আবদুল্লাহ আল মামুন


সাংবাদিকতা একটি অনন্য পেশা। এই পেশায় দৈনিক কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। দিনরাত্রির যেকোনো সময় খবর সংগ্রহের জন্য একজন সাংবাদিককে ছুটে যেতে হয় দূর থেকে দূরান্তরে। এই পেশা শুরু করার এবং পেশা থেকে অবসর নেওয়ার যেনো নেই কোনো সময়সীমা। যতদিন হাত চলবে, মগজ কাজ করবে, ততদিন চলবে কলম।
সাংবাদিকতায় রয়েছে জীবনের ঝুঁকি। সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানের মত দেশে যুদ্ধের খবর দিতে গিয়ে মারা যাচ্ছেন প্রচুর সাংবাদিক। ইরাক যুদ্ধের সময় খোদ আমেরিকা, আল-জাজিরার সাংবাদিকদের লক্ষ্য করে বোমা বর্ষণ করেছিল। সাংবাদিকের মিথ্যা অভিযোগে কারাবরণ, অর্থদন্ড ও জরিমানা, নির্যাতন ও হত্যার শিকার হওয়াটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন ডাল-ভাতের মতো ব্যাপার। আমাদের দেশেও বহু সাংবাদিক নিখোঁজ কিংবা খুন হচ্ছেন। সাগর-রুনী হত্যাকান্ডের কথা আমাদের কারো অজানা নয়। সম্প্রতি নিরাপদ সড়ক আন্দেলনের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে ঢাকার রাজপথে রক্তাক্ত হয়েছেন বহু সাংবাদিক।
আগে সাংবাদিকতা বলতে প্রিন্ট মিডয়াকেই বোঝাতো। এরপর আসলো ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, রেডিও এবং টেলিভিশন। আর এখন – অন-লাইন মিডিয়া ও সামাজিক মাধ্যম। তবে ফেসবুক, টুইটারের মত সামাজিক মাধ্যম এখন সবকিছুকেই যেনো ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমের সৌজন্যে একটি ক্লিকের মাধ্যমে খবর কিংবা বার্তা লক্ষ মানুষের কাছে পৌছে যাচ্ছে নিমিষে। মিসরের আরব বসন্ত নামে খ্যাত তাহরীর স্কোয়ারের গন-জাগরণ সামাজিক মাধ্যমের জন্যই ঘটেছিল।
কিছুদিন আগে মোবাইল ফোনের ফেসটাইমে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে হাজারো জনতা রাস্তায় নেমে সামরিক অভ্যুত্থান ব্যর্থ করে দিয়েছিল। তুরস্কের সামরিক বাহিনী টেলিভিশনে অভ্যুত্থানের ঘোষণা দিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুললো। ভাবলো, তাদের অভ্যুত্থান সফল হয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে ঠিক তার উল্টো। এইভাবে ডিটিজাল যুগের একটি ছোট্ট মুঠো ফোনের কাছে পরাজিত হয়েছে দীর্ঘদিনের প্রভাবশালী মাধ্যম টেলিভিশন। তবে সামাজিক মাধ্যমের কালো দিকটাও কিন্তু খুব ভয়ংকর। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে মানুষকে প্রতারণা করা হচ্ছে; লোভের ফাঁদ তৈরী করে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে টাকা, প্রসার ঘটছে পর্নোগ্রাফির। অন-লাইন মিডিয়ার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন সন্ত্রাশী এবং জঙ্গী সংগঠন তাদের উগ্র ভাবধারা প্রচার করছে, সংগ্রহ করছে আত্মঘাতি বোমারু।

বস্তুনিষ্ঠ এবং সাহসী সাংবাদিককে সবাই সমীহ করে চলে। সঠিক তথ্য ও বিশ্লেষনের জন্য সরকারী মাধ্যম কিংবা নেতাদের চেয়ে সৎ সাংবাদিকের উপরই মানুষ বেশী নির্ভর করে। তাই সঠিক তথ্য দিয়ে পাঠকের আস্থা অর্জন করে নিজেকে গ্রহনযোগ্য করে তোলার দায়িত্ব সাংবাদিকের নিজের।
কোনো অনুষ্ঠান কিংবা ঘটনার খবর তৈরী করার সময় সাংবাদিককে অকুস্থলে উপস্থিত থাকাটা খুবই জরুরী। সংবাদিক নিজেই যদি সংবাদের প্রথম সূত্র হন, তাহলে তথ্য বিকৃতির সুযোগ থাকেনা। তবে এখন দেখছি অনেক সাংবাদিক, ঘরে বসেই গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট তৈরী করেন। যেনো তাঁর হাতে রয়েছে ক্রিস্টাল বল, যাতে তিনি সবই দেখতে পাচ্ছেন।
