সৈয়দ শাকিল:
আমাদের দেশে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এখন জোরালো। আমি বলবো ‘নিরাপদ সড়ক’ আন্দোলন অনেকটাই সার্থক’ ৯ দফা দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে আসছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। নিরাপদ সড়কের দাবিতে পথে নেমে এসেছে আমাদের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। গত সপ্তাহে রাজধানীর একটি স্কুলের দুজন শিক্ষার্থী বাসচাপায় নিহত হওয়ার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা সড়কে নামে। তাদের আন্দোলনের প্রধান দাবি ছিল নিরাপদ সড়ক। প্রতিদিন সারাদেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে যত মানুষ নিহত হয়, সে সংখ্যা সত্যিকার অর্থেই আতঙ্কজনক। বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিরাপদে ঘরে ফেরা হবে কিনা, সেই শঙ্কা সবার মনেই থাকে। কারণ আমাদের অনিরাপদ সড়ক। তাদের দাবি সরকার মেনে নেয়ায় ইতোমধ্যে তারা ক্লাশ রুমেও ফিরে গিয়েছে। এবার বাস্তবায়ন চান শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সফল হয়েছে। ধন্যবাদ শিক্ষার্থীদের। সরকার মেনে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ধন্যবাদ সরকারকে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন এই আন্দোলনের সফলতা থেকে আগামীতে করণীয় উদ্যোগের আভাস দিয়েছেন। এই সত্য অনুধাবনের অভিবাদন ও সাধুবাদ তাদের।
এখন সরকারকে সময় দিতে হবে। সরকার ইতিমধ্যে শিক্ষার্থীদের দাবি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু করেছে। বাকিগুলোও পর্যায়ক্রমে পূরণের আশ্বাস দিয়েছে। আমরা সরকারের সেই আশ্বাসে আস্থা রাখতে চাই।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যেই মন্ত্রিসভার বৈঠকে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ এর খসড়া। সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের সাজা ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রেখে সড়ক পরিবহন আইনের এ খসড়া অনুমোদন দেয়া হয়। নতুন আইন অনুযায়ী বেপরোয়াভাবে বা অবহেলা করে গাড়ি চালানোর কারণে কেউ আহত বা নিহত হলে দণ্ডবিধির ৩০৪ (খ) ধারায় মামলা দায়ের হবে। আর এই ধারায় সাজা সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড এবং সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা। তবে গাড়ি চালানোর কারণে কারো নিহত হওয়ার ঘটনা তদন্তে হত্যা বলে প্রমাণিত হলে ফৌজদারি আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান প্রয়োগ হতে পারে।
নতুন আইনে বলা হয়েছে, গাড়ি চালানোর অপেশাদার লাইসেন্স পেতে হলে অষ্টম শ্রেণি পাস ও ১৮ বছর হতে হবে। পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য ২১ বছর হতে হবে। এছাড়া লাইসেন্সেপ্রাপ্ত চালকের জন্য থাকবে ১২ পয়েন্ট। অপরাধ করলে পয়েন্ট কাটা যাবে। এভাবে ১২ পয়েন্ট শেষ হয়ে গেলে লাইসেন্স বাতিল হবে। অপরদিকে কোনো অপরাধী ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবেন না। আগে যেসব অপরাধী লাইসেন্স পেয়েছে তা বাতিল করা হবে।
সড়ক পরিবহন আইন নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি ছিল। কিন্তু ৩৫ বছর পর আইনটির যে খসড়া চূড়ান্ত হলো, তা প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। ২০১১ সালে যখন এই আইনটির খসড়া সংশোধন করা হয়। গত সাত বছরে এতে অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর কারণ, সড়ক দুর্ঘটনার দায় অনেকাংশেই চালকের ওপর চাপানো হয়েছে। দুর্ঘটনার সঙ্গে বাকি যাঁরা সংশ্লিষ্ট, তাঁদের দায়মুক্তি দিয়েছে।
সারা দেশে শিশু-কিশোর-তরুণদের বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর আমরা দেখলাম পরিবহন খাতে কতটা গভীর অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনা চলছে। বছরের পর বছর নানা অনিয়ম জমে জমে পরিবহন খাত একটি দানব হিসেবে তৈরি হয়েছে। আমরা নতুন যে আইনটি পেতে যাচ্ছি, তা সড়ক পরিবহন খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারবে কি না, সে সন্দেহ থেকেই গেল। সংসদে আইনটি পাস হওয়ার আগে সরকারের উচিত বিশেষজ্ঞদের আরও মতামত নেওয়া। আইনটি যাতে জনপ্রত্যাশা পূরণ করতে পারে, সে চেষ্টা করা। এ ধরনের কাজের জন্য একটি স্বতন্ত্র ও নিরপেক্ষ সংস্থা গড়ে তোলা উচিত।
