শাহেদ মিজান, সিবিএন:
নানা সংকটের কারণে জেলার ২৬ লাখ মানুষের সেবাই ঠিকমতো দিতো পারতো না জেলার উন্নত চিকিৎসার একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান কক্সবাজার সদর হাসপাতাল! তার উপর ২০১৭ সালের আগস্টে মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসার ১১ লাখ রোহিঙ্গা চাপ। রোহিঙ্গা আসার প্রথম দিকে নানাভাবে আহত রোহিঙ্গাদের সেবাসহ সর্বোপরি সেবা দিতে ড়িয়ে মারাত্মক সংকট তৈরি হয়েছিল এই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। প্রথম দিকে রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে স্থানীয়রাই চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। প্রয়োজনীয় চিকিৎসক-নার্স এবং সরঞ্জামের কারণে এই সংকট ছিলো।

হাসপাতাল সূত্র মতে, সংকট অনুধাবনে এই হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম বাড়ানো ও উন্নত করণে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দাতা সংস্থা। ইতিমধ্যে আধুনিক সার্জারি বিভাগ, অত্যাধুনিক রোগ নির্ণনায়ক মেশিন ও ওয়ার্ড বৃদ্ধিতে অর্থায়ন করেছে দাতা সংস্থাগুলো। কিন্তু রোগির চাপ অনুসারে হাসপাতালের একমাত্র জরুরী বিভাগ ছিলো অত্যন্ত সংকীর্ণ। তাই অনেক আগেই জরুরী বিভাগটিই উন্নয়ন করা উচিত ছিলো বলে জানিয়ে আসছিল কর্তৃৃপক্ষ। এবার জরুরী বিভাগের আকার বর্ধন ও আধুনিকীকরণে এগিয়ে এলো ইন্টারন্যাশনাল রেডক্রস। জেলার স্থানীয় ২৬ লাখ মানুষ এবং ১১ লাখ রোহিঙ্গার ভার বয়ে চলা কক্সবাজার সদর হাসপাতালে জরুরী বিভাগকে অত্যাধুনিকীরণে তিন বছর মেয়াদী এক প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য রোববার সকালে ইন্টারন্যাশনাল রেড ক্রস (আইসিআরসি) এবং সদর হাসাতাল কর্তৃপক্ষের চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে।

জেলা সদর হাসপাতালের হলরুমে অনুষ্ঠিত উক্ত চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন- আইসিআরসি’র বাংলাদেশ ডেপুটি হে অব ডেলেগেছশন আবদুল লতিফ এমবেকে, স্বাস্থ্য ও পরিবার মন্ত্রণালয়ের সেবা বিভাগের যুগ্ম-সচিব মোঃ সাইফুল্লাহহিল আজম, কক্সবাজারের সিভিল সার্জন আবদুস সালাম, কক্সবাজার সদর হাসাতালের অতিরিক্ত পরিচালক ডা. সুলতান আহমদ সিরাজী, আবাসিক সার্জন ডা. টুটুল তালুকদার, আবাসিক ফিজিশিয়ান ডা. মো. শাহাজাহান, আইসিআরসি’র নেটওয়ার্কিং উপদেষ্টা শিরিন সুলতানা এবং কক্সবাজার অফিসের হাসপাতাল প্রকল্প ব্যবস্থাপক বারবারা টার্নুল।

আইসিআরসি’র তথ্য মতে, এই সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী আইসিআরসি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও মন্ত্রণালয়ের সাথে সদর হাসপাতালের জরুরী বিভাগের সেবা ও অবকাঠামোগত মানোন্নয়নের কাজ করবে। এতে স্থানীয় বাসিন্দাদের জরুরী স্বাস্থ্যসেবা চাহিদা সুনিশ্চিত হয়। এছাড়াও জরুরী বিভাগের চিকিৎসক ও নার্সদের নানা ধরণের প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে ও স্বীকৃত মানদন্ডের ভিত্তিতে যেন সেবার মান বাড়ানো যায়। সহায়তার মধ্যে থাকবে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে অবকাঠামো পুনর্বাসন, বিভিন্ন উপকরণ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সহায়তা, সক্ষমতা বৃদ্ধি, জরুরী অবস্থায় সাড়া প্রদান সক্ষমতা বাড়ানো। তার আগে আইসিআরসি’র বিদ্যমান জরুরী বিভাগের পুননির্মাণ করবে। এই কাজ চলাকালীন হাসপাতালের অস্থায়ী জরুরী বিভাগ চালু থাকবে। এতে রোগিরা নির্বিঘেœ সেবা পাবে। একই সাথে হাসপাতালের জরুরী বিভাগের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও আসবাবপত্র সরবরাহ করা হবে। পাশপাশি জরুরী বিভাগের চিকিৎসক ও নার্সদের বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষকরা প্রশিক্ষণ দেবেন।