পেশাদারিত্ব অর্জনের জন্য একজন সাংবাদিককে চলমান ঘটনাপ্রবাহ, রাজনীত, অর্থনীতি, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে নিজেকে হালনাগাদ রাখতে হবে। এজন্য নিয়মিত দেশ-বিদেশের সংবাদপত্র পড়া, টেলিভিশনের নিউজ চ্যানেলগুলো দেখা, অর্ন্তজালে প্রকাশিত খবরের দিকে নজর রাখা আবশ্যক। ধরুন, আপনি জ্বালানী তেলের বাজার নিয়ে একটি রিপোর্ট লিখছেন। এজন্য শুধু তেল উৎপাদনকারী দেশের তালিকা তৈরী না করে, সাথে অর্থনীতি, বিশ্ব রাজনীতি এবং তেল উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত প্রযুক্তি সম্পর্কিত কিছু বিশ্লেষণ জুড়ে দিলে লেখাটি সমৃদ্ধ হবে।
সাংবাদিক হওয়ার জন্য সাংবাদিকতা বিষয়ে ডিগ্রী নেয়াটা জরুরী নয়। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম চালু হয়েছে খুব বেশী দিনের কথা নয়। প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী ছাড়াও নিজের প্রজ্ঞা ও মেধার জোরো বহু বাঘা বাঘা সাংবাদিক দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন মিডিয়া ভূবন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এখন অনেকেই কোনোভাবে সংবাদ মাধ্যমের সাথে যুক্ত হতে পারলেই নিজেকে সাংবাদিক বলে দাবি করে বেড়াচ্ছেন।
একজন সাংবাদিকের সবচেয়ে বড় অলঙ্কার হচ্ছে নৈতিকতা ও সততা। তবে নৈতিকতার পথ মসৃণ নয়। এত রয়েছে প্রতিবন্ধকতা এবং ঝুঁিক। আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথাই বলি। প্রকৌশল পেশার পাশাপাশি আমি অস্ট্রেলিয়ার স্পেশাল ব্রডকাস্টিং সার্ভিস বা এসবিএস-এর রেডিও জার্নালিস্ট/ব্রডকাস্টার হিসাকে দীর্ঘ চৌদ্দ বছর কাজ করেছি। বিবিসি’র আদলে এসবিএস রেডিওতে ৭২টি ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। আমি বাংলা অনুষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলাম।
একবার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে একটি কথিকা রচনা করি। যাতে কবিতা ও দেশাত্মবোধক গানও ছিল। অনুষ্ঠান প্রাচরিত হওয়ার কিছুদিন পর একজন স্রোতা কর্তৃপক্ষের কাছে একটি অভিযোগ পত্র লেখেন যাতে তিনি নালিশ করেন, ওই অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বেশ কয়েকটি গান বাজানো হয়নি। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে ওই স্রোতার নির্ধারিত কিছু গান ছাড়া আর অন্য কোনো দেশাত্মবোধক গান বাজানো যাবেনা এমন কথা আগে কখনে শুনিনি। কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, অনুষ্ঠান নয় আমিই হলাম তাদের মূল লক্ষ্যবস্তু। তাই বিষয়টি তাঁরা আমলে নেননি। এরকম বহুবার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অভিযোগ আসতো, আমাকে চাকুরীচ্যুত করবে বলে হুমকিও দেয়া হত।
একজন প্রকৃত সাংবাদিক বিশেষ সুবিধা আদায়ের জন্য সংবাদকে বিকৃত করবেন না, সংবাদে নিজস্ব মতামত জুড়ে দেবেন না, অযথা জনস্বার্থবিরোধী এবং উস্কানীমূলক খবর দিয়ে হাঙ্গামা সৃষ্টি করবেন না। একজন প্রকৃত সাংবাদিক অনুসন্ধানী রিপোর্টে দুইপক্ষের মতামত দেয়ার সুযোগ দেবেন এবং অনিচ্ছাকৃতভাবে ভুল করলে সেটা সংশোধন করে দুঃখ প্রকাশ করবেন।