সড়কে একদিকে নিয়ন্ত্রণহীন যানবাহন, অন্যদিকে বৈধ লাইসেন্সবিহীন চালক, ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা, গাড়ির ফিটনেস না থাকা, খানা-খন্দে ভরা সড়ক এবং কখনো কখনো পথচারীদের অসাবধানতাই প্রতিদিন দুর্ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। এসব সহ নানা অসঙ্গতির বিরুদ্ধে এবং সহপাঠী হারানোর শোক থেকে পথে নামে শিক্ষার্থীরা। প্রায় এক সপ্তাহের বেশি সময় তারা নয় দফা দাবি নিয়ে পথে থাকে।
১. বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো ড্রাইভারকে ফাঁসি দিতে হবে এবং এই বিধান সংবিধানে সংযোজন করতে হবে। ২. নৌপরিবহন মন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার করে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। ৩. ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ ও লাইসেন্স ছাড়া চালকরা গাড়ি চালাতে পারবেন না। ৪. বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেয়া যাবে না। ৫. শিক্ষার্থীদের চলাচলে এমইএস ফুটওভারব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৬. প্রত্যেক সড়কে দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় স্পিডব্রেকার দিতে হবে। ৭. সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্রছাত্রীদের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে। ৮. শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে থামিয়ে তাদের নিতে হবে। ৯.সারাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
তাদের এই আন্দোলন আমাদের অসঙ্গতিগুলো তুলে ধরেছে, ফলে তা আমাদের জন্য মাইলফলক হয়ে রইবে। কারণ তাদের এই যুগান্তকারী আন্দোলন শুধু তাদেরই দাবি নয়, এই দাবি বাংলাদেশের সব মানুষের।
এ সময় সড়কে শৃঙ্খলা আনতে তারা একদিকে যেমন ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করেছে অন্যদিকে তেমনি চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করেছে। যাত্রীদের সচেতন করেছে, পথচারীদের ফুটপাত ব্যবহারের আহ্বান জানিয়েছে। শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে স্বতঃস্ফুর্তভাবে সাড়া দিয়েছে সাধারণ মানুষও।
সকালের সতেজ মানুষ বিকেলেই অপঘাতে নিঃশেষ। আমরা আর সড়ক দুর্ঘটনা দেখতে চাই না। এমন মৃত্যু আর দেখতে চাই না । প্রতিদিন অসংখ্য সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মৃত্যুবরন করছে,পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে মানুষ। একটি সড়ক দুর্ঘটনা বয়ে আনে অপরিসীম যন্ত্রনা-অধিকাংশ পরিবারের কর্মক্ষম মানুষ্টি হারিয়ে হয়ে যায় অসহায়। বাস্তবে নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নে জোরালো কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি এতোদিন। ফলে, সড়ক দুর্ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। নিরাপদ সড়ক চাই পৃথিবীর আর কোন দেশে এমন ধরনের সামাজিক আন্দোলন নেই। বিশ্বের অনেক দেশে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে আমাদের সাথে শতভাগ একাত্বতা প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ১৯৯৩ সালে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ (নিসচা) নামে একটি সামাজিক সংগঠন। নিসচা কার্যক্রমের মধ্যদিয়ে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই দেশের সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন পায়। নিসচা দীর্ঘ বছর ধরে সড়ককে নিরাপদ করার লক্ষ্যে আন্দোলন করে আসছে। এই আন্দোলেনের ধারাবাহিকতায় ২২ অক্টোবর দিনটি জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।
২০১৭ সালের ৫ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই দিনটিকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস ঘোষণা করা হয়।
তবে মোদ্দা কথা কেউই এই আন্দোলন নিয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাননি। দেখার সুযোগ ছিল না, নেইও। এটাই সত্য। শিশু-কিশোরদের এই আন্দোলন শেষ হয়নি বরং শুরু। এই আন্দোলনকে সক্রিয় রাখতে হবে শিক্ষায়, জ্ঞানে এবং আদর্শে। ভালো চিন্তার মধ্য দিয়ে এই বোধ এগিয়ে নিতে হবে। পরাস্ত করতে হবে সব অপশক্তিকে। কারণ, আগামীর নেতৃত্ব তাদরে হাতেই। আসুন, এই শিশু-কিশোরদের জন্য একটি নিরাপদ রাষ্ট্র গড়তে যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে কাজ করি!
শিশু কিশোরদের স্যালুট জানাব, তারা যে ইতিহাস রচনা করল, তা কখনো মুছে যাবে না। জয় হোক নিরাপদ সড়কের ।
লেখক- সাংবাদকর্মী, কক্সবাজার।