মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম 


বাড়ছে কিশোর অপরাধ, বাড়ছে এর ভয়াবহতা। শুধু চট্টগ্রামে গত ১৭ জুন রাতে হালিশহর আর্টিলারি রোডে ছুরিকাঘাতে মোঃ সুমন (১৭) নামে এক গ্যারেজ কর্মচারীকে খুনের ঘটনায় ১০ কিশোরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতার কিশোরদের স্বীকারোক্তি মতে পুলিশ সুমন খুনে ব্যবহৃত ছোরা এবং ছিনতাই করা মোবাইল উদ্ধার করে। গত ১৭ জুন কিশোর গ্যাংস্টারের বলি হয় অনিক। ছুরিকাঘাতে অনিককে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামিরা সকলেই কিশোর বয়সের। গত ১৮ জুন রাতে নগরীর বাকলিয়ার মিয়া খান নগর এলাকায় ছুরিকাঘাতে জসিম উদ্দিন (২০) খুনের ঘটনায় মূল আসামিসহ ৫ কিশোর-যুবককে গ্রেফতার করে পুলিশ।

গত ২৭ মে সকালে নগরীর মধ্যম হালিশহরে ব্যাংক কর্মকর্তা সজল নন্দীকে ২৯ লাখ টাকার জন্য খুন করে তিন কিশোর। এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় জয় (১৬) , প্রতীক (১৬), জিকু (১৭) নামে ৩ কিশোরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গত ২ মে সকালে নগরের পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত থেকে সানসাইন স্কুল এন্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্রী তাসফিয়া আমিনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তাসফিয়া হত্যাকান্ডে দায়েরকৃত মামলায় ৬ আসামির সবাই কিশোর। এ ঘটনায় আদনান মির্জা ও আসিফ মিজান নামে দুই কিশোরকে আটক করে পুলিশ। গত ২১ মে নগরীর কামাল বাজারে খুর দিয়ে গলা কেটে আরাফাতকে (২০) খুনের ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামিদের অধিকাংশই কিশোর। এ ছাড়া গত ১৬ জানুয়ারি নগরীর কলেজিয়েট স্কুলের মেধাবী শিক্ষার্থী আদনান ইসফার (১৫) নামে এক কিশোরকে হত্যা করা হয়।

কিশোর অপরাধের বলি আদনান হত্যায় জড়িতরা সবাই কিশোর। এ ছাড়া গত ১৬ ফেব্রুয়ারী নগরীর মুরাদপুরে গ্যাংস্টার সদস্যদের দ্বারা গুলিবিদ্ধ হন সিএমপি’র এএসআই আবদুল মালেক। ওইদিন রাতে গ্রেফতার হয়েছিল দুই কিশোর। অপরাধী সনাক্তকরণ ও গ্রফেতারে পুলশিরে দক্ষতা ও ভুমকিা নশ্চিতি প্রশংসার দাবীদার। কন্তি সাম্প্রতিক সময়ে কিশোর অপরাধ এখন দানবীয় হিং¯্রতায় রূপ নিচ্ছে। এই অবস্থা ঢাকা সহ সমগ্র দেশের আগেও কিশোর অপরাধ ছিল। সেগুলো ছিল খেলার মাঠে ধাক্কা-ধাক্কি, মারামারি, ঘর পালানো, কিছু চুরি, ছোটখাটো ছিনতাই এবং ইভটিজিং। খুন, ধর্ষণ, মাদক ক্রয়-বিক্রয়ের মতো ভয়াবহতা সে সময় ছিল না। এমনকি পাড়া-মহল্লায় মুরব্বীদের সামনে উঠতি বয়সের তরুণরাও সিগারেট খেতে ভয় পেত, লুকিয়ে-চুরিয়ে সিগারেট/বিড়ি খেত। এখন সে সব নেই। ৭ম-৮ম শ্রেণীর ছাত্ররাও নির্বিকার ভাবে সিগারেট টেনে যাচ্ছে। বাকিদের কথা বাদ-ই দিলাম।

আমি মানি কিশোর বয়স এডভেঞ্চারের, নতুন কিছু করার। আমরাও কৈশোর/তারুণ্য পেরিয়েছি। সে সময় ফুটবল খেলা নিয়ে ব্যাপক মারামারি, কথা কাটাকাটি করতাম। এডভেঞ্চার ছিল স্কুল পালিয়ে খেলতে যাওয়া বা সিনেমা দেখা, দূরে কোথাও ঘুরতে চাওয়া, পড়া ফাঁকি দেওয়া কিন্তু মাষ্টার মশাইয়ের হাতে ধরা না খাওয়া, কিঞ্চিৎ নীল বই পাঠ। যা-ই করতাম স্কুল থেকে বাড়ি ফিরার ঠিক সময়টাতেই বাড়ি ফিরতে হতো। তা না হলে থাকতো মা-বাবা দুজনেরই কড়া শাসন আর কৈফিয়তের কাঠগড়া।

সন্ধ্যার সময় অর্থাৎ মাগরিবের নামাজের পর অবশ্যই পড়ার টেবিলে বসতে হতো। মাঝে গৃহ শিক্ষক আসতেন, পড়া নিতেন, বুঝাতেন, পড়া আদায় না করলে নিজেই একটু উত্তম-মধ্যম দিয়ে শাসন করতেন। আবার ভয়ও দেখাতেন মা-বাবাকে জানাবেন বলে। এই ভয়টা ছিল ভয়ঙ্কর ভয়। কিন্তু এখন এর কিছুই নেই। যিনি বা যারা ভয় দেখাবেন তারা উল্টো ভয়ে থাকেন। এখন শিক্ষক একটু কড়া করে ধমক দিলে নাকি অভিভাবকরা দলবল নিয়ে শিক্ষক পিঠাতে আসেন। সে ভয়ে শিক্ষকরা সাইড লাইনে চলে গেছেন। আর অভিভাবকরা শাসন করলে সন্তানেরা উল্টো পাচকথা শুনিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়া, ঘরে ভাঙ্গচুর করা এখন খুব অহরহ একটা ব্যাপার।

যাই হোক কিশোর অপরাধ এখন যে পর্যায়ে চলে এসেছে দলমত-ধর্ম-বর্ণ-ধনী-গরীব নির্বিশেষে কঠোর সচেতন না হলে এর পরিনতি ভয়াবহরূপ ধারণ করবে। পত্র পত্রিকায় প্রায়ই দেখছি কিশোর অপরাধের জন্য রাজনীতি ও গ্যাং কালচারকে দায়ী করছে। আমি এটি মানতে নারাজ। রাজনীতি আগেও ছিল, থাকবে। আগে কি এরকম হয়েছিল? এখন কেন হচ্ছে? আসুন সামাজিক ব্যবস্থাটার একটু ব্যবচ্ছেদ করি। জানি, অনেকে মানবেন না। তরপরও নিজের পরিবার, সমাজ ও আশে পাশে একটু পর্যবেক্ষণ করে দেখবেন- এটাই চাওয়া।

আগে মা-বাবারা সন্তানদের পিছনে গুনগত সময় দিতেন। সন্তানদের খাওয়া, দাওয়া, পড়াশোনা, খেলাধুলা সব কিছুরই প্রতি ছিল নজর, দিতেন শ্রম। মা-বাবার বকুনি, খাবার বন্ধ ও কাপড় চোপড় কিনে না দেয়ার ভয়, পিটুনি ছিল মাত্রাভেদে শাসনের উপকরণ। সন্তান একটু বেয়াড়া হলে মা-বাবার টেনশনের কমতি থাকতো না। ঘরে ও বাইরে কঠোর নজরদারী, শিক্ষকের সাথে আলোচনা, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সহযোগিতা চাওয়া, সন্তানের বন্ধু-বান্ধবদের ডেকে আদরের সুরে শাসন (শাসনের সুরে আদর) করতেন। এখন টাকা/সম্পদ কমানোর যুগে মা-বাবা সেটি করেন না। সবাই ব্যস্ত সম্পদ বানাতে, ভোগ বিলাসে। তারা ভাবেন সন্তানের জন্য ধন-সম্পদ রেখে যেতে পারলেই তাদের দায়িত্ব শেষ। তারা ভাবেন বস্তুগত সম্পদ দ্বারা সন্তানের ভবিষ্যৎ নিরাপদ করে দিবেন। কিন্তু নিজ সন্তানকে দেশ ও জাতির জন্য একটি মূল্যবান সম্পদে পরিণতি করার কথা ভাবেন কয়জন?

সম্পদ রেখে যাওয়াটাই সন্তানের প্রতি বিরাট ও একমাত্র গুরুদায়িত্ব বলে মনে করেন অধিকাংশ অভিভাবকরা। সন্তানকেই কিভাবে দেশ ও জাতির জন্য সম্পদ বানাবেন তথা কিভাবে নিজের পায়ে নিজে দাড়িয়ে আদর্শ মানুষ বানাবেন তার শিক্ষা কয়জনই বা দেন? আসলে সেই সময়ই বা কই? চাকুরী-ফেসবুক-টিভি এগুলো করে সময় থাকে? কি এক যুগ আসলো ফেসবুক আর সিরিয়ালে মায়েরা গভীর মগ্ন হয়ে থাকেন। একবার পত্রিকায় পড়েছিলাম,“সিরিয়াল দেখার জন্য সন্তানকে বেধে রেখেছিলেন এক মা”। সেটা সন্তান ছোট হওয়ায়। সন্তান বড় হলে টিভি সিরিয়ালের সময় কি তার কেউ খোঁজ রাখে? আর ফেসবুকের কথা বাদ দিলাম। সন্তানের যতœ, আদর, ভালবাসা, শাসন এখন সবই ফেসবুকে করে ফেলছেন সবাই। সন্তান একটু বেয়াড়া হলে মা-বাবা হাল ছেড়ে দেন,“তোর যা ইচ্ছা মন চায় কর”। সন্তানের সব আহ্লাদ-আবদার পূরণ করাটাই যেন সন্তানের প্রতি আদর-ভালোবাসা। আবার আবদার পূরণ করতে না পারলে সন্তানের গোয়ার্তুমি/বেয়াড়াপনার কাছে এই বলে নতি স্বীকার করে যে, “এত্ত ঝামেলা নিতেই পারছিনা”।

আসলে প্যাম্পার্স যুগের অভিভাবকেরা তো রাত জেগে পাহারা দিয়ে সন্তান প্রতিপালন করেন না। তাদের নানান কাজ। আগে মা-বাবা পাহারা দিয়ে জেগে থাকতো। প্রসাব-পায়খানা করে সন্তান জেগে উঠলেই রাত-বিরাতে উঠে সেগুলো পরিষ্কার করে বদলে ঘুম পাড়িয়ে তারপর তারা একটু চোখ বুজত। এরকম একরাতে শিশু সন্তান কতবার কেদেছে, জেগেছে, বিছানা ভিজিয়েছে তার ইয়ত্তা থাকতোনা। অথচ এখন এক প্যাম্পার্স মুড়িয়ে ঘুম, এক প্যাম্পার্সেই সকাল। এরকম যদি হয় অবস্থা তবে তার বেড়ে উঠার বিভিন্ন সময় গুলোতে যে নিবিড় পর্যবেক্ষণ, পরিচর্যা আর দিক নির্দেশনা পাওয়ার দরকার তা কি সে পাচ্ছে? চাকুরী, ব্যবসা, টিভি, সিরিয়াল, সিনেমা, ফেসবুক, টুইটার, পার্টি ইত্যাদি করে কতটুকু সময় সন্তানের পিছনে দেওয়া যায়? বয়সন্ধিকালে যখন একটি ছেলে উপনীত হয় তখন সে সমযটুকু হতে ১৮ বছর বয়ষ পর্যন্ত পরিবারের নিবিড় পরিচর্যা ও সঠিক তত্ত্বাবধান খুব জরুরী।

এ সময় তার মধ্যে ভুল পথ ও সঠিক পথ এ দুয়ের পার্থক্য তুলে ধরতে হবে। তৈরী করতে হবে,“সৎ-অসৎ, শুদ্ধ-ভুলের চেতনা”। কারণ এ সময় টুকুতেই একটা ছেলে নষ্ট হয়ে যেত পারার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এ সময়টাতে মনে হয় আমি সব জয় করতে পারব। এ সময়টাতে সবকিছু রঙিন মনে হয়। মনে হয় একটু ভিন্ন কিছু করে সবার নজর কাড়ি। সবাই ভাবুক আমি হিরো। এই যে অনুভূতি, এটিকে সঠিক পথে প্রবাহিত করতে না পারলে ধরে নিতে হবে আপনার উঠতি বয়সের সন্তান ভুল পথে যাবে।

আরেকটি বিষয়, সন্তান প্রতিপালনে আদর-শাসনের মধ্যে সুষম ভারসাম্য খুবই জরুরী। খুব বেশী কড়া শাসন সন্তাকে বেয়াড়া করে ফেলে। তেমনি অতিরিক্ত আদর-¯েœহও বেয়াড়া করে ফেলে। আপনার সন্তানকে যদি যা চায়, তা-ই দেন তবে তার অবুঝ মন একটার পর একটা পেতে অভ্যস্থ থাকবে। না পাওয়ার পরিস্থিতির সাথে তার পরিচিতিই থাকবে না। একটু বড় হলে সে তার চাহিত কিছু না ফেলে উগ্র আচরণ করতে পারে। আপনার সাথে রুঢ় আচরণ করে তা আদায় করার চেষ্টা করবে। কারণ তার মানসিক সিস্টেমে ,“না পাওয়া” নাই। আমার এক বোন তার ১২/১৪ বয়সী সন্তান যখন কাদতো, না কাদার জন্য মোবাইল দিত। এখন এমন অবস্থা তার সন্তান সারা দিন মোবাইলে গেইম খেলে, ইউটিউবে ভিডিও দেখে। এই মোবাইল না দিলে সে ভাত খায় না, পড়ালেখা করে না, বেয়াড়া আচরণ করে। আপা-দুলাভাই নিরুপায়।

আপনি আপনার সন্তানের প্রয়োজন পূরণ করবেন, আহ্লাদ পূরণ করবেন কিন্তু একটা যৌক্তিক সীমা রেখা থাকবে। শৈশব থেকে বালক বা কৈশোর বয়সে তার চাহিদা পূরণে আপনার কষ্টটুকু/প্রচেষ্টাটুকু তাকে সীমিত আকারে বুঝান, বুঝান আপনার সাধ-সাধ্যের পরিমিতি, অহেতুক চাওয়ার অযৌক্তিকতা বুঝান। বোঝানোর কাজটা কষ্টের। কিন্তু এটি আপনাকেই করতে হবে। আবার সব সময় কড়া শাসনের মাঝে থাকলেও সন্তান বেকে যেতে পারে। তাই ভালো কাজ, খারাপ কাজ গুলোর সম্পর্কে ধারনা দিন। সৎসঙ্গ-অসৎসঙ্গ নিরুপনের সহায়তা করুন। আর ভালো কাজগুলো পুরস্কৃত করুন। সেটি সব সময় যে কিছু দিয়ে করতে হবে তা নয় বরং মৌখিকভাবে উৎসাহিত করাটাও অনেক সময় বস্তুগত উপহারের চেয়ে অনেকগুন বেশী ফলপ্রসূ। খারাপ কাজগুলো নিরুৎসাহিত করুন। মাঝে মাঝে কঠোর তিরস্কার দিয়ে হলেও। এই আদর/¯েœহ আর শাসনের ভারসাম্য যদি সঠিক হয় দেখবেন আপনার সন্তান বিপথে যাবে না-কখনই না।

পারিবারিক কাঠামো ব্যবস্থা পরিবর্তনের একটি সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। যৌথ পরিবার/একান্নবর্তী পরিবার প্রথা ভেঙ্গে এখন একক পরিবারে দুই/এক সন্তান নীতির কারণে শিশু বড় হচ্ছে একাকীত্বে। একটু বড় হলেই টিভি, কার্টুন, ভিডিও হয় তার বন্ধু। এই কার্টুন/টিভি সিনেমাতে হিরোইজম তথা মারামারি বা যুদ্ধের পর নায়কের জয় দেখানো হয়। শিশু কাল থেকে একাকীত্বে থাকার কারণে স্বার্থপরতা তৈরী হয় আর তাতে যোগান দেয় একাকীত্বের সংগী টিভি, ভিডিও, গেমস, কার্টুন। স্বার্থপর আর হিং¯্র করে শিশু কিশোরদের।

স্কুলের শিক্ষদের কাছ থেকে প্রত্যাশা আছে। তাদের কাছে অনুরোধ তারা যেন শিক্ষার্থীদের নিজ সন্তানদের মতো শাসন-¯েœহের ভারসাম্য দিয়ে পরিচর্যা করেন। কোন শিক্ষর্থী একটু বেয়াড়া হলে অনেক শিক্ষকই আশা ছেড়ে দেন। আর কোচিং, প্রাইভেট ব্যাচ, টিউশনি করে সাথে ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ চালিয়ে শিক্ষকেরও সময় কোথায় ছাত্র/ছাত্রীর এত্তোকিছু লক্ষ করার। শিক্ষকজাতিও আজ পুজিবাদী-অর্থনীতির জোয়ারে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। কিন্তু জাতি গঠনে মা-বাবার পরে তাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশী। ক্ষেত্র বিশেষে মা-বাবার আগে শিক্ষকের গুরুত্ব। স্কুলে ঠিক মতো উপস্থিত থাকছে কিনা, একটা ছাত্র/ছাত্রীর আচরণ কেমন, পড়াশোনা কেমন করছে, স্বভাব-প্রকৃতি কোন দিকে যাচ্ছে সে অনুযায়ী কাউন্সেলিং-শাসন-অভিভাবককে অবহিত করণ এসব শিক্ষক সমাজকে করতে হবে। আমরা একটা ভয়াবহ সময়ে মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এর পরিনতি কি পরিমান ভয়ংকর হতে পারে শুধু একবার কল্পনা করুন। সত্যি হাত-পা শিউরে উঠার মতো। আপনাদের কাছে করজোড়ে অনুরোধ আমাদের বাঁচান, প্লিজ।

এবার আসি সমাজের কথায়। সমাজ কেমন জানি স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। এখানে আমরা সবাই চাই কিভাবে নিজেরা ভালো, নিরাপদ থাকবো। কি অদ্ভুত এক বৈশিষ্ট্য গত দশ/পনের বছরে এই সমাজ অর্জন করেছে ভাবলে সত্যি হতাশা লাগে। এই কিছু দিন আগেও পাড়ার মুরুব্বীরা ছোটদের শাসন করতেন। একুট হৈ হুল্লোড় বা কোন ব্যতিক্রম দেখলে ডাক দিতেন। এমনকি সিগারেট খেলে ডেকে ধমক দিয়ে বলতেন,“ তোমাদের বাবাকে বলে দিব”। কিংবা কেউ যদি এক জায়গায় জটলা পাকিয়ে জোরে কথা বললেও বলতেন, “এই কি হচ্ছে এখানে, পড়া লেখা বাদ দিয়ে? যার যার ঘরে যাও”। এখন সেই সমাজ কই? কই সেই সামাজিক অভিভাবকরা? প্লিজ আপনারা, একবার জেগে উঠুন, এতো স্বার্থপর হবেন না।

এবার আসি কিশোর গ্যাং কালচারের কিছু কথায়।বড় বড় নেতারা তাদের স্বার্থে কোমলমতি স্কুল-কলেজগামী ছেলেদের অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে ব্যবহার করেন রাজনৈতিক ও আর্থিক ফায়দা হাসিলের জন্য। আগেও রাজনীতিবিদ ছিল, মারামারি ছিল, খুন-খারাপীও ছিল। কিন্তু সেগুলো হতো তরুণ যুবকদের দ্বারা। এখন হচ্ছে বালক-কিশোরদের দ্বারা। এরা অপরিণত, ঠিক-বেঠিক যাচাই করেনা, পরিনাম-পরিনতি বুঝেনা। এরা ভিন্ন কিছু করার নেশায়, সিনেমার মতো প্রভাব-ক্ষমতা দেখানোর আশায় বড় ভাইদের ছত্রছায়ায় আশ্রয় প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠে।

ভালো-মন্দ, ঠিক-বেঠিক, নীতি-দুর্নীতি, সৎ-অসৎ এসব এই বয়সে বুঝার বদলে যদি ক্ষমতা, অস্ত্রবাজি, হিরোইজম, প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ ঢুকে বসে তাহলে তার পরিনতি খুন/জখম/ধর্ষণ ছাড়া কিছুই পাওয়া যাবে না। প্রিয় বড় নেতা, পাতি নেতা, ভালো নেতা, গুন্ডা নেতা আপনারাতো সারাজীবন এই রকম থাকবেন না। বয়স হবে, মরবেন- আপনাদের ছেলে মেয়ে থাকবে। তারা যদি এরকম আরেক নেতার আশ্রয়ে যায় কিংবা তারা যদি এরকম আরেক নেতার আশ্রিত কিশোরদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধের শিকার হয় তাহলে কেমন লাগবে- বিষয়টি একবার ভেবে দেখুন।

মাদক ও পর্ণোগ্রাফির কথা বাদই দিলাম। এটি শুধু কিশোরদের নয় সমগ্র বাংলাদেশে মরণব্যাধি ক্যান্সারের মত আমাদের নীতি-নৈতিকতা, বিবেক- মূল্যবোধ, সততা-ন্যায়পরায়ণতা সবকিছুকে তিলে তিলে হত্যা করছে। জাগিয়ে তুলছে হিংসা-বিদ্ধেষ, হানাহানি-অসহিষ্ণুতা আর চরিত্রহীনতা-বিকৃত মন মানসিকতা।

সময় খুব দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে। ছোট বেলায় মুরুব্বীরা একটা কথা বলতেন,“ যার হয় ৯ বছরে হয়, যার হয় না ৯০ বছরেও হয় না”। সন্তানদের যদি ছোটকাল হতে সঠিক পথে পরিচালিত করা না যায় তবে সামনে ভয়াবহ দুঃসময় আসবে। উঠন্তিমূল পত্তনে চেনা যায়- তাই সন্তানদের বালক হতে তরুণ এই সময়টুকু সর্বোচ্চ যতœ ও তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে। এ ব্যাপারে পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল সহ সকলকে এগিয়ে আসতে হবে ।

কিশোর অপরাধের বলি আমি-আপনি যে কেউ হতে পারি। তার চেয়ে বড় কথা দেশের নবপ্রজন্ম যে ভয়াবহ মূলবোধের অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাতে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভয়ানক শংকিত হতে হয়। তবে সময় এখনো শেষ হয়ে যায় নি। শক্ত হাতে হাল ধরে কিশোরদের সঠিক পথে, জ্ঞানের পথে, আলোর পথে, ভালবাসার পথে নিয়ে যেতে পারলে এই দেশ সুখ-শান্তি ভালবাসায় ভরে উঠবে। জীবন ও মানবতার জয় গান হবে বাংলার পথে প্রান্তরে। সোনার বাংলায় সোনার মানুষ সুখে শান্তিতে থাকবে।


মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম ,সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার ,বাংলাদেশ পুলিশ।