এখন পেশাদারিত্বের এতোই অভাব যে অর্ন্তজালে কোনো আকর্ষণীয় সংবাদ পেলে নূন্যতম সত্যতা বা সূত্র যাচাই না করে ঝড়ের বেগে ছাপিয়ে দিচ্ছেন অনেক সংবাদ কর্মী। কিছুদিন আগে “কাতারে বসবাসরত হাজার হাজার বিদেশী নাগরিকত্ব পেতে যাচ্ছেন”; “বিদেশীরা চাইলেই নাগরিক হতে পারবেন” ইত্যাদি শিরানোমের চটকদার খবরে সয়লাব হয়ে গিয়েছিল বহু সংবাদ পোর্টাল। অথচ খবরটির মধ্যে ছিলনা কোনা সত্যতা। সংবাদ মাধ্যম, পোর্টালের সাথে জড়িত অনেকের এই বেহাল অবস্থা দেখে ভীষন কষ্ট হয়। সংবাদের শিরোনাম কি আর তার নীচে কাট এন্ড পেষ্ট করে কি বসানো হচ্ছে সেটা দেখারও যেনো হুশ নেই সাংবাদিক বন্ধুদের।
ভূয়া খবর বা “ফেইক নিউজ” এখন মিডিয়া জগতের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। কোনটা আসল আর কোনটা নকল খবর, তা যাচাই করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন সবাই। ভূয়া খবরের খপ্পরে পড়ে শুদ্ধধারার সাংবাদিকতা চলে যাচ্ছে নির্বাসনে। গত বছর কাতারের সরকারী সংবাদ মাধ্যমে ভূয়া খবর ঢুকিয়ে দিয়ে কাতারকে রীতিমত যুদ্ধের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছিল। সম্প্রতি নিরাপদ সড়ক নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনের সময় ভূয়া খবরের যে সুনামী বয়ে গেলো তাতে তাজ্জব বনে গেলাম। কোনটা আসল এবং কোনটা নকল খবর, সেটা বের করা মোসাদের সেরা গোয়োন্দার পক্ষেও যেনো সম্ভব নয়।
অনেকে উৎসাহী হয়ে তোষামোদী করার জন্য কিংবা কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করে চরিত্রহননের জন্য ভূয়া খবর ছড়ান। আবার অনেকে মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অর্থ আয় করা কিংবা সামাজিক মাধ্যমে লাইকের ঝড় বইয়ে দেওয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে ভুয়া খবরের জন্ম দেন। এভাবে উদ্দেশ্যপ্রনোদিত হয়ে যারা ভিত্তিহীন খবর ছড়ান তারা আর যাই হন, সাংবাদিক হতে পারেন না।
ইদানিং অর্থ এবং ক্ষমতার মোহে অনেক সাংবাদিক বিপথগামী হয়ে পড়ছেন। সাংবাদিককে কত টাকা দিচ্ছেন তার উপর নির্ভর করবে আপনার খবর টেলিভশন কিংবা পত্রিকায় যাবে কিনা। দেখা গেছে, কোনো অনুষ্ঠানের রিপোর্টিং করতে গিয়ে মূল আয়োজকের নামই বাদ দিয়ে অন্য কারো নাম ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে। নেপথ্যে টাকার খেলাই হচ্ছে মূল কারন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাংবাদিকের ভাড়া বাড়ী দখল করার ঘটনাও আমার জানা আছে। আবারো বলি, এরা আর যাই হন, সাংবাদিক নন।
একজন সাংবাদিকের দায়বদ্ধতা অনেক। সাংবাদিকের একটি কলমের খোঁচায় বদলে যেতে পারে পৃথিবী, নেমে আসতে পারে ভয়ংকর বিপর্যয়। সাংবাদিকের একটি রিপোর্ট কাউকে রাতারাতি যেমন বানিয়ে দিতে পারে সেলিব্রিটি, তেমনি তাঁকে নিক্ষেপ করতে পারে কলঙ্ক আর অমর্যাদার আস্তাকুড়ে। অন্যদিকে একটি ভালো রিপোর্ট করে একজন সাংবাদিক নিজেও হয়ে যেতে পারেন সেলিব্রিটি এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। তাই কলমের ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখাটা আবশ্যক
একজন ভালো সাংবাদিক হতে হলে আত্মবিশ্বাস থাকাটা খুবই জরুরী। কিন্তু আত্মবিশ্বাস যাতে দম্ভে রূপ না নেয় সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে। বাংলা ভাষার অন্যতম কবি, সাংবাদিক রফিক আজাদ হয়তো তাই বলেছেন, “হে কলম, উদ্ধত হ’য়োনা, নত হও, নত হতে শেখো”।
(স্থানীয় ম্যাগাজিন “পরিবর্তন”-এ প্রকাশিত আমার লেখা নতুন আঙ্গিকে  প্রকাশ করলাম )