কক্সবাজার সদর হাসপাতাল সূত্র জানায়, প্রতিদিন জরুরি বিভাগে যে পরিমাণ রোগি আসে সেই অনুযায়ী পর্যাপ্ত অবকাঠামো, সরঞ্জাম এবং চিকিৎসা সামগ্রীর মানদন্ড নেই। ঘাটতি রয়েছে জনবলেরও। বর্তমানে রোহিঙ্গা আসায় এ সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে। তাতে এগিয়ে এসেছে ইন্টারন্যাশনাল রেডক্রস। প্রকল্পটির প্রক্রিয়া ২০১৭ সালে শুরু হলেও নানা কারণে এতদিন তা বাস্তবায়ন হয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত আইসিআরসি ইমারজেন্সি ডিপার্টমেন্ট সাপোর্ট প্রোগ্রামের আওতায় নির্মিতব্য জরুরি বিভাগ হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলাদেশে প্রথমবারের মত কক্সবাজার সদর হাসপাতালে এই বিশ্বমানের জরুবি বিভাগ তৈরী করা হচ্ছে।

বর্তমানে যে জরুরী বিভাগ রয়েছে, সেখানেই গড়ে তোলা হবে বিশ^মানের জরুরী বিভাগটি। পুরাতন জরুরী বিভাগটি ভেঙে সেখানে নতুন জরুরী বিভাগের ডিজাইন অনুযায়ী অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। এটি চালু হলে জরুরী বিভাগে শুধুমাত্র জরুরী অবস্থার রোগী ও রোগীর সাথে মাত্র একজন স্বজন প্রবেশ করতে পারবেন। হাসপাতালে প্রবেশের পথটিও পরিবর্তন হয়ে যাবে। বর্তমানে জরুরী বিভাগ থেকে হাসপাতালের সাধারণ ওয়ার্ডে প্রবেশ করা হয়। কিন্তু আধুনিক জরুরী বিভাগ নির্মিত হলে দর্শনার্থীদের জন্য সেই প্রবেশ পথটি বন্ধ হয়ে যাবে। হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টা প্রবেশের পথ করা হবে দক্ষিণপাশের মর্গের সামনে থেকে।

নতুন জরুরী বিভাগটি রোগিদের জন্য তিনটি জোনে ভাগ করা থাকবে। এগুলো হল- লাল জোন, হলুদ জোন ও সবুজ জোন। ট্রাইএইজ সিস্টেমে রোগী বাছাই করণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে কোন রোগী কোন জোনে যাবে। জরুরী বিভাগে কোন সংকটাপন্ন রোগীয় আসলে প্রথমে ওই রোগিকে লাল জোনে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখান থেকে ভর্তিযোগ্য হলে সবুজ জোন হয়ে হাসপাতালের সাধারণ ওয়ার্ডে চলে যাবে রোগী। আর কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণে রেখে ছেড়ে দেওয়ার উপযোগী রোগী হলে হলুদ জোনে রাখা হবে।

নতুন এই জরুরী বিভাগ হলে হাসপাতালের জরুরী বিভাগের সামনে বাউন্ডারী দেয়ালে আরও একটি গেইট খোলা হবে। যাতে রোগী বহনকারি গাড়ি গুলো এক গেইট থেকে প্রবেশ করে অন্য গেইট থেকে দ্রুত চলে যেতে পারে। সাধারণ মানুষের ভীড় ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জনও পর্যাপ্ত পরিমাণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে জরুরী বিভাগে।

কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. শাহীন আব্দুর রহমান জানান, বর্তমানে যে পরিমাণ রোগী আসে সে অনুযায়ী সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয়। ২৫০ শয্যার হাসপাতালে প্রায় প্রতিদিনই ৫০০ জনের বেশি রোগী ভর্তি থাকে। এতে জরুরী বিভাগের চরম সঙ্কট সৃষ্টি হয়।

সিভিল সার্জন আবদুস সালাম বলেন, ‘বর্তমান যে জরুরী বিভাগ রয়েছে সেখানে সবকিছুই অপরিকল্পিত। যেখানে জরুরী বিভাগ সেখান থেকেই রোগী, রোগীর স্বজন ও দর্শনার্থীরা হাসপাতালে প্রবেশ করে। এর ফলে জনজট সৃষ্টি হয়ে জরুরী বিভাগে চিকিৎসা সেবায় মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। এছাড়া এক কক্ষেই জরুরী বিভাগের সব ধরণের সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় সংশ্লিষ্টদের। নতুন জরুরী বিভাগটি নির্মিত হলে সদর হাসপাতালটি একটি অত্যাধুনিক হাসপাতালে রূপান্তিত হবে বলে আমরা মনে করছি।’