্বীকৃতি জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। রাজনৈতিক ইস্যুতে তার মন্তব্য জানতে চাইলে বলেন, অফিসে কিংবা বাসায় আসুন, সামনাসামনি কথা বলি। কেন তিনি মুঠোফোনে কথা বলতে চান না- এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু না জানালেও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন চলাকালে নজরুল ইসলাম খানের সঙ্গে দলের এক কর্মীর ফোনালাপ ফাঁস হয়। ওই ঘটনার পর থেকে মূলত তার এই সতর্কতা!

দলটির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মোবাইল ট্র্যাকিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে ফাঁস হয়ে যাওয়া আলাপনে দলীয় কৌশল যেমন প্রকাশ পাচ্ছে তেমনি নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারও পড়ছে হুমকির মুখে। আবার রাজনীতিতেও বিতর্কের শিকার হচ্ছে বিএনপি। এ কারণে দলের নেতাকর্মীরা মুঠোফোনে কথা বলার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করছেন।

তবে তারা ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ভাইবার ব্যবহার করে একে-অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন।

নিরাপদ সড়কের দাবিতে ঢাকায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালীন গত ৪ আগস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ফোনালাপ ছড়িয়ে পড়ে। যার শিরোনাম ছিল- ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ষড়যন্ত্রের ফোনালাপ’।

এক মিনিট ৪৯ সেকেন্ডের ওই ফোনালাপে শোনা যায়, ‘খসরু’ নাওমী নামে একজনকে ঢাকার বাইরে থেকে ৫শ’ লোক এনে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবির আন্দোলনে যোগ দেয়ার নির্দেশনা দিচ্ছেন।

ফোনালাপ প্রকাশের পর আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে নাশকতায় উসকানি এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানায় জাকারিয়া দস্তগীর নামে ছাত্রলীগের স্থানীয় এক নেতা মামলা দায়ের করেন। সেই থেকে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে দেখা যাচ্ছে না। ওই ঘটনার পর গোয়েন্দা পুলিশ ব্যারিস্টার মিলহানুর রহমান নাওমীকে কুমিল্লার বরুড়া থেকে আটক করে।

ওই কথোপকথনের বিষয়ে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী অস্বীকার করলেও গত ৫ আগস্ট বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, ‘আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর কথা বিকৃত করে ছেড়ে দেয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ প্রযুক্তির মাধ্যমে এখন সবই করা সম্ভব।’

গত ১৭ জুলাই সকালে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের ধানের শীষ প্রতীকের পক্ষে গণসংযোগকালে নগরের সাগরপাড়া বটতলার মোড়ে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। পরে ২১ জুলাই রাজশাহী জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মন্টু ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা তাইফুল ইসলাম টিপুর একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়।

সেই ফোনালাপে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর অনেক তথ্য। যেখানে দু’জনের কথায় স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছ থেকে ক্রেডিট এবং আওয়ামী লীগের ওপর দোষ চাপানোর জন্য ওই বোমা হামলার ঘটনা। পরে ওই ফোনালাপের সূত্র ধরে মন্টুকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। জবানবন্দিতে মন্টু নিজেই স্বীকার করেন যে, কথোপকথনটি তাদের। যেখানে উঠে আসে দলীয় একাধিক নেতার নাম। তবে টিপু জাগো নিউজের কাছে দাবি করেন, ফোনালাপটি তার নয়।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পুলিশের কাছে দেয়া মন্টুর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘পথসভায় হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সরকার বিএনপির ওপর দোষ চাপাচ্ছে। দুই নেতার যে অডিও বের হয়েছে ওটা এডিট করা। আপনারা নিজেরাই দেখতে পারেন কার কত রকম ছবি বের হয়, এর ঘাড়ে ওর মাথা। আমার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীরও এমন একটি আলাপন তৈরি করে দেয়া যেতে পারে। এসব কঠিন কাজ নয়।’

গত ২৫ জুন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে নাশকতার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেফতার হন বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) মিজানুর রহমান মিজান। এ সংক্রান্ত দুটি অডিও ক্লিপও জব্দ করে পুলিশ।

চলতি বছরের এপ্রিল মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে লন্ডনে নির্বাসিত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহামান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদের মধ্যে একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়। এতে তারেক রহমান আন্দোলনকারীদের সমর্থন দেয়ার কথা বলেন। সে সময় ওই আলাপের বিষয়টি মামুন গণমাধ্যমের কাছে স্বীকারও করেন।

২০১৫ সালে তারেক রহমানের সঙ্গে বিএনপির তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীর একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়। ওই ঘটনার পর শমসের মবিন চৌধুরী দলের মধ্যে কোণঠাসা হয়ে পড়েন এবং একপর্যায়ে তিনি দল থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। যদিও তিনি শারীরিক অসুস্থতার কথা বলে পদত্যাগ করেন।

এছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান এবং যুবদল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট রইস উদ্দিন রইসের মধ্যে কথোপকথন ফাঁস হয়। ২১ মিনিট ৫২ সেকেন্ডের ওই কথোপকথনে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ না করা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাক্ষাৎ নিয়ে অনিশ্চয়তাসহ দলের বিভিন্ন দুর্বল দিক উঠে আসে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের সঙ্গে তৎকালীন ছাত্রদল নেতা এবং বর্তমান বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য বজলুল করিম চৌধুরী আবেদের একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়। ফাঁস হওয়া ফোনালাপের একপর্যায়ে মওদুদ আহমদ বলেন, ‘শোনো (আবেদ) এই বিএনপিকে দিয়ে হবে না।’

এর আগে সাদেক হোসেন খোকা ও মাহমুদুর রহমান মান্নার একটি ফোনালাপে তোলপাড় শুরু হয় রাজনৈতিক অঙ্গনে।

দলের নেতাদের ফোনালাপ সামাজিক মাধ্যমে ফাঁস হওয়া প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী আহমেদের কাছে জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু তিনি সরাসরি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তবে জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘আমি তথ্যপ্রযুক্তির বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই। সুতরাং এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই।’

বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক শরীফ শাহ কামাল তাজের মুঠোফোনে এ বিষয়ে জানতে একাধিকবার কল দেয়া হয় কিন্তু তিনি রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে সংবাদকর্মী পরিচয় দিয়ে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।

বিএনপির কেন্দ্রীয় শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. এম ওবায়দুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সামাজিক মাধ্যমে প্রচার হওয়া অডিও-ভিডিও কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা তা বলতে পারবো না, তবে বিরোধী দল দমনে সরকারের একটা অপকৌশল রয়েছে। এসব তারই অংশ।’

‘সরকারের এসব অপকৌশলে নেতাকর্মী বা জনগণ বিভ্রান্ত হবে না। কারণ বিএনপি জনগণের স্বার্থরক্ষার রাজনীতি করে। জনগণই আমাদের মূল শক্তি।’

‘টেলিফোনে আড়িপাতা কিংবা ফোনালাপ ফাঁস করা, আমার মনে হয় বাথরুমের ছিদ্র দিয়ে দেখার মতো অত্যন্ত সংকীর্ণ মনোভাবের পরিচায়ক। এটি ব্যক্তির গোপনীয়তা লঙ্ঘন, এটি ব্যক্তির মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন; এটি অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত।’

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, ‘এটি অপজিশন পার্টিকে মাঠে নামতে না দেয়ার ষড়যন্ত্র। অডিও-ভিডিও যা-ই বলি না কেন, সবই ষড়যন্ত্র। এটা জনগণ বুঝতে পারে